হাসতে এবং হাসাতে কে না ভালবাসে? কথায় বলে, হাসিমুখের জয় সর্বত্র। ভোরের আলোর মতো নির্মল হাসি ছড়িয়ে অনেকেই করেছেন অসাধ্যসাধন। অতীব গম্ভীর মানুষও সারা জীবনে কোনও না কোনও সময় একচিলতে হেসেছেন। কেউ হাসেন কারণে। কেউ বা অকারণে। কেন হাসছেন? জিজ্ঞেস করলে বলেন, পাচ্ছে হাসি, হাসছি তাই!
হাসির রকমফের আছে। কেউ হাসেন সজোরে, প্রাণখুলে। কেউ হাসেন মেপে, ঠোঁট চেপে, নীরবে ছড়িয়ে দেন মুচকি হাসি। কারও হাসি কৃত্রিম, কারও স্বাভাবিক, ভুবনভোলানো। ভুবনভোলানো হাসির কথা উঠলেই ভেসে ওঠে মহানায়ক উত্তমকুমারের মুখ। এমন নির্মল হাসি এখন আর কোথায়?
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতে বিনা লড়াইয়ে জেতা যাবে না : উদয়ন
পাঠকমহলে বরাবর সমাদর পেয়েছে হাস্যরসসমৃদ্ধ সাহিত্য। বাংলার কথা ধরা যাক। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের মাধ্যমে তৎকালীন বঙ্গ-সমাজের প্রকৃত ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রচনাটির পদে পদে ছড়িয়ে রয়েছে হাস্যরস। রবীন্দ্র সাহিত্যের বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে আছে প্রবল হাসির উপকরণ। তিনি লিখেছিলেন কয়েকটি মজার ছোট নাটক। যেগুলো সংকলিত হয়েছে ‘হাস্যকৌতুক’ নামক একটি গ্রন্থে। নাটকগুলো আজও অভিনীত হয়। এর পাশাপাশি তাঁর বেশকিছু ছড়া-কবিতা-গল্পেও মিশে রয়েছে তুমুল হাস্যরস।
রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। হাস্যরস সৃষ্টিতে তিনিও ছিলেন অতুলনীয়। ভুললে চলবে না ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ তাঁর অমর সৃষ্টি। রচনাটির জনপ্রিয়তা আজও অক্ষুণ্ণ, চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে।
যদিও এই বিষয়ে সম্ভবত সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন সুকুমার রায়। ননসেন্স ছড়া-কবিতা-গল্প লিখে তিনি জিতে নিয়েছিলেন আট থেকে আশি বাঙালি পাঠকদের মন। তাঁর ‘আবোল তাবোল’ পড়েননি, এমন শিক্ষিত বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার! ‘সন্দেশ’ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি মেলে ধরেছিলেন নিজেকে। তবে হাস্যরস পরিবেশনের পাশাপাশি তাঁর প্রায় প্রতিটি রচনাই গভীর অর্থ বহন করে।
শরৎচন্দ্রে চট্টোপাধ্যায়ের ‘লালু’, ‘শ্রীকান্ত’সহ একাধিক লেখায় ফুটে উঠেছে বেশকিছু মজাদার মুহূর্ত। অসাধারণ রসিক ছিলেন আর এক শরৎচন্দ্র, দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। যে আসরে যেতেন, মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর লেখনীও ছিল অতি মাত্রায় সরস। নিজের সম্পাদিত ‘বিদূষক’ পত্রিকায় তিনি লিখেছেন অসংখ্য রম্যরচনা।
আরও পড়ুন-বছরের প্রতিটি দিবসই মে দিবস
সাদামাঠা জীবন যাপন ছিল রসসাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর। তিনি কবেই চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’ আজও পাঠকমহলে সমাদৃত।
নানা স্বাদের গল্প লিখেছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে টেনিদাকে নিয়ে লেখা তাঁর মজার মজার গল্পগুলো এককথায় অতুলনীয়। পাঠকমনে ঘটায় হাস্যরসের সঞ্চার। প্রায় একই রকমের হাস্যরস সৃষ্টি করে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদাকে নিয়ে লেখা গল্পগুলো।
সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য সৃষ্টি ফেলুদা। জনপ্রিয় এই গোয়েন্দা কিছুটা যেন আলোনা সঙ্গী জটায়ুকে ছাড়া। জটায়ু ছদ্মনামের আড়ালে আছেন গোয়েন্দা গল্পের লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি। একজন অতীব মজার মানুষ। যাঁর এক একটি কথা পেটে খিল ধরিয়ে দিতে পারে।
তারাপদ রায়, হিমানিশ গোস্বামী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের রচনাও যথেষ্ট সরস।
কী করে ভুলে যাই নারায়ণ দেবনাথের কথা? বাংলা কমিকসের মাধ্যমে তিনি ছড়িয়েছেন প্রবল হাস্যরস। তাঁর সৃষ্ট বাঁটুল, হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে প্রভৃতি মজার চরিত্রগুলো ছোটদের পাশাপাশি আনন্দ দিয়েছে বড়দেরও।
আরও পড়ুন-বছরের প্রতিটি দিবসই মে দিবস
কুমারেশ ঘোষ সম্পাদনা করতেন ‘যষ্টিমধু’। এই পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্ভেজাল হাস্যরস পরিবেশন। একটা সময় দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল পত্রিকাটি।
বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ মনীষী ঘনিষ্ঠ মহলে বিভিন্ন সময় রঙ্গ-রসিকতায় মেতে উঠতেন। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে। তাঁদের রসিকতা নিয়ে বেরিয়েছে বেশ কয়েকটি সংকলন।
সাম্প্রতিক সময়ে ছড়ার মধ্যে দিয়ে নির্ভেজাল হাস্যরস পরিবেশন করেছেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। তাঁর মজার ছড়ার ভক্ত আট থেকে আশি।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কার্টুন এঁকেছেন বহু বিখ্যাত কার্টুনিস্ট। যাঁরা টার্গেট, তাঁরা কিন্তু খুশি মনেই কার্টুনগুলো উপভোগ করেছেন। প্রশংসা করেছেন। কখনও কোনও সমস্যা হয়নি।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ ছিলেন গোপাল ভাঁড়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান এই মানুষটি মজার মজার গল্প বলে রাজসভা মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও, তাঁকে ঘিরে তৈরি প্রচলিত হাস্যরস সমৃদ্ধ গল্পগুলো আজও বিভিন্ন বয়সিরা পাঠ করে আনন্দ পায়। টেলিভিশনে গোপাল ভাঁড়ের গল্প নিয়ে তৈরি ধারাবাহিক নাটক এবং অ্যানিমেশন কার্টুন দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে সিনেমাও।
গানের মাধ্যমেও অনেকেই করেছেন হাস্যরস-সঞ্চার। এইক্ষেত্রে এগিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। পাশাপাশি বহু নাটক বিভিন্ন সময় হাসিয়েছে দর্শকদের। উল্লেখ করা যায় ‘দম্পতি’, ‘সাজানো বাগান’, ‘চলো পটল তুলি’ প্রভৃতি নাটকের নাম।
আরও পড়ুন-বাবুল সুপ্রিয়র শপথে অনুমতি দিলেন রাজ্যপাল
হাস্যরস সৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সিনেমা। প্রথমেই মনে আসে চার্লি চ্যাপলিনের কথা। দর্শকদের হাসাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। যদিও নিছক হাস্যরস পরিবেশন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি তুলে ধরেছেন সমাজের আলো ও অন্ধকার দিক। সারা পৃথিবীতে কম জনপ্রিয় নয় লরেল অ্যান্ড হার্ডি।
এবার আসা যাক বাংলায়। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘দেয়ানেয়া’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘মৌচাক’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘দাদার কীর্তি’ ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ প্রভৃতি সিনেমাগুলো দর্শকদের হাসির ঢেউয়ে যথেষ্ট তোলপাড় করেছে। বিভিন্ন ছবিতে হাসির চরিত্রে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, অনুপকুমার, চিন্ময় রায়, তপেন চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত প্রমুখ। বহু বিখ্যাত নায়ক-নায়িকা তাঁদের রীতিমতো সমীহ করে চলতেন। কমেডি চরিত্রে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দারুণ সাবলীল। বেশ কয়েকটি হাসির ছবিতে তাঁরা অভিনয় করেছেন।
আরও পড়ুন-চোখে জল, বান্ধবীকে বিদায় জানিয়ে বেকার গেলেন জেলে
কম যায় না বলিউডও। ‘গোলমাল’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘আন্দাজ আপনা আপনা’, ‘বাদশা’, ‘হিরো নম্বর ওয়ান’, ‘ইশক’ প্রভৃতি ছবি মূলত কমেডি নির্ভর। দর্শকদের যথেষ্ট আনন্দ দিয়েছে। টেলিভিশনে আজও ছবিগুলো এলে রাম গড়ুড়ের ছানারাও কাজ ফেলে বসে পড়েন। হিন্দি ছবির নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে গোবিন্দা এবং জুহি চাওলার কমিক টাইমিং প্রশংসনীয়।
শুক্রবার, ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিনে আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন এই সময়ের কয়েকজন জনপ্রিয় অভিনেতা। বিষয় ‘সিনেমায় কমেডি কি শুধুই হ-য-ব-র-ল?’ বাংলা আকাদেমি সভাঘরে উপস্থিত দর্শক শ্রোতারা দারুণ এনজয় করেছেন। দিয়েছেন হাততালি, কথার ফাঁকে হেসেছেন প্রাণখুলে। প্রত্যেকেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, সিনেমায় কমেডির গুরুত্ব অপরিসীম।
বেশকিছু মজার ধারাবাহিক এবং কার্টুন সম্প্রচারিত হচ্ছে ছোট পর্দায়। পাশাপাশি পরিবেশিত হচ্ছে দ্য কপিল শর্মা শো, দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জার, মীরাক্কেল প্রভৃতি জনপ্রিয় কমেডি শো। তুমুল হাসির অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আজ ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছেন কপিল শর্মা, রাজু শ্রীবাস্তব, সুনীল পাল থেকে শুরু করে বাংলার মীর।
আরও পড়ুন-বিতর্কিত হারে বিদায় সিন্ধুর
এত হাসির রদস থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ এখন নানা কারণে হাসতে ভুলে যাচ্ছেন। অনেকেই হাসতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। তাঁরা হুড়মুড়িয়ে নাম লেখাচ্ছেন শহরে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন লাফিং ক্লাবে। সেখানে গিয়ে তাঁরা হাসছেন। আবার তাঁদের হাসি দেখে দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন অনেকেই।
হাসির জন্য একটি বিশেষ দিন নির্ধারিত হয়েছে। মে মাসের প্রথম রবিবারটিকে ধরা হয় ‘বিশ্ব হাস্য দিবস’। ১৯৯৮ সালে মুম্বইয়ে ডাঃ মদন কটারিয়া এই বিশ্ব হাস্য দিবসের সূচনা করেন। এখন দিনটি উদযাপিত হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। এ বছর পালিত হচ্ছে ১ মে।
তবে কোনও একটি বিশেষ দিন নয়, আমাদের প্রাণখুলে হাসতে হবে প্রত্যেকদিন। মনে রাখতে হবে, হাসলে শরীর এবং মন দুই-ই ভাল থাকে।