কৃত্রিম উপগ্রহের অবদান

জানেন কি গোটা মহাকাশ জুড়ে রয়েছে প্রায় দশ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ! নিজের কক্ষপথে থেকে যারা কিনা প্রতিনিয়ত আমাদের কোনও না কোনওভাবে সাহায্য করে চলেছে। কৃত্রিম উপগ্রহের সেই অকৃত্রিম অবদান নিয়ে লিখলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমসফিয়ারিক সায়েন্সের অতিথি অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ড. রামকৃষ্ণ দত্ত

Must read

বর্তমানকালে প্রযুক্তি-নির্ভর কর্মকাণ্ড ও জীবনযাত্রা বিশ্বায়নের মাত্রা পেয়েছে কৃত্রিম উপগ্রহের হাত ধরে। বলা ভাল ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উপগ্রহ প্রযুক্তি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দৈনন্দিন জীবন ও কর্মজীবনে সহায়তা করে যাচ্ছে। প্রথম পৃথিবীর কৃত্রিম উপগ্রহের নাম স্পুটনিক ১, দেশ রাশিয়া, কক্ষপথে অবস্থান ৪ অক্টোবর ১৯৫৭। বর্তমানে উপগ্রহসংখ্যা ১০০০০-এর কাছাকাছি।

আরও পড়ুন-চ্যাপলিনের মোমের মূর্তি

উপগ্রহের কক্ষপথ
প্রয়োজন অনুযায়ী মোটামুটি ভূসমতল থেকে চার রকম (উচ্চতায়) কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহকে অবস্থান করানো হয়। নিম্ন কক্ষপথ, মধ্যম কক্ষপথ, ভুসমলয় কক্ষপথ ও অতি-উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথ। সকলেই প্রচণ্ড গতিবেগে (অতি-উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথ ছাড়া) মোটামুটি বৃত্তাকারে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে বিভিন্ন অভিমুখে। গতিপথে যেখানে উচ্চতা কম সেখানে গতিবেগ বেশি (কেপলার সূত্র)। প্রতিটি উপগ্রহের উচ্চতা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের জন্য কমতে থাকে। বুস্টার মোটর চালিয়ে আবার নির্ধারিত উচ্চতায় আনা হয়। অফুরন্ত জ্বালানি উপগ্রহে থাকে না, তাই জ্বালানি ফুরিয়ে গেলেই কৃত্রিম উপগ্রহের কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। একসময় উচ্চতা কমতে কমতে বায়ুমণ্ডলে ঘর্ষণের ফলে উপগ্রহটি ভস্মে পরিণত হয়। মহাকাশে স্পেস স্টেশন যার উচ্চতা ৩৫০ কিমির মতো, এটি নিয়মিত মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করে রিফুয়েলিং করা হয়, ফলে দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর রয়েছে।

আরও পড়ুন-বাংলার উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রীর বিকল্প অর্থনীতি

প্রতিটি উপগ্রহে নানা ধরনের সক্রিয় (অ্যাকটিভ) ও নিষ্ক্রিয় (প্যাসিভ) সেন্সর বা কৃত্রিম ইন্দ্রিয় থাকে। এর মধ্যে দৃশ্যমান সেন্সর, যা দিনের বেলায় ব্যবহার হয়; নানা ধরনের অতি-লাল বা ইনফ্রারেড সেন্সর, যা দিন বা রাত যে কোনও সময় ব্যবহার করা যায়, মূলত পৃথিবী বা আবহাওয়ামণ্ডল থেকে বিকীর্ণ বিভিন্ন তাপ তরঙ্গের নির্গমণের তথ্য সংগ্রহ করে। একাধিক ইনফ্রারেড সেন্সর থাকলে তাকে সাউন্ডার বলা হয়। যা অনেকটা রেডিও সাউন্ড বেলুন অবজারভেশন-এর মতো যে কোনও জায়গার উপর (পাহাড়, সমুদ্র) উলম্ব তাপমাত্রা নির্ধারণের কাজ করে। নিউমেরিকাল ওয়েদার প্রেডিকশনে এর খুব প্রয়োজন। আর থাকে ট্রান্সপন্ডার যা এক কম্পাঙ্কের বেতার তরঙ্গ গ্রহণ করে ও অন্য কম্পাঙ্কের বেতার তরঙ্গ প্রেরণ করে, যার সাহায্যে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে সরাসরি টেলি যোগাযোগ ও টেলিভিশন সম্প্রসারণ হয়।

আরও পড়ুন-কোর্টের নির্দেশে তদন্তে ডিআইজি

নিম্ন কক্ষপথ (লোয়ার আর্থ অরবিট)
এক্ষেত্রে কৃত্রিম উপগ্রহের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২৫০ কিমি ও ২০০০ কিমির মধ্যে থাকে। প্রদক্ষিণ সময় ৯০ মিনিট থেকে ১২০ মিনিট। গতিবেগ ঘণ্টায় ২৫০০০ কিমির বেশি এবং প্রদক্ষিণের দিক, কৃত্রিম উপগ্রহের গতি ও পৃথিবীর গতির সমন্বয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ (টি-বাস ১) বা দক্ষিণ থেকে উত্তর (টি-বাস ২) মেরুর দিকে হয়। পৃথিবীতে কোনও একটি স্থানের ওপর ২০ মিনিটের বেশি থাকে না। এই সময়ের মধ্যে কৃত্রিম উপগ্রহটি ওই স্থানের নানাধরনের পর্যবেক্ষণ ও তথ্য আদান-প্রদান করে। এই কক্ষে ঘুরবার সময় ১২০০ কিমি থেকে ১৫০০ কিমি চওড়া পথ পর্যবেক্ষণ করতে করতে যায়, একে স্বাথ (SWATH) বলে। একই পথে আবার ফিরে আসতে আরও ১০ থেকে ১৪ দিন সময় লাগে। কাজেই সমগ্র পৃথিবীর পরিবেশের তথ্য এই কক্ষপথের সাহায্যে একই সেন্সর দিয়ে নিরীক্ষণ করা হয়। যা অন্য কোনও পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। এর সাহায্যে খরা, বন্যা, বনসৃজন, দাবানল, সমুদ্র সমতলের তাপমাত্রা ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্ধারণ করা হয়। কৃষিক্ষেত্রে কেমন ফলন হতে পারে সেই বিষয়ও জানা যায়। এমনকী ঝড়-বৃষ্টি পরিমাপের রেডার অবজারভেশনও নেওয়া হয়। ইন্টারনেটে পৃথিবীর মানচিত্র এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ত্রিমাত্রিক ছবি নেওয়া হয়। এটি মেরুর প্রান্তের তথ্য সংগ্রহ ও আদান-প্রদান করতে পারে।

আরও পড়ুন-ডুয়ার্স-তরাইয়ে ভল্লুক শুমারি

মধ্যম কক্ষপথ (মিডল আর্থ অরবিট)
এক্ষেত্রে কৃত্রিম উপগ্রহের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২০০০০ কিমি থেকে ২৬০০০ কিমির মধ্যে থাকে। প্রদক্ষিণ সময় প্রায় ১২ ঘণ্টা। একত্রে ২৪টি উপগ্রহ জালের মতো করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। একক ভাবে কোনও উপগ্রহই পৃথিবীর সম্পূর্ণ তথ্য দিতে পারে না। কিন্তু এদের নিজেদের মধ্যে বেতার সংযোগ থাকায় নানা কাজে এই উপগ্রহ সমষ্টি ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে আধুনিক বেতার যোগাযোগ (জিপিএস মোবাইল) জিও পজিশনিং, যা কিনা যে কোনও অবস্থানের ল্যাটিচিউড, লংগিচিউড, হাইট জানিয়ে দেয়। বিমান চলাচল, জাহাজ চলাচল ইত্যাদিতে এর ব্যাপক ব্যবহার। এর সাহায্যে মেরু অঞ্চলের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের তারতম্য হলে সুনির্দিষ্ট স্থানের স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে ত্রুটি ধরা পড়ে। এই ত্রুটির তারতম্য থেকে আবহাওয়ার নানা তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। একে জিপিএস মেটিওরোলোজি বলে।

আরও পড়ুন-বিজেপির ৪ নেতা-নেত্রীর পদত্যাগ

ভূসমলয় কক্ষ
এক্ষেত্রে কৃত্রিম উপগ্রহের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৩৬০০০ কিমি। এটির অবস্থান বিষুবরেখার ওপর। প্রদক্ষিণ গতি পৃথিবীর দৈনিক গতির সমান। কাজেই এই উপগ্রহ আপাতদৃষ্টিতে পৃথিবীর একই জায়গায় থাকে এবং পৃথিবীর এক তৃতীয়ংশ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। যে-সমস্ত দেশের অবস্থান বিষুবরেখা থেকে অনেক দূরে, তাদের সমস্তরকম সুবিধা পাওয়া মুশকিল। তাই প্রয়োজনীয় সুবিধা পাওয়ার জন্য একই উচ্চতায় বিষুবরেখা থেকে দূরে অবস্থান করানো হয়, তখন তাকে বলে জিও সিনক্রোনাস উপগ্রহ। এর সাহায্যে সরাসরি টেলি যোগাযোগ ও দূরদর্শন সম্প্রসারণ নিখুঁত ভাবে করা হয়। যদিও মেরুর প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগে অসুবিধা হয় বলে বর্তমানে জিপিএস উপগ্রহের সাহায্য নেওয়া হয়। বাস্তব সময়ে আবহাওয়ার সিনোপটিকে স্কেল অবজারভেশনের তুলনা নেই। পৃথিবীর যে কোনও স্থানে সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদি ঘটনার বিশদ ছবি মুহূর্তেই পাওয়া যায়। এই সমস্ত উপগ্রহগুলির কার্যক্ষমতা নষ্ট হলে প্রায় ৩০০ কিমি দূরে কবরস্থানে (graveyard) চলে যায়, আর ফিরে আসে না।

আরও পড়ুন-এমপি কাপ ফাইনালে মল্লিকপুর

অতি-উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথ
এই সমস্ত উপগ্রহের উচ্চতা ২০০ কিমি থেকে ৪০০০০ কিমি পর্যন্ত সম্পূর্ণ উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। যেহেতু এই উপগ্রহ এর গতিপথের বেশির ভাগ সময় পৃথিবী থেকে দূরে থাকে, ফলে বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণ বলের প্রভাব কম হয়, তাই এটি অনেক দিন কক্ষপথে থাকে। পৃথিবীর অনেক বেশি অংশও দেখা যায়, আবার একে উপরোক্ত যে কোনও কক্ষপথেও নেওয়া যায়। এই উপগ্রহ যোগাযোগ, রিসার্চ, গোপন খবর সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয়। রাশিয়ান ভাষায় ‘মোলনিয়া’ কক্ষপথ বল। তারকাযুদ্ধ ও গুপ্তচরবৃত্তিতে এর জুড়ি নেই। পৃথিবীর খুব কাছে হুস করে এসে দ্রুত পালিয়ে যায়।

Latest article