রাজস্থানের ভরতপুর থেকে আসা বিরাট বড় বড় মার্বেলের খণ্ডগুলোকে কাটাকুটি করে মন্দিরের বিভিন্ন জায়গায় বসানো চলছে। মাথায় হেলমেট পরা ধোপদুরস্ত ইঞ্জিনিয়ারদের দল গোটা কাজ তদারকিতে ব্যস্ত। চারিদিকে শ্রীরামের ছবি দেওয়া গেরুয়া ঝান্ডা। সিসিটিভি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ এবং সিআইএসএফের জওয়ানদের আধুনিক রাইফেল দেখে মনে হবে যেন কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পড়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রই বটে। বুলডোজার, পে-লোডার, দানবীয় ক্রেন আর কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়ে দিনরাত এক করে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ চলছে রাম জন্মভূমির মন্দিরের। যেভাবেই হোক আগামী বছর জানুয়ারির মধ্যে শেষ করতে হবে বহু চর্চিত অযোধ্যার রাম মন্দির। উদ্বোধন করবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
এবার অযোধ্যা থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে যেটি সরকারি ভাবে অযোধ্যা জেলারই অংশ ধন্নিপুরে চলে যান। এখানেই বাবরির বিকল্প মসজিদ নির্মাণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে ৫ একর জমি দিয়েছে ভারত সরকার। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষরেই বাস এই জনপদে। সেখানকার একটি স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, সেই মান্ধাতা আমলের ক্লাস ঘর। আলো বা পাখার বালাই নেই। ডিজিটাল ক্লাসরুম কোনও অলীক কল্পনা সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের কাছে। সেই পুরোনো ব্ল্যাকবোর্ড, ভাঙা কয়েকটা বেঞ্চ। আর একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী-সহ একজনই শিক্ষক। ওই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীই আবার মাঝে মাঝে ক্লাসও নেন। এক কথায় বলতে গেলে, এটাই আজকের ভারতবর্ষ। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য। নরেন্দ্র মোদির শাসন কালে আজকের ভারতবর্ষে এটাই স্বাভাবিক চিত্র৷ ওপরের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল, কারণ সম্প্রতি, নয়া সাংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিনে সাংসদদের মধ্যে সংবিধানের প্রস্তাবনার যে স্মারকটি তুলে দেওয়া হল তাতে দেখা গেল, সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দুটি বাদ। এটা কি নেহাতই কাকতালীয়, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন ঘটাল বিজেপি সরকার? যে সংবিধান এদেশের কোটি কোটি নাগরিকের একমাত্র আশ্রয়স্থল। এবার কি তবে, সেই সংবিধানের (Constitution) মূল কাঠামোতেও কাঁচি পড়তে চলেছে? একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন বিজেপি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দুটিকেই বাদ দিতে এত আগ্রহী? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে আমাদের চারপাশ। যেখানে স্বঘোষিত গোরক্ষক বাহিনীর নেতা দিনের আলোয় একজন সংখ্যালঘু মানুষকে বেমালুম খুন করে দিচ্ছেন। খুনিরা জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসছেন আর বিজেপির বিধায়ক-সাংসদেরা তাঁদের গলায় জয়মাল্য পরিয়ে বীরের সম্ভাষণ দিচ্ছেন! ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশে এমন দৃশ্য দেখে বিস্মিত হতে হয়। তার পর অনুধাবন করতে হয়, নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে এসবই ‘নিউ নর্ম্যাল’! এসবই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রাদায়ের মানুষকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’র নাগরিকে পরিণত করার একটি কৌশল।
আরও পড়ুন- ভারতীয় কূটনীতিকদের উপর নজরদারি কানাডার! প্রকাশ্যে তথ্য
আর ‘সমাজতান্ত্রিক’? ভারতবর্ষের সংবিধানে (Constitution) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে মূলত সামাজিক সমতা এবং অর্থনৈতিক সমতার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য-সহ প্রতিটি নাগরিক অধিকার ভারতের প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে সমবণ্টনের কথা বলছে আমাদের সংবিধান। অথচ নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে গোটা ব্যবস্থাটাই নিয়ন্ত্রণ করছে বৃহৎ পুঁজি। চরমভাবে বেড়েছে আর্থিক বৈষম্য! ‘অক্সফ্যামে’র একটি তথ্য বলছে মাত্র ৫৭ জন ভারতীয় ভারতের মোট অর্থের প্রায় ৭০% এর মালিক! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেখানে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্থনীতিতে ভারতবর্ষকে তৃতীয় শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সেখানে মাথা-পিছু আয়ে আমরা এখন বাংলাদেশের চেয়েও পিছিয়ে! মূলত ভারতের মোট সম্পদের সিংহভাগই দখল করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিল্পপতি। আর শিশু ও মহিলাদের অপুষ্টি এবং বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আমাদের দেশ তলানিতে এসে ঠেকেছে!
বৃহৎ পুঁজির শিল্পপতিরাই বিজেপিকে কোটি কোটি টাকা দান করে ‘নির্বাচনী বন্ড’-এর মাধ্যমে! স্বাভাবিক কারণেই ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের অ্যালার্জি থাকবেই। তবে, একথা সত্য, বিজেপি যতই সংবিধানকে বদলের চেষ্টা করুক। বিষয়টা আইনত এতটা সহজ হবে না। কারণ, সংবিধানের সংশোধনী এবং সংবিধানের মূল কাঠামো বদল দুটি এক জিনিস নয়। সংবিধানের মূল কাঠামোতেই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিকতা’ রয়েছে। সংবিধানের (Constitution) ধারা ২৫-২৮ ভারতের প্রতিটি নাগরিককে তাঁর মতো করে নিজ নিজ ধর্মাচারণের অধিকার দিয়েছে। এবং ‘ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপাল অফ স্টেট পলিসি’ (DPSP) ধারা ৩৬-৫১-এর মধ্যেই ভারতের সমাজতান্ত্রিকতার ভাবনাটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার বিখ্যাত ‘কেশবানন্দ ভারতী বনাম স্টেট অফ কেরল’ মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের একটি চমৎকার রায়। যেখানে সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, সরকার চাইলে সংবিধানের (Constitution) অনেক কিছুই বদল করতে পারে, কিন্তু মূল কাঠামোকে বদল করা যাবে না। আরেকটি বিখ্যাত মামলা ১৯৯৪ সালের এস আর বোম্মাই মামলাতেও মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রায়ে জানায়, ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ। এবং কোনও মতেই এটিকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। আরও পরে ২০০৮ সালেও সুপ্রিম কোর্টে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ দুটিকে বাদ দেওয়ার জন্য একটি আবেদন জমা পড়ে৷ যে আবেদন খারিজ করে তৎকালীন ভারতের প্রধান বিচারপতি কে ডি বালাকৃষ্ণন বলেন, এই দুটি শব্দই ভারতের সার্বিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! তাই এই শব্দ দুটিকে বাতিল করার প্রশ্নই নেই। ফলে, আইনত এই দুটি শব্দকে এখনই বাতিল করতে পারবে না নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকার। যদিও এরপরেও নিয়ম করে বহু বিজেপি সাংসদ-বিধায়ক থেকে শুরু করে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরা প্রায়ই আদালতে আবেদন করে চলেছেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ওই দুটি শব্দ বাদ দেওয়ার জন্য। নয়া সংসদ ভবনের প্রথম কাজের দিনেই বিজেপি তাদের মূল লক্ষ্যকে কোনও রাখঢাক না রেখেই প্রকাশ্যে এনেছেন। কারণ, এই সরকার বারে বারে আইন ব্যবস্থাটাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। নিজেদের একটি নব্যসংবিধান, নব্যগৈরিক ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বৈরাচারী শাসকেরা ঠিক এভাবেই নিজেদের মতো করে শাসন ব্যবস্থা চালিয়েছেন। আজকের ভারতবর্ষেও এমনই এক নয়া ফ্যাসিবাদী শাসকের আগ্রাসন চলছে যারা ধনতান্ত্রিক মৌলবাদী শাসন কায়েম করতে চায়৷ কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত ইতিহাসবিস্মৃত হয়েছেন। যখনই কোনও শাসক নিজেকে সর্বেসর্বা ভেবেছেন, তখনই সেই শাসককে ইতিহাসের কালের গর্ভে নিক্ষেপ করেছে সাধারণ জনগণ। এটাই শক্তি ‘জনগণমন’র। এটাই শক্তি গণতন্ত্রের। আর এই শক্তি দেশের কোটি কোটি নাচার অসহায় মানুষকে কোনও রাষ্ট্রশক্তি দেয় না৷ দেয় ভারতের সংবিধান। ভারতের ১৪০ কোটির ‘গীতা, কোরান, বাইবেল, গ্রন্থ সাহেব’ ভারতের সংবিধান।