মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা

সম্প্রতি কেরলে একটি বিরল রোগে মারা গেল এক কিশোর। গবেষণা অনুযায়ী মৃত্যুর কারণ হল একধরনের অণুজীবের আক্রমণ যা আসলে একটি অ্যামিবা। জানা গেছে এই অ্যামিবার পছন্দের খাবার হল মানুষের মাথার ঘিলু। সেই লোভে এরা মস্তিষ্কে ঘটাতে পারে মারাত্মক সংক্রমণ। যার ফল হল মৃত্যু। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

আমাদের চোখের আড়ালে গড়ে ওঠা এমন এক ক্ষুদ্র অথচ শক্তিশালী জগৎ রয়েছে যা মানুষকেও পরাস্ত করে। তারা হল অণুজীব। এই অণুজীব জগতের সবাই-ই যে মানুষের বা মনুষ্যেতর প্রাণীদের ক্ষতি করে তা নয়। কিছু কিছু প্রজাতিই বা বিশেষ কিছু অণুজীবই তা করে আর বাকিরা হয় নিষ্ক্রিয় থাকে নয় উপকার করে। যেমন—আমাদের অন্ত্রে থাকা কিছু ব্যাকটেরিয়া কিন্তু খাদ্যরস শোষণে, ভিটামিন সংশ্লেষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে আজকের আলোচনা কিন্তু এই অণুজীব জগতের এমন এক সদস্যকে নিয়ে যে নাকি মানুষের ঘিলু খেতে ভালবাসে! সদ্য তার কবলে পড়েই কেরলের এক কিশোর মারা যায়।
নিগ্লেরিয়া ফাউলেরি (Naegleria Fowleri)
পারকোলোজোয়া পর্বের নিগ্লেরিয়া গণের একটি প্রজাতি হল নিগ্লেরিয়া ফাউলেরি। এদেরকে প্রকৃত অ্যামিবা হিসেবে ধরা না হলেও এদের দেহের আকৃতি ও গঠন পর্যবেক্ষণ করে এদের অ্যামিবার মতো আকৃতি পরিবর্তনকারী ফ্ল্যাজেলাবিশিষ্ট এক্সকাভেট হিসেবে গণ্য করা হয়। মুক্তজীবী, ব্যাকটেরিয়া-ভোজী এই অণুজীব কিন্তু কখনও কখনও সংক্রামকও হতে পারে। এরা মস্তিষ্কে অকস্মাৎ মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে, যা নিগ্লেরিয়াসিস নামে পরিচিত। এই রোগ এতটাই ভয়াবহ রূপ নিতে পারে যে কিছুদিনের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিটির মৃত্যুও ঘটাতে পারে। অনেক সময় এই রোগকে আবার প্রাথমিক অ্যামিবাঘটিত মেনিনজোএনসেফালাইটিস-ও বলা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড শিশু হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ম্যালকম ফাউলারের নামে এই অণুজীবের নামকরণ করা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম ‘প্রাথমিক অ্যামিবাঘটিত মেনিনজোএনসেফালাইটিস’-এ আক্রান্ত হওয়ার একটি জলজ্যান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেন।
আরও এক রিপোর্ট বলে ইংল্যান্ডের বাথ শহরের রোমান বাথে নিগ্লেরিয়ার উপস্থিতির কারণে ১৯৭৮ সাল থেকে স্নান করা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- ফ্যাসিবাদ জ্যান্ত আজও এবং সেটা আজ ভারতে

কোথায় পাওয়া যায় একে
নিগ্লেরিয়া ফাউলেরি (Naegleria Fowleri) হল স্বাদু ও উষ্ণ জলে বসবাসকারী এক অণুজীব। এরা সাধারণত পুকুর, হ্রদ ও নদীর উষ্ণ জলে বা উষ্ণ প্রস্রবণে (৪৬°সেঃ বা ১১৫ ফাঃ) থাকতে ভালবাসে। বলা বাহুল্য জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদের সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বেড়ে ওঠার বিভিন্ন ধাপ
মূলত তিনটি পর্যায়ে এরা থাকতে পারে— সিস্ট, ট্রফোজয়েট (অ্যামিবার মতো) এবং বাইফ্ল্যাজেলেট। মানবদেহের কলায় যখন থাকে তখন এরা সিস্ট গঠন করে না, বরং শুধুমাত্র ট্রফোজয়েট হিসেবেই থাকে। তবে সেরিব্রোস্পাইনাল তরলে এরা ফ্ল্যাজেলেট হিসেবে বিদ্যমান থাকে।

সিস্ট
এদের সিস্ট পর্যায় অনেকটা গোলাকার প্রায় ৭–১৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট, অনেকটা মসৃণ এবং একস্তরী প্রাচীরবেষ্টিত এবং অবশ্যই নিউক্লিয়াস যুক্ত। সাধারণত ট্রফোজয়েটগুলি প্রতিকূল পরিবেশে সিস্ট হয়ে যায়। খাদ্যের অভাব, জনবাহুল্য, মিষ্টি জলের বা স্বাদু জলের অভাব, সঞ্চিত বর্জ্যের আধিক্য এবং নিম্ন তাপমাত্রা ১০°সেঃ (৫০°ফাঃ) তাপমাত্রার নিচে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনুকূল অবস্থায় অবশ্য এই অ্যামিবাগুলি সিস্টের মাঝ-বরাবর অস্টিওল বা ছিদ্রপথে বাইরে বেরিয়ে আসে।

ট্রফোজয়েট
ট্রফোজয়েট হল অ্যামিবার খাদ্যগ্রহণ, বিভাজন ও মানবদেহের সংক্রামক দশা। এই পর্যায় অ্যামিবাগুলি অলফ্যাক্টরি আবরণীতে সংযুক্ত হয় এবং অলফ্যাক্টরি স্নায়ুকোষের অ্যাক্সনকে অনুসরণ করে নাসাগহ্বরের ক্রাইব্রিফর্ম পাতের মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছয়। ২৫°সেঃ (৭৭°ফাঃ) তাপমাত্রায় এরা ট্রফোজয়েট দশা লাভ করে এবং ৪২ সেঃ (১০৬.৭ ফাঃ) তাপমাত্রায় সবচেয়ে ভাল বৃদ্ধি পায়। এরা সিউডোপোডিয়া দ্বারা চলাচল করে। মুক্তজীবী অবস্থায় ট্রফোজয়েটগুলি ব্যাক্টেরিয়া ভক্ষণ করে বেঁচে থাকে। কোষকলা বা লোহিত রক্তকণিকাকে এরা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করে, আবার এই দশাতেই এরা এদের কোষ পর্দার চারিদিকে ১-১২টি অ্যামিবাস্টোম গঠন করে যেটিকে দেখতে অনেকটা সাকার বা চোষক বা ফুড কাপের ন্যায়। যার মাধ্যমে এরা খাদ্য গ্রহণ করে থাকে।

ফ্ল্যাজেলেট
নাশপাতি-আকারের এই পর্যায়টি কিন্তু ফ্ল্যাজেলাবিশিষ্ট। এই অবস্থায় অণুজীবটি কারও সাঁতার কাটার সময় কিংবা নদীতে বা পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার সময় নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। এই দ্বি-ফ্ল্যাজেলেট (দুটি ফ্ল্যাজেলা) দশা তখনই দেখা যায় যখন ট্রফোজয়েটের বাহ্যিক পরিবেশে আয়ন ঘনত্বের তারতম্য। নাসাগহ্বরে একবার প্রবেশ করলেই এরা ভোল বদলে ফ্ল্যাজেলেট দশা থেকে ট্রফোজয়েট দশার রূপ নেয়। বলা বাহুল্য ফ্ল্যাজেলেট থেকে ট্রফোজয়েটে রূপান্তর কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘটে থাকে।

রোগ সংক্রমণ
নিগ্লেরিয়া ফাউলেরি (Naegleria Fowleri) সাধারণত ব্যাকটেরিয়া খেয়েই বেঁচে থাকে। কিন্তু মানবদেহে সংক্রমণের সময় এদের ট্রফোজয়েট দশা মস্তিষ্কের অন্যতম গঠনগত কোষ অ্যাস্ট্রোসাইট ও স্নায়ুকোষকে ভক্ষণ করতে থাকে। যদিও মস্তিষ্কে গমনপথ হিসেবে নিগ্লেরিয়ার ক্রাইব্রিওফর্ম পাত ব্যবহারের কারণ এখনও অজানা। তবে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে অ্যাসিটাইলকোলিনের উপস্থিতি এই অণুজীবকে সংক্রমণের জন্য সাহস জোগায় বলে ধারণা করা হয়। এমনকী নিগ্লেরিয়ায় অ্যাসিটাইলকোলিন গ্রাহক CHRM 1-এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
নাকের মাধ্যমে ফ্ল্যাজেলেট দশা প্রবেশের ১ থেকে ৯ দিনের মধ্যে (গড়ে ৫ দিন) সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। প্রাথমিক সংক্রমণের উপসর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাথাব্যথা, জ্বর, গা-গোলানো বমি-বমি ভাব, ক্ষুধামান্দ্য, স্বাদ হারানো, চোখে কম দেখা, আবছা দেখা বা না দেখা ইত্যাদি। পরবর্তী উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, বিভ্রান্তি, মনোযোগের অভাব, ভারসাম্যে সমস্যা, আকস্মিক ভারসাম্যহীনতা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হ্যালুসিনেশন প্রভৃতি। সাধারণত লক্ষণ দেখা যাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগী মারা যায়। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে অন্য ব্যক্তিতে এই রোগ সংক্রমিত হয় না। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪টি সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া যায়। মনুষ্যেতর প্রাণীদের ক্ষেত্রেও কিন্তু ফাউলেরির সংক্রমণ হতে পারে, যদিও এই সংক্রান্ত তথ্য খুবই কম। দক্ষিণ আমেরিকায় গবাদি পশুতে নিগ্লেরিয়াসিস হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার পরীক্ষামূলকভাবে ইঁদুর, গিনিপিগ ও ভেড়ার শরীরে এই অণুজীবের প্রবেশ ঘটিয়ে সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

বাঁচার উপায়
এই রোগে অ্যামফোটেরিসিন বি-যুক্ত ছত্রাকনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয় বটে, তবে এই চিকিৎসা-ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও নিগ্লেরিয়া সংক্রমণে মৃত্যুর হার ৯৫%-এরও বেশি। এই সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে সবচেয়ে আগে জলাশয় পরিষ্কার রাখতে হবে। যে-কোনও ভাবে জলাশয়কে দূষিত করার খেসারত মানুষ আগেও দিয়েছে আর এখনও দিচ্ছে। যদি আমরা জলাশয়কে পরিষ্কার না করি তাহলে জীবনহানি আবার ঘটবে। তাই প্রতিকার নয় সবচেয়ে আগে প্রতিরোধ দরকার।

Latest article