(গতকালের পর)
আজকাল একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট কোনও ছবির মুখ্য অভিনেতা নির্দেশক বিজেপির সমালোচনা করলে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়, উল্টোদিকে বিজেপির সমর্থক কোনও অভিনেতা নির্দেশক যদি ছবির মধ্যে মিথ্যে ইতিহাস দেখায়, (যেমন মহম্মদ ঘোরিকে নাকি পৃথ্বীরাজ চৌহান হারিয়ে দিয়েছেন) ঠিক যেমনটা বিজেপি চায়, তবে সেই ছবির ক্ষেত্রে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বিনোদন কর অবধি মকুব হয়ে যায়! এই যে ক্রমাগত রোমিলা থাপার বা ইরফান হাবিবের মতো ইতিহাসবিদকেও আজকে ভারতে ‘দেশদ্রোহী’ বলা হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও ট্যুইটারে ট্রেন্ডিং হচ্ছে, সেটাও এই গৈরিকীকরণের সিস্টেমের একটা ছোট্ট অংশমাত্র।
আরও পড়ুন-সিটিজেন রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট ইউনিট মূল লক্ষ্য, পাড়ায়-পাড়ায় সমাধান, বাংলা জুড়ে জনসংযোগ
চলচ্চিত্রের যে বেসিক স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা শুধু খর্ব নয় বরং নিজেদের ন্যারেটিভ প্রচারের অস্ত্র। যদি তুমি আমার পছন্দসই কিছু না দেখাও অমনি তোমার ছবিকে বয়কটের ডাক দেব! এটাই আজকের বিজেপির পরিষ্কার কথা। কোনও রাখ ঢাক না করেই নির্লজ্জতার সাথে বিজেপির মুখপাত্ররা টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য বির্তকেও এই কথা বলে দেন! ভাবলে অবাক লাগে, আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে কি সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ বানাতে পারতেন? আর যদিও বা বানাতেন, এই বিজেপির গর্ধশিক্ষিত বাহিনী তো তাঁকেও দেশদ্রোহীর আখ্যা দিতেন। যেখানে, সন্দীপের মতো একজন ধূর্ত চতুর নেতা উগ্র জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছেন। বলতে গেলে সন্দীপই ‘ঘরে বাইরে’র মূল অ্যান্টিগোনিস্ট! ভাবুন তো একবার, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতাকে প্রধান ‘অ্যান্টিগোসিন্ট’ দেখিয়ে ছবি বানালে, সেই ছবি আজকের বিজেপি আরএসএসের কী ভয়ঙ্কর রোষে পড়বে! দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও হয়তো এরা ছাড়বে না। কারণ, ‘ঘরে বাইরে’ মূল উপন্যাসটা তো গুরুদেবেরই লেখা। এই যে ভারতের সহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামো শিল্পীর স্বাধীনতা, সেসবই আসলে ভারতের সংবিধান আমাদের দিয়ে গেছে।
বিজেপি নেতাদের ভাষণে প্রায়শই উচ্চারিত হয়, ‘‘হিন্দু খাতরে মে হ্যায়।” অর্থাৎ হিন্দুরা ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন। কিন্তু বিজেপির আমলে যদি সবচেয়ে বেশি কিছুর ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে, তা হল ভারতের সংবিধান। যে সংবিধান আমাদের কথা বলার অধিকার, আমাদের মৌলিক মত প্রকাশের অধিকার দেয়, সেই সাংবিধানিক অধিকারটাই আস্তে আস্তে মুছে ফেলে এক নতুন নাগপুরের সংবিধান লেখার প্রবণতা শুরু হয়েছে। নাহলে নিউইয়র্কে দাঁড়িয়ে কমেডিয়ান ভীর দাসের একটি অসাধারণ উপস্থাপনার জন্য তাঁকে, দেশে ফিরলে খুন করে দেওয়া হবে বলে প্রকাশ্যে সামাজিক মাধ্যমে লেখা যায়? কমেডিয়ান মুনায়ার ফারুখিকে শো বাতিল করানো হচ্ছে। খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করকে ট্যুইটারে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া অবধি চলছে! সেই প্রভাব খানিক হলেও তো বাংলাতেও এসে পড়ছে। নাহলে পরিচালক রাজ চক্রবর্তী’র ‘ধর্মযুদ্ধ’র মতো ‘ধর্মীয় মৌলবাদে’র বিরুদ্ধে একটা সময়োপযোগী ছবিকেও তো বয়কট করার ডাক দিচ্ছে। বা পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত’র সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ছবির বিরুদ্ধেও ধর্মীয় মৌলবাদীরা ফেসবুকে বয়কটের ডাক দিচ্ছে! কারণটা শুনলে চমকে যেতে হয়, কারণ ইন্দ্রদীপের ছবির নাম ‘বিসমিল্লাহ’! মানে দু’হাজার বাইশে এসেও একটা ছবির নামের জন্য এভাবে ফতোয়া দেওয়া যায়? আসলে বিজেপি কথায় কথায় যতই পশ্চিম এশিয়ার ইসলামিক দেশগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলুক, এই ফতোয়া সংস্কৃতিটা তো বিজেপি ইসলামিক দেশগুলো থেকে পুরো ‘কপি-পেস্ট’ করে ফেলেছে। ইরানের পরিচালক জাফর পানাহির কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েদের ফুটবল খেলার ফতোয়া নিয়ে তাঁর ছবি ‘অফসাইডে’র প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়, সেই দেশে। শুধু তাই নয়, পানাহিকে গৃহবন্দি করে রাখে সে দেশের সরকার। এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সম্প্রতি তাঁকে ৬ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছে সেদেশের আদালত! আসলে সবরকম ভাবে দমনপীড়ন নীতি ফ্যাসিবাদের চরম লক্ষণ। যার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে আজকের ভারতবর্ষে।
আরও পড়ুন-বিজেপি যোগ, ত্রিপুরা তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে অপসারিত সুবল ভৌমিক
বয়কট সংস্কৃতি হোক বা মিথ্যে ইতিহাস নিয়ে বানানো ছবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লম্বা লম্বা প্রশংসাসূচক ট্যুইট। এসবই আসলে দেশের আসল সমস্যাগুলো থেকে আপনাকে-আমাকে দূরে রাখা। তারমধ্যেও যদি কোনও স্বর দীপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘‘এটা আমার দেশ। কিন্তু এই দেশে আজ বড্ড অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে!” ওমনি তার ওপর নেমে আসবে অদৃশ্য খাঁড়া। এই অসহিষ্ণু সময়ে তবুও একজোট হয়ে লড়াই করে যেতে হবে। ক্যানভাসের ছবি। কবির কবিতা। মঞ্চের নাট্য। পর্দার সিনেমা। স্বাধীন ওয়েব সিরিজ। রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই সেরা সেরা শিল্প সৃষ্টি করবেন শিল্পীরা। ইতিহাস সাক্ষী, সভ্যতার সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোতেই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-সিনেমা-গান-নাটক তৈরি হয়েছে। সেটা ফরাসি বিপ্লবের সময় হোক বা ভারতের স্বাধীনতার লড়াই কিংবা ভিয়েতনামের যুদ্ধ। যখনই উল্টোদিকের ক্ষমতাসীন শক্তি প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে, শিল্পের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে শিল্প ও শিল্পীর। শাণিত ফলার মতো শতকের সেরা শিল্পকর্মগুলো বেরিয়ে এসেছে তখনই। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘প্রিয়, ফুল ফোটানোর দিন নয় অদ্য। ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা…”