বঞ্চনা যেন বাংলার (West Bengal) ললাটলিখন। বারবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে তার প্রতিবাদ করতে, বাংলার ন্যায্য পাওনা দাবির কারণে দিল্লিতে পাড়ি জমাতে হয়। প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়। অন্যান্য রাজ্যের মতো ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমবাংলাও একটি রাজ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের শর্তধারায় তা প্রমাণিত হয় না। অঙ্গরাজ্য হিসাবে রাজ্যের যে সাংবিধানিক অধিকার আছে, পাওনা আছে তা প্রায় সব সময় অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে রাজ্যের উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাজ্যের হকের টাকা থেকে রাজ্য বঞ্চিত হচ্ছে। জিএসটি নিয়ে বহুদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। কর আদায়ের এটি একটি নতুন ব্যবস্থা। সাংবিধানিক ভাবে যেসব পদ্ধতিতে কর আদায় করা যায় সেগুলো সব প্রায় বন্ধ করে এটি চালু হয় দীর্ঘ আলোচনা করার পর। জিএসটি কাউন্সিলের নিয়মিত সভা হয়। কিন্তু যে অর্থ করবাবদ আদায় হয়েছে তার মধ্য থেকেই রাজ্যের প্রাপ্য হিসাবে ১৭ হাজার কোটি টাকা এখন পশ্চিমবাংলার প্রাপ্য। পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সাংসদেরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। কোনও ফল হয়নি।
পশ্চিমবাংলার (West Bengal) জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলি সারা বিশ্বের সমাজতাত্ত্বিকদের নজর কেড়েছে। এ-রাজ্যের শিল্পনীতি, কন্যাশ্রী প্রকল্প, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধু প্রকল্পগুলি গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে অনেক ছাত্র-ছাত্রী এই কাজে যুক্ত আছেন। সারা পৃথিবী জুড়ে লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন এ-রাজ্যের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প আলোচকদের নজর কাড়ছে। কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি অভিযান। এই সমস্ত প্রকল্পের সাফল্য ও জনভিত্তি বিচার করে বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পশ্চিমবাংলা প্রাপ্ত হয়েছে।
কিন্তু প্রত্যেকটা প্রকল্পের পিছনে বহু টাকার সংস্থান করতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক বঞ্চনার ফলে জনমুখী প্রকল্পগুলির সামনে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যদিও পশ্চিমবাংলার সরকার ও তার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এ-ব্যাপারে সজাগ। আর্থিক বঞ্চনা সত্ত্বেও প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যাবেনও।
গ্রামীণ মানুষকে আর্থিক সুরক্ষা ও স্থিতাবস্থা দেবার অন্যতম প্রকল্প মাহাত্মা গান্ধী নামাঙ্কিত ১০০ দিনের কাজ-প্রকল্প। আজকের প্রধানমন্ত্রী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি এই প্রকল্পের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রকল্পটি বন্ধ করেননি। তবে প্রতি বছর বাজেটে অর্থবরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রকল্প সম্পাদনে পশ্চিমবাংলা একাধিকবার দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে। এই প্রকল্প ‘মনরেগা’-তে সাধারণ গরিব মানুষের উপকার হয়। এই বাবদে প্রায় ১৭ লক্ষ ৯৯৬ কোটি টাকা বকেয়া আছে। রাজ্যে এখন এই প্রকল্প চালানো খুবই মুশকিল। যদিও মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন— কেন্দ্রীয় সরকার টাকা না দিলেও প্রকল্প চলবে। এ-বছর, ২০২২ সালে ১২ মে ও ৯ জুন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে রাজ্যের পাওনার ব্যাপারে বিস্তারিত চিঠি লেখেন। তাঁদের কোনও হেলদোল নেই। শেষ পর্যন্ত রাজ্যের স্বার্থে, পাওনাগন্ডা আদায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ও গ্রামীণ সড়ক যোজনাতে বাংলার কাজ কেন্দ্রের পরিদর্শকদল এবং সিএজি রিপোর্ট উভয় জায়গাতে প্রশংসিত হয়েছে। দুটো ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের পাওনা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। গ্রামীণ এলাকায় গরিব মানুষের ঘর তৈরি, পাহাড় এলাকায় ঘর তৈরিতে পশ্চিমবাংলা যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়েছে। পশ্চিমবাংলার পুরস্কার পাওয়া উচিত। তা না হয়ে পশ্চিমবাংলার টাকা আটকে রেখে যেন ‘শাস্তি’ দেওয়া হচ্ছে।
সারা বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শেষ নেই। কখনও আমফান, কখনও ইয়াস অথবা কখনও বুলবুল। প্রত্যেকটা দুর্যোগেই পশ্চিমবাংলার ক্ষয়ক্ষতি সীমাহীন। আমফানের ক্ষয়ক্ষতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেখতে এসেছিলেন। ১০০০ কোটি টাকার ঘোষণা করেছিলেন। সেটা অবশ্য অনুদান ছিল না। কিন্তু সেই দুর্যোগ বাবদ রাজ্যের ৩২ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য হয়ে আছে। বুলবুল, ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া। সুতরাং এই খাতেই ৪২ হাজার কোটি টাকা পাওনা। মুখ্যমন্ত্রীর আগের দুটি চিঠির উল্লেখ করেছি। তা-ছাড়া বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: কেবিন ক্রু বিমানপথে আতিথেয়তার পেশা
‘মনরেগা’— গ্রামীণ আবাস যোজনার বকেয়া টাকা তাড়াতাড়ি দেবার জন্য সাংসদেরা দেখা করেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে। বলেছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দেবেন। ১ মাস পরে যা উত্তর দিয়েছেন তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। টাকা আসেনি। বঞ্চনা চলছে।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান, কেলেঘাই-কপালেশ্বরী প্রকল্পের জন্যও কেন্দ্রের শত শত কোটি টাকা আটকে আছে। কেন্দ্রের সমস্ত নির্দেশিকা মেনেই রাজ্য কাজ করেছে। তবুও কেন রাজ্যকে বঞ্চনা করা হচ্ছে সে-প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকী মিড-ডে মিল ও খাদ্য-ভরতুকি প্রকল্পে প্রাপ্য টাকাও আটকে রাখা হয়েছে।
অনেক প্রকল্পে রাজ্যের টাকা বেশি। প্রকল্পের নাম দেয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্র সেটা মানবে না। গুজরাত হলে মানবে। অন্য বিজেপি-শাসিত রাজ্য হলে মানবে। এটাও পশ্চিমবাংলার প্রতি বঞ্চনা।
আসলে বঞ্চনাটি যতখানি না অর্থনৈতিক, তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে এমন প্রচারে মত্ত হলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে, যে নিত্যযাত্রী হলেন বাংলায়। শেষকালে তিনি সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন। জিতলেন বাংলার (West Bengal) মানুষ। তৃতীয় বারের অন্য রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে শপথ নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই জ্বালাটা প্রধানমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় সরকারের কেউ সহ্য করতে পারছেন না। পিছনের দরজা দিয়ে বাংলাকে একটা ‘শিক্ষা’ দেবার চেষ্টা চলছে। তাই এমন নিষ্ঠুর বঞ্চনা। বাংলার মানুষ মাথা নত করে এসব মেনে নেবার পাত্র নয়। ভবিষ্যৎই তা প্রমাণ করবে।