এজেন্সি নামিয়ে জননেত্রীকে আটকানো যায়নি, যাবে না

নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হরিয়ে ফেলা কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাটা মোদি-শাহ জমানার দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই মিথ্যাচারের কাছে মাথা নত করবে না তৃণমূল কংগ্রেস। উলটে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বিপজ্জনক এই প্রবণতার ভয়ানক পরিণতির বিষয়ে হুঁশিয়ার করতে কলম ধরেছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Must read

প্রতিবেদন : প্রাক্তন কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল বিনোদ রাই একদা বলেছিলেন যে, সিবিআই-এর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে বেশ কয়েক হাতের দূরত্ব থাকা দরকার। অর্থাৎ সিবিআই ও সরকারের ভিতরের যে সম্পর্ক, সেখানে কয়েক হাতের দূরত্ব থাকা দরকার। এই ‘সিবিআই’ নামক সংস্থাটি ১৯৪১ সালে স্পেশাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট অনুসারে তৈরি হয়।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এর পর এল দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৪৬, যেটা ১৯৪১-এর ব্রিটিশ জমানার আইন অনুসারী। ১৯৪৬ সালে দিল্লি পুলিশের অধীনে দুর্নীতি দমনের একটা শাখা তৈরি হয়। তখনও কিন্তু দেশে স্বাধীনতা আসেনি। কিন্তু যাকে আজ আমরা ‘সিবিআই’ বলছি অর্থাৎ সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন, সেটার অস্তিত্ব রচিত হয় ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল, মানে স্বাধীনতার অনেক পরে। তখন ভারত সরকার ‘বিআই’ গঠনের জন্য ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত নেয়। সেই রেজোলিউশনের নম্বরটা হচ্ছে, 4/31/61-T-MHA, এটা ১৯৬৩ সালে তৈরি হয় আর নেহরুর মৃত্যু হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৩ সালে যখন এটি তৈরি হয় তখন নেহরুর যে ভাবনা এর মধ্যে জড়িয়ে ছিল সেটা হল, দুর্নীতি দমন করতে হবে। নেহরু সেই সময়ে যাঁরা মুখ্যমন্ত্রী, তাঁদের ‘ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার’ বা ‘ডিয়ার প্রিমিয়ার’ সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন। কারণ তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের, প্রধানমন্ত্রী বলা হত।

আরও পড়ুন : মনোনয়ন জমা দিয়েই গণেশ বন্দনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সেই চিঠির অনেকগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ‘দুর্নীতি’ আর ‘মুদ্রাস্ফীতি’—এই দুটো বিষয় নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত ছিলেন। সেই দুটো বিষয়ের সমাধান আজ পর্যন্ত ভারতবাসী করে উঠতে পারেনি। সেই ১৯৬৩ সালের তৈরি হওয়া যে সিবিআই, সেটার যিনি প্রধান ছিলেন, সেই প্রথম অধিকর্তার নাম ডি পি কোহলি। ১০ বছর তিনি এই পদে ছিলেন। সেই সময় স্বরাষ্ট্রসচিব এল পি সিং। তিনি আইসিএস অফিসার ছিলেন। তিনি এবং ডি পি কোহলি, এই দু’জন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, যেভাবে হোক প্রিমিয়ার একটা কেন্দ্রীয় তদন্তের সংস্থা তৈরি করতে হবে এবং সানথানাম কমিটি দুর্নীতি দমনের যে সুপারিশ করেছিল, তার ভিত্তিতেই এই সংস্থাটা তৈরি হয়। দেশের যত অঙ্গরাজ্য আছে, যত কেন্দ্রশাসিত এলাকা আছে, সমস্ত ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে এই সার্বভৌম ভূ-খণ্ডে এটি তদন্তের কাজ চালাবে, এই রকমই ঠিক হয়েছিল। ১৯৪৬ সালের এস পি ই অ্যাক্টের সেকশন-৬এ অনুসারে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, গোটা দেশে এই রীতিনীতি মেনে তদন্ত হবে। এরপর দেখা যাচ্ছে, যখন জয়েন্ট কনফারেন্স সিবিআইতে পরিণত হল এবং রাজ্যের অ্যান্টি-করাপশন অফিসারদের সম্মেলন হল, সেই চতুর্থ বাইনিয়াল যুগ্ম সম্মেলনে তৎকালীন সিবিআই-এর ফাউন্ডার-ডিরেক্টর ডি পি কোহলি বলেছিলেন, “মানুষ আমাদের কাছ থেকে আশা করে যে আমাদের সাংঘাতিক একটা কর্মক্ষমতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে। অর্থাৎ আমাদের ওপরে মানুষের বিশ্বাস থাকবে।”

এটাই হচ্ছে সিবিআই-এর MOTTO বা উদ্দেশ্য। এই MOTTO-গুলো তিনটে ‘আই’(I) দিয়ে তিনি বর্ণনা করেছিলেন। ‘ইন্ডাস্ট্রি’ (INDUSTRY)-অর্থাৎ প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হবে অফিসারদের, দ্বিতীয়টা ‘ইমপার্সিয়ালিটি’ (Impartiality) অর্থাৎ ‘নিরপেক্ষতা’ আর তৃতীয়টা হচ্ছে ‘ইন্টিগ্রিটি’ (Integrity) অর্থাৎ ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’। কিন্তু এই ‘নিরপেক্ষতা’ ও ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’, সিবিআই-এর আজ যে তলানিতে এসে ঠেকেছে সেটা বোধহয় কোনও প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।

এসব কথা এমন একটা সময়ে উঠে আসছে, যখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এনফোর্সমেন্টের সদর দফতরে সমন দিয়ে ডেকে পাঠানো হচ্ছে। আগে সিবিআইয়ের তদন্তের সঙ্গে এনফোর্সমেন্টের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না কিন্তু পরবর্তীকালে এখন নিয়ম হয়েছে যে, সিবিআইকে যে কোনও তদন্ত করতে গেলে এনফোর্সমেন্টের কাছ থেকেও একটা রিপোর্ট নিতে হয় এবং এনফোর্সমেন্টও যে তদন্ত করে, সে ব্যাপারে সিবিআই-এর সাহায্য নেয়। অর্থাৎ
পরস্পর মিলেজুলে তারা একটা কাজ করবে সেটা ঠিক হয়েছে। এটা তর্কের খাতিরে ভাল প্রস্তাব কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে, সেটা আসল কথা।

আরও পড়ুন : “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক”,. মনোনয়ন জমা দিয়ে লিখলেন দলনেত্রী

মূলত, ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সিবিআইকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার যে সংস্কৃতি সেটা আরও পুরোদমে এগিয়ে যায়। এর মাধ্যমে যে শাসক দল, তারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন অন্য দল, এমনকী নিজের দলের নেতাদেরও রাজনৈতিকভাবে ‘ব্ল্যাকমেল’ করার সংস্কৃতিটা শুরু হয়। প্রথমদিকটাতে একদম তদন্ত করিয়ে দেওয়া, চার্জশিট দেওয়া, গ্রেফতার করা মুড়ি-মুড়কির মতো আজকে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা তখনও হয়নি। কিন্তু ২০১৯-এর সংসদে বাজেট অধিবেশনে যখন বিরোধী পক্ষ, সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে তুলকালাম শুরু করে দেয় তখন কিন্তু একটা উল্টো রথের প্রক্রিয়া প্রথম শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্টে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস ভার্মা, তিনি সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে সুপারিশ করেন যে একটা ‘সিভিসি অ্যাক্ট’ অর্থাৎ সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন আইন হওয়া উচিত। ২০০৩ সালে ‘সিভিসি অ্যাক্ট’ তৈরি হয়, সংসদে তা পাশ হয় এবং সেই সিভিসি অ্যাক্টে দেখা যায় যে, সিবিআইয়ের যে কার্যকলাপ সেটাকে স্বয়ংশাসিত করে অপব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং, ‘সিভিসি’র মাধ্যমে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এরপরে লোকপাল আইনের জন্যও নানা রকমের আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। লোকপালের মাধ্যমে দুর্নীতির আইন করতে হবে এই দাবি ওঠে। লোকপাল চালু হলে প্রধানমন্ত্রীকেও যাতে তার আওতায় নিয়ে আসা হয়, তা নিয়েও আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। সুতরাং, একের পর এক হাই পাওয়ার কমিটি হয়েছে, নানান রকমের সুপারিশ হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সেখানে সুপারিশ করেছে, সিভিসি অ্যাক্ট হয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, ওই যে দিল্লি পুলিশের এস্টাবলিশমেন্ট যে আইন, সেই আইন অনুসারে, সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার যে কার্যকলাপ, তার ওপরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কিন্তু থেকেই গেছে। অতীতে কংগ্রেস শাসনে আমরা এর অপব্যবহার দেখেছি। যোগীন্দর সিং, সিবিআইয়ের প্রধান এবং তিনি তাঁর যে বই, তাতে লিখেছেন, ‘বোফর্স তদন্ত’ তিনি করছিলেন। সেটা করতে গিয়ে তিনি কী রকম বাধা পেয়েছেন। দেবেগৌড়ার পর ইন্দর গুজরাল যখন প্রধানমন্ত্রী হন, যোগীন্দর সিং তখন নিজে কর্নাটকের অফিসার ছিলেন। দেবেগৌড়া নিজেও কর্নাটকের প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
… এরপর আগামিকাল

Latest article