অংশুমান চক্রবর্তী: ১৯৬২-র ১০ জুন। প্রথমবার গ্রন্থাকারে সামনে আসে শংকরের ‘চৌরঙ্গী’। তার আগে ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। নিন্দা-প্রশংসা দুই-ই জুটেছে শুরুতে। তবে লেখা চালিয়ে গেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই লেখক দূর করতে সক্ষম হয়েছেন ‘ওয়ান বুক অথর’ দুর্নাম। ধীরে ধীরে উপন্যাসটি উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে পাঠকমহলে।
দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে পরের মাসে, জুলাই ১৯৬২। তৃতীয় এবং চতুর্থ সংস্করণ যথাক্রমে ওই বছর সেপ্টেম্বর এবং নভেম্বরে। অর্থাৎ পাঁচ মাসের মধ্যে চারটি সংস্করণ। তারপর প্রায় প্রতি বছর, নিয়ম করে একাধিকবার। প্রথম প্রকাশক ছিল বাক্। রজতজয়ন্তী সংস্করণ ছিল তাঁদের শেষ সংস্করণ। ১৯৭৮ সালে। তারপর প্রকাশনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় দে’জ পাবলিশিং। জুলাই ১৯৭৯-এ।
আরও পড়ুন-লেখক নন, কবিও নন, অন্য রবীন্দ্র
এইবছর, জুন ২০২২-এ প্রকাশিত হয়েছে ১২৫তম সংস্করণ। এর মধ্যে ‘চৌরঙ্গী’ পার করেছে একটি মাইলস্টোন। প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর। তাই ১২৫তম সংস্করণটি দে’জ প্রকাশ করেছে বিশেষ সংস্করণ হিসেবে। দাম ৪০০ টাকা। কীভাবে লেখা হয়েছে কালজয়ী উপন্যাসটি, স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন সাহিত্যিক শংকর। সামনে এসেছে বহু অজানা তথ্য।
৬ দশক ধরে একটি উপন্যাস জয় করে চলেছে পাঠকমন। এ বড় কম কথা নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর পাঠক। বইটির বিন্দুমাত্র কদর কমেনি ডিজিটাল যুগেও। বাঙালিরা তো পড়ছেনই। পাশাপাশি পড়ছেন অন্যান্য ভাষার সাহিত্যপ্রেমীরাও। বিভিন্ন সময় অনূদিত হয়েছে হিন্দি, গুজরাতি, মালায়ালম, ওড়িয়া ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় এবং ইংরেজি, রুশ, ফরাসি, ইতালীয়, স্প্যানিশ, চাইনিজ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ভাষায়। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিদেশিনী বইটি নিয়ে সুবৃহৎ আলোচনা করেছেন একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায়। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে এই উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলা শিক্ষা করেছেন বিদেশিরা। উপন্যাসটি পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা।
আরও পড়ুন-শতবার্ষিক-স্মরণ পরিচালক অসিত সেন
কী আছে ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসে? প্রেক্ষাপট ১৯৫০-এর দশক। কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চল। একটি অভিজাত হোটেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাহিনি। হোটেলের নাম শাজাহান। এই হোটেলে আছে কলকাতার বেশকিছু নামী হোটেলের ছায়া। কর্মচারী, বিনোদনকর্মী এবং অতিথিরা আছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। উপন্যাসে আছেন একজন কথক। তাঁর বিবরণেই এগিয়েছে কাহিনি। তিনি হতদরিদ্র মানুষ। ঝুলিতে নানারকম টুকরো টুকরো কাজের অভিজ্ঞতা। শেষমেশ এক বন্ধুর দয়ায় শাজাহান হোটেলে চাকরি। টাইপিস্ট হিসেবে।
এই হোটেলের চিফ রিসেপশনিস্ট সত্যসুন্দর বোস বা ‘কপালগুণে’ স্যাটা বোস। অল্প সময়ের মধ্যে প্রাণবন্ত মানুষটির সঙ্গে কথকের গভীর বন্ধুত্ব জমে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যেই কথক হয়ে ওঠেন স্যাটা বোসের প্রধান সহকারী।
আরও পড়ুন-হিটলারের প্রেমকাহিনি
উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য, এই দুই চরিত্রের পাশে বাকি চরিত্রগুলোকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঝলমলে আলোর রোশনাই। তার পিছনেই লুকিয়ে গাঢ় অন্ধকার। কারণে অকারণে তথাকথিত উচ্চবিত্তরা কতটা নিচে নামতে পারেন, দেখিয়েছে উপন্যাসটি। আছে আলোকালো ঘটনার ঘনঘটা। প্রেম, যৌনতা, ঈর্ষা ইত্যাদি। পড়তে পড়তে মনে হয় আজও সমকালীন। আজও এর অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারেন না কেউ।
কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক সিনেমা। পিনাকিভূষণ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে স্যাটা বোসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার। ছিলেন সুপ্রিয়া, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জনা ভৌমিক। কয়েকবছর আগে চৌরঙ্গী অবলম্বনে ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ বানিয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। হয়েছে থিয়েটারও।
৬০ বছর। ১২৫ সংস্করণ। আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসলটি আগামীদিনে পেরোবে আরও অনেক মাইলস্টোন, এই বিশ্বাস সমগ্র পাঠককুলের।