যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি…

সুর, তাল, লয়ের দুনিয়ায় বিমোহিত আপামর বিশ্ব। দেশ কালের গণ্ডি আটকাতে পারেনি সঙ্গীতের মূর্ছনা। ভাষা হতে পারেনি অন্তরায়। প্রেম ও বিপ্লবকে মিলিয়ে দিয়েছে সঙ্গীত। দ্বেষ ভুলিয়ে দেশকে করেছে সংঘবদ্ধ। একমাত্র সঙ্গীতই হয়তো পারে গোটা বিশ্বকে এক তালে আন্দোলিত করতে। ২১ জুন ছিল বিশ্ব সঙ্গীত দিবস। সেই উপলক্ষে ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসকে স্মরণ করলেন শামিম আহমেদ

Must read

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎপত্তি বৈদিক যুগে। এই সময়ে ‘নাদব্রহ্ম’ নামক ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাকে শব্দব্রহ্মও বলে। ভারতীয় ঋষিরা ‘নাদব্রহ্ম’ বা ‘অনাহত শব্দ’-র কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম শব্দটির অর্থ হল ‘অতীন্দ্রিয় ধ্বনি’ বা ‘ধ্বনি কম্পন’ বা ‘বেদের অতীন্দ্রিয় ধ্বনি’ বা ‘বৈদিক শাস্ত্রের অতীন্দ্রিয় ধ্বনি’।

আরও পড়ুন-অসমে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৭, ক্ষতিগ্রস্ত ৪ লক্ষ

ছ’হাজার বছর আগে বৈদিক শাস্ত্রে স্বরলিপি বা মিউজিক্যাল নোটের সঙ্গে মন্ত্র এবং বাদ্যযন্ত্রের সুরের একটি তন্ত্র বা সিস্টেম পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রন্থ সামবেদ হল সংহত সঙ্গীতবিশিষ্ট, সুর দিয়ে তার গানগুলি রচিত। সামবেদকে সঙ্গীতের বেদ বলা হয়, ভারতীয় সঙ্গীতের মূল ভিত্তি বলে মনে করা হয়। সামবেদে ঋগ্বেদের স্তোত্র রয়েছে যা সুরারোপিত। বৈদিক যজ্ঞের সময় তিন থেকে সাতটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে এই স্তোত্রগুলি গাওয়া হত। ঋগ্বেদ সঙ্গীতের ছন্দকেও গ্রন্থিত করেছে। বিশ্বাস করা হয় যে, সামবেদ থেকে প্রাচীনতম রাগের উদ্ভব হয়েছিল। বৈদিক যুগের শেষভাগে সঙ্গীত ছিল বিশুদ্ধভাবে সুরারোপিত মন্ত্রোচ্চারণ।
প্রাচীনকালে সঙ্গীতের দুটি ধারা প্রচলিত ছিল : গান্ধর্ব ও গান। গান্ধর্ব ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে রচিত সঙ্গীত। এই সঙ্গীত স্বর্গীয় এবং ঐশ্বরিক বিবেচিত হত। গান ছিল বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের জন্য অনানুষ্ঠানিক ও উন্নত মানের সঙ্গীত। সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘প্রবন্ধসঙ্গীত’ দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বাস করা হয় যে, ধ্রুপদ বা ধ্রুবপদের রূপটি প্রবন্ধসঙ্গীত থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ধ্রুবপদকে ধুরপদ বা ধ্রুপদ বলার হেতু হল— এটি চার তুকের বা কলির গীতবিশেষ। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা— এই তিন রীতির মধ্যে ধ্রুপদ প্রাচীনতম। এর রচনা বিস্তৃত এবং এটি যে চারটি কলি বা তুকে বিভক্ত তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে— আস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ। পাখোয়াজে যেসব তাল বাজানো হয়, সেসব তালে (চৌতাল, ধামার, সুরফাক, ঝাঁপতাল ইত্যাদিতে) ধ্রুপদ গাওয়া হয়। এ জাতীয় গানের মধ্যে কোনও প্রকার চাঞ্চল্য থাকে না। ধ্রুপদকে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সবচেয়ে অভিজাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আরও পড়ুন-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে স্কুলে ছাত্র! আতঙ্কিত অন্য পড়ুয়ারা

ভারতীয় সঙ্গীতের প্রথম উল্লেখটি পাওয়া যাচ্ছে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই উল্লেখ করেছেন বৈয়াকরণ পাণিনি। সঙ্গীত তত্ত্বের এই প্রথম উল্লেখ্য গ্রন্থটি হল ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত ‘ঋক্ প্রাতিশাখ্য’। ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্র আর একটি গ্রন্থ, যা অসংখ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্য ঐতিহ্যের ভিত্তি। নাট্যশাস্ত্র ছিল লিখিত আকারে প্রথম সঙ্গীতমূলক রচনা, যা সঙ্গীতকে স্বরাষ্টক ও ২২-টি কুঞ্জিকা (key)-য় বিভক্ত করেছিল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন গ্রন্থ হল ‘দত্তিলম্’। এটি রচনা করেন দত্তিল মুনি। এখানে প্রতি অষ্টকে ২২-টি শ্রুতির কথা বলেছে। দত্তিলম্ ভরতের নাট্যশাস্ত্রের কিছু কাল পরে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। খুব সম্ভবত এই গ্রন্থটি খ্রিস্টীয় ১ম ও ৪র্থ শতাব্দীর মধ্যে লিখিত। ভরত মুনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে দত্তিলম্-এর উল্লেখ করেন। সে জন্য কেউ কেউ মনে করেন, দত্তিলম্ ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের আগে রচিত। দত্তিলম্ ২৪৪-টি শ্লোকে লিখিত। খামাজ, গৌড়, মুলতানি, জৌনপুরী রাগের উল্লেখ আছে এখানে। এটি গান্ধর্ব সঙ্গীত নামে পরিচিত। গান্ধর্ব-র উল্লেখ আছে মহাভারতেও। তবে সেখানে ‘সঙ্গীত’ শব্দের উল্লেখ নেই। টীকাকাররা বলেন, ‘গান্ধর্ব’ শব্দে সঙ্গীতবিদ্যাকে প্রকাশ করা হয়েছে। নারদ, অতিবাহু, হাহা, হূহূ এবং তুম্বরু ছিলেন সঙ্গীতাচার্য। তাঁরা সকলেই কশ্যপজায়া কপিলার সন্তান। অর্জুন গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে নৃত্য-গীত, বাদিত্র শিক্ষা করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণও এই বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। কচের সঙ্গীতবিদ্যায় মুগ্ধ হয়েছিলেন দেবযানী। উত্তরা, দেবযানী, মাধবী সুগায়িকা ছিলেন। এছাড়া অপ্সরাদের নাচগান সুবিদিত। বিয়ের আসরে নাচগান ও বাজনার আতিশয্য ছিল। পরীক্ষিতের জন্মদিনে নাচগান হয়েছিল খুব। এছাড়া যাগযজ্ঞে সঙ্গীতের আদর ছিল। সঙ্গীতজ্ঞরা রাজসভায় সমাদর পেতেন। মহাভারতের সময়ে শঙ্খ, মৃদঙ্গ, বাঁশি, বীণা, পণব, ঝল্লীষক প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। হরিবংশের বিষ্ণুপর্বে ছালিক্য গানের কথা আছে। বীণা, ঝল্লীষক, বাঁশি, মৃদঙ্গ প্রভৃতি যন্ত্রযোগে পাঁচজন গান্ধর্ববিৎ একত্রিত হয়ে যে বৈঠকী গান করেন, তাই ছালিক্য গান। মহাভারতে সপ্ত স্বরের কথা আছে— ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, ধৈবত, পঞ্চম এবং নিষাদ। স্বর শব্দবিশেষ, মহাভারতকার বলছেন, তাই তার উৎপত্তি ব্যোম থেকে।

আরও পড়ুন-ফের মার্কিন মুলুকে বন্দুকবাজের হামলা, মৃত একাধিক

প্রাচীন ভারতের উল্লেখযোগ্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ লিখিত রচনা হল মতঙ্গ মুনির বৃহদ্দেশী, নবম শতাব্দীতে রচিত, এখানে মতঙ্গ ৯৩-টি রাগের বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে নারদ রচিত রাগ এবং সঙ্গীত মকরন্দকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন মতঙ্গ মুনি। সঙ্গীত মকরন্দের রাগগুলিকে স্ত্রীলিঙ্গ এবং পুংলিঙ্গ এই দুই বিভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল।
এই নারদ বৈদিক বা পৌরাণিক নারদ নন, ইনি কল্পান্তরের সঙ্গীতজ্ঞ নারদ। আদি কল্প শেষ হলে পিতামহ ব্রহ্মা পুনরায় সৃষ্টিকার্য আরম্ভ করেন, তখন দ্বিতীয় নারদ জন্মগ্রহণ করেন। এই নারদ ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ, বীণাবাদনে পারদর্শী। শাস্ত্রমতে নারদ সব সময় বিভিন্ন রাগ-রাগিণী যুক্ত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। কিন্তু প্রত্যেক সময়েই তাঁর সঙ্গীতে কিছু না কিছু ভুলত্রুটি থেকে যেত। নারদ এই ত্রুটিগুলো নিজে বুঝতে পারতেন না। ভাবতেন তাঁর মতো গাইয়ে আর কেউ নেই। নারদ তাঁর নিজের সঙ্গীত নিয়ে খুব অহঙ্কার করতেন। নারদের এই গর্বকে খর্ব করার জন্য একবার রাগ-রাগিণীরা বিকলাঙ্গ নর-নারীর রূপ ধরে জন্মগ্রহণ করে নারদের যাত্রা পথে উপস্থিত হলেন। নারদ এই বিষয় অবহিত ছিলেন না। তিনি বিকলাঙ্গ পুরুষনারীরূপী রাগ-রাগিণীকে তাঁদের বিকলাঙ্গের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তাঁরা বললেন যে, তাঁরা নারদের বিকৃত সঙ্গীতে এই দশাপ্রাপ্ত হয়েছেন। নারদ সে কথা শুনে তাঁদের বিশুদ্ধ সঙ্গীত পরিবেশনের উপায় জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে তাঁরা বললেন, মহাদেবের গান শুনলে তাঁদের বিকল ভাব দূর হবে। নারদ তখন মহাদেবকে সঙ্গীত শোনানোর আবেদন জানালেন। মহাদেব বললেন, উপযুক্ত শ্রোতা ছাড়া তিনি গান গাইবেন না। পরে অবশ্য মহাদেবই তাঁকে শ্রোতা খুঁজে আনার পরামর্শ দিলেন। সেই অনুসারে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু-কে অনুরোধ করে গানের আসরে নিয়ে আসেন নারদ। মহাদেবের গান শোনার পর রাগ-রাগিণীরা উত্তমাঙ্গ হন। কিন্তু সমস্যা হল, এই সঙ্গীতের মর্ম ব্রহ্মা একেবারেই বুঝতে পারলেন না। তবে বিষ্ণু কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি আংশিক দ্রবীভূত হন। বিষ্ণুর এই দ্রবীভূত অংশ ব্রহ্মা তাঁর কমণ্ডলুতে ধারণ করেন। বিষ্ণুর দ্রবীভূত অংশই ‘গঙ্গা’ নামে খ্যাত হয়। নারদের সঙ্গীতের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ দেখে বিষ্ণু উলুকেশ্বর নামক এক গন্ধর্বের কাছে তাঁকে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য পাঠান। প্রাচীন সঙ্গীত শাস্ত্রে বর্ণিত তিনিই নাকি গান্ধার গ্রাম সৃষ্টি করেছিলেন।
ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতির একটি পারিভাষিক শব্দ হল ‘গ্রাম’। প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতে সাতটি স্বরের সমাহারকে গ্রাম হিসাবে বিবেচনা করা হত। এর প্রকৃতি অনেকটা এই কালের মেল বা ঠাটের মতো। মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে গ্রামকে সর্বলোকের উপযোগী বিবেচনা করে বলেছেন—
সমূহবাচিনৌ গ্রামৌ স্বর-শ্রুত্যাদিসংযুতৌ।
যথা কুটুম্বিনঃ সর্ব একীভূতা বসন্তী হি।
সর্বলোকস্য স গ্রামো যত্র নিত্যং ব্যবস্থিতিঃ॥
অর্থাৎ সর্বলোকের রীতি অনুসারে কোন গ্রামে গৃহস্থ যেমন সর্বদাই তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একত্রে বসবাস করে তেমনি সঙ্গীতেও স্বর-শ্রুতি ইত্যাদির সমন্বয়কে গ্রাম বলে।

আরও পড়ুন-প্রচারে শোনা সমস্যার সমাধান হবে আগে : সায়নী

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে রচিত হয়েছিল লোককাহিনি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের সমন্বয়ে মহাকাব্য ‘রামায়ণ’। রামায়ণের যুগে সামগানের প্রচলন ছিল। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের ২৮-তম সর্গের ৫৪তম শ্লোকে সামগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। উত্তরকাণ্ডের ১৬-তম সর্গের ৩৩-৩৪ তম শ্লোকে অনার্য (রাক্ষস) মহাদেবের স্তুতি করেছেন সামগানের দ্বারা। বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডের চতুর্থ সর্গে উল্লেখ আছে, বাল্মীকি রামের দুই পুত্র কুশী (কুশ) ও লবকে রাম-সীতার চরিত্রসহ রাবণ-বধ নামক কাব্য শেখান। কুশীলব এই কাব্য পাঠ ও গান হিসেবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এ-বিষয়ে রামায়ণে বলা আছে— এই পাঠ ও গান মধুর, দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিতরূপে ত্রিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়্জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত, বীণালয় বিশুদ্ধ এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি সমুদয়-রসসংযুক্ত। স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লব তাহা গাইতে লাগিলেন।
রামায়ণের পাঠ থেকে জানা যায়, গ্রাম থেকে মূর্ছনার উদ্ভব হয়েছিল এই সময়ে। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নারদ ‘শিক্ষা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে বৈদিক গান থেকে শুরু করে গান্ধর্ব গানের প্রাথমিক বিকাশের রূপরেখা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের তৃতীয় কণ্ডিকায় বলা হয়েছে—
‘ষড়্জমধ্যমগান্ধারাস্ত্রয়ী গ্রামাঃ প্রকীতর্তিতা।
ভূলোকজ্জায়তে ষড়্জো ভূবর্লোকচ্চা মধ্যমঃ ৬
সর্গান্ননাত্র গান্ধারো নারদস্য মতং যথা।
স্বররাগবিশেষণ গ্রামরাগো ইতি স্মৃতাঃ। ৭’
নারদের সময়ে প্রচলিত তিনটি গ্রাম ছিল ষড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম। নারদ এই সকল রাগ সম্পর্কে লিখেছিলেন, পৃথিবীতে ষড়্জগ্রাম, ভুর্বলোকে মধ্যমগ্রাম এবং স্বর্গলোকে গান্ধার গ্রাম প্রচলিত ছিল। নারদ যদিও ষড়্জ, মধ্যম ও গান্ধার গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সে সময়ে গান্ধার গ্রামের প্রচলন ছিল না বলেই মনে হয়। তবে গান্ধার গ্রাম সম্পর্কে নারদ বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন। নারদীয় সঙ্গীতশিক্ষায় ৭-টি গ্রামরাগের কথা পাওয়া যায়। এগুলো হল— ষড়্জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিক মধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত ও ষাড়ব। এগুলোর উদ্ভব হয়েছিল গ্রাম থেকে।

আরও পড়ুন-আমেরিকার বিজ্ঞান সম্মেলনে ডাক পেল বাঁকুড়ার অয়ন

গ্রাম সম্পর্কে প্রথম বিস্তৃত তথ্যসমূহ পাওয়া যায় ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে দুটি গ্রামের উল্লেখ আছে। এই গ্রাম দুটি হল— ষড়্জ গ্রাম ও মধ্যম গ্রাম— দ্বৌগ্রামৌ ষড়্জোমধ্যমশ্চেতি। এই গ্রন্থে ৭-টি শুদ্ধ স্বরকে (স র গ ম প ধ ন) ২২-টি শ্রুতিতে স্থাপন করা হয়েছিল। নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাদশ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে— ষড়্জ চার শ্রুতি, ঋষভ তিন শ্রুতি, গান্ধার দুই শ্রুতি, মধ্যম চার শ্রুতি, পঞ্চম চার শ্রুতি ধৈবত ৩ শ্রুতি এবং নিষাদ ২ শ্রুতি। স্বরসপ্তকের প্রথম ষড়্জ স্থাপিত হয়েছিল প্রথম তিন শ্রুতি বাদ দিয়ে। একইভাবে অন্য ছয়টি স্বর একই ভাবে সূত্রানুসারে শ্রুতিগুলোতে স্থাপিত হয়েছিল।
ভারতের আদি বা প্রাথমিক সঙ্গীতকে দুটি শিরোনামে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে— ধর্মীয় সঙ্গীত বা বৈদিক সঙ্গীত এবং ধর্মনিরপেক্ষ সঙ্গীত বা লৌকিক সঙ্গীত। বৈদিক সঙ্গীত বা ধর্মীয় সঙ্গীত তার নামের প্রতি সুবিচার করে একচেটিয়াভাবে ধর্মীয় ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ সঙ্গীত, যাকে লৌকিক বলা হত, তা হল দুই ধরনের : গান্ধর্ব লৌকিক এবং দেশি লৌকিক। সঙ্গীতের গান্ধর্ব লৌকিক ঐতিহ্য ছিল তথাকথিত মার্গ সঙ্গীত, এবং দেশি লৌকিক ঐতিহ্য ছিল তথাকথিত দেশি সঙ্গীত।
ভূগন্ধর্ব শ্রেণির লোকেরা মন্দিরে মার্গ সঙ্গীত চর্চা করত। দেশি সঙ্গীত ছিল প্রাচীন যুগের মন্দির-বহির্ভূত সঙ্গীত। এটি বিভিন্ন দিক থেকে মার্গ সঙ্গীত থেকে পৃথক। মার্গ সঙ্গীত গন্ধর্ব বা অন্যদের তত্ত্বাবধানে গন্ধর্বদের দ্বারা চর্চা করা হত যাঁরা শিল্পকলায় চূড়ান্ত রকমের পারদর্শী ছিলেন।
গন্ধর্বদের তিনটি শ্রেণি ছিল :
ভরত সম্প্রদায় : নাট্য পরিচালকগণ
নারদ সম্প্রদায় : সঙ্গীত পরিচালকগণ
তণ্ডু সম্প্রদায় : নৃত্য পরিচালকগণ
অন্যদিকে, দেশি সঙ্গীত চর্চা করতেন সাধারণ মানুষ। মার্গ সঙ্গীত ছিল মন্দিরের সঙ্গীত বা বিধিবদ্ধ পারফরম্যান্সের সঙ্গীত আর দেশি সঙ্গীত ছিল মন্দির বা পরিবেশনার স্থানের বাইরের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তার বিধিনিষেধে কড়াকড়ি ছিল না।
মার্গ সঙ্গীতের গানের ফর্ম, সুর কঠোর ছিল, ছন্দের নিয়ম এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ব্যাকরণগত নিয়ম ছিল। দেশি সঙ্গীত প্রাথমিকভাবে এই ধরনের নিয়ম থেকে মুক্ত ছিল কিন্তু পরে অনেকাংশে গান্ধর্ব নিয়মের কাঠামোর আওতায় আসে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নয়। গন্ধর্ব-প্রভাবিত দেশি সঙ্গীত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়। দেশি সঙ্গীতে সাধারণত মার্গ সঙ্গীতের সীমাবদ্ধতা ছিল না। মার্গ সঙ্গীত দু-ধরনের সুরের কাঠামো বা অন্তর্নিহিত যুক্তির উপর ভিত্তি করে :
জাতি : ভরত সম্প্রদায় দ্বারা চর্চা করা হয়।
রাগ : নারদ সম্প্রদায় দ্বারা অনুশীলন করা হয়।

আরও পড়ুন-আমেরিকার বিজ্ঞান সম্মেলনে ডাক পেল বাঁকুড়ার অয়ন

মার্গ সঙ্গীত হল মোক্ষের পথ খোঁজার জন্য সঙ্গীতের ব্যবহার। মোক্ষ কী? মোক্ষ হল মুক্তি। দুঃখ থেকে মুক্তি। দুঃখ কী? দুঃখ হল রজোগুণের পরিণাম। দুঃখ তিন রকমের— আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ হল শারীরিক ও মানসিক। আধিভৌতিক দুঃখ মানুষ, পশু, পাখি ও স্থাবরাদি ভূত পদার্থ হতে উৎপন্ন হয়। আধিদৈবিক দুঃখ যক্ষ রাক্ষসাদি দেবযোনির আবেশ নিবন্ধন উৎপন্ন হয়।
এই তিনপ্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের সহজ এবং দৃষ্ট উপায়ের মধ্যে একটি হল গান। সঙ্গীত। নাস্তিক চূড়ামণি মহর্ষি কপিল এই কথা বলে গিয়েছেন।

Latest article