হাঁপানি নিরাময়ে

শীত এসে গেল, সেই সঙ্গে এসে গেল রুক্ষ, শুষ্ক বাতাস, ধোঁয়া, ধুলো। হাঁপানি বা অ্যাজমার কারণ হিসেবে অনেক কিছুই রয়েছে, যার মধ্যে শীত অন্যতম।

Must read

শীত এসে গেল, সেই সঙ্গে এসে গেল রুক্ষ, শুষ্ক বাতাস, ধোঁয়া, ধুলো। হাঁপানি বা অ্যাজমার কারণ হিসেবে অনেক কিছুই রয়েছে, যার মধ্যে শীত অন্যতম। আবহাওয়ার তারতম্য হাঁপানির সমস্যাকে ত্বরান্বিত করে। শীতকালে হাঁপানির কষ্ট নিয়ে বললেন পালমোনোলজিস্ট ডাঃ পার্থসারথি ভট্টাচার্য এবং ডাঃ সুদীপ ঘোষ। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

আরও পড়ুন-জট কাটিয়েই ২ মাসে ১৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, জানালেন ব্রাত্য

‘‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর ওই ডালে ডালে’’— উত্তরে হাওয়া, ভোরের শিরশিরানি জানান দিচ্ছে শীত এসে গেছে। শীত যেমন স্বস্তির তেমনই সমস্যারও। হাঁপানি রয়েছে যাঁদের, তাঁদের এবার বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার পালা। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁপানি রোগীর সমস্যাও বাড়ে।

আরও পড়ুন-বিরাটের রেস্তোরাঁয় ব্রাত্য সমকামীরা

যে কোনও রোগের মোকাবিলা করতে হলে জানতে হবে সেই রোগটা কী এবং কেন হয়। তবেই তার যথাযথ প্রতিকার সম্ভব।
হাঁপানি কী
চলতি কথায় বলা যেতে পারে, শ্বাসকষ্টর সঙ্গে সোঁ সোঁ শব্দ হওয়া হল হাঁপানি। চিকিৎসার পরিভাষায় আমাদের শ্বাসনালির একধরনের প্রদাহ বা ইনফ্লামেশনের ফলে শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে বায়ুপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। সরু হয়ে যাওয়া শ্বাসনালিতে বায়ু চলাচলের জন্য সোঁ সোঁ শব্দ হয় এবং রোগী হাঁপায়। সরু হয়ে যাওয়া শ্বাসনালি প্রসারিত হলেই আবার শ্বাসকষ্ট কমে যায়। তাই হাঁপানির কষ্ট ভালও হয় এবং শ্বাসনালির সংকোচনের মাত্রার উপর নির্ভর করে তা বাড়ে কমে।

আরও পড়ুন-হার্দিকের কোটি টাকার ঘড়ি আটক বিমানবন্দরে

অ্যাজমা ও হাঁপানি সমার্থক। বড়দের ক্ষেত্রে সিওপিডিতে হাঁপানির মতো সিম্পটম দেখা যায়।
আমাদের দেশে কাঠের রান্না, কয়লা রান্নার একটা চল রয়েছে। বহু জায়গায় এখনও এটা হয়। এই কাঠের আর কয়লার রান্নার ধোঁয়া থেকে সিওপিডি (COPD) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খুব বেশি ধূমপান করলে সিওপিডি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এঁদের হাঁপানি থাকলে বেড়ে যেতে পারে।
এছাড়া পলিউশন বা বায়ুদূষণ হাঁপানির একটা বড় কারণ। শীতে বাতাসে ধূলিকণা খুব সক্রিয় থাকে। ধুলোময়লা বাড়ে যা হাঁপানির কষ্টকে ত্বরান্বিত করে। অ্যাজমার রোগীদের শীতকালে হাঁপানি অনেক সময় বেড়ে যায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন মূলত এই হাঁপানির কারণ।

আরও পড়ুন-ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট জরুরি: দ্রাবিড়

ইনফেকশন (সাধারণত ভাইরাসজনিত) থেকে অ্যালার্জি, তার থেকে শীতকালে হাঁপানির টান হয়। এটা অনেক সময় গ্রীষ্মকালে কমেও যায়।
এছাড়া নানাধরনের অ্যালার্জি থাকলে অ্যাজমা হয়। যেমন অনেকের উগ্র সুগন্ধি থেকে অ্যালার্জি হতে পারে, সেই থেকে হাঁপানি হয়। ফুলের রেণু থেকে অ্যালার্জি হয়, বাড়িতে শীতপোশাকের রোয়া থেকে হাঁপানির কষ্ট হতে পারে। কোনও রকম খাবার দাবার, কিছু কিছু শীতকালীন সবজি থেকেও অ্যালার্জি হয় এবং সেই থেকে হাঁপানি হতে পারে।

হাঁপানি ও সর্দি
বাতাসের সব অ্যালার্জেন নাকের রাস্তা দিয়ে বুকে ঢোকে। তাই নাকে ঝিল্লিপর্দায় প্রদাহ হলে অনেক সময়ই তা শ্বাসনালির প্রদাহের সঙ্গে যুক্ত হয় কারণ শ্বাসনালি এবং নাকের ঝিল্লিপর্দা উৎপত্তিগত উৎস এক। ফলে নাকে ঝিল্লিপর্দার প্রদাহে হাঁচি হয়, নাক দিয়ে জল পড়ে, যা একধরনের অ্যালার্জিই। এই হাঁচি হাঁপানি রোগীর জন্য সমস্যার বাড়ায়। সর্দি না কমা অবধি অনেকের হাঁপানি কমে না।

হাঁপানি ও একজিমা
একজিমা হাঁপানির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অনেকেরই হাঁপানির সঙ্গে একজিমা থাকে। একটা সারলে আর একটা বাড়ে এমনটাও হয়।
হাঁপানি ও গলা-বুক জ্বালা
যাঁদের গলা-বুক জ্বলে, তাঁদের অনেক সময় হাঁপের টান হয়। আসলে পাকস্থলীর অম্লরস গ্রাসনালিতে উল্টোপথে এসে গলা-বুক জ্বালা ধরায়। এর ফলে অনেকের টান বাড়ে। অনেকে বলেন গ্যাসের টান।

হাঁপানির উপসর্গ
মাঝে মাঝে বুকে টাইট লাগা বা ভালমতো চাপ অনুভব হওয়া। কফ বসে যাওয়া। মাঝে মাঝে সোঁ সোঁ শব্দ হওয়া বা কাশি হওয়া।
বিশেষ কোনও বস্তুর সংস্পর্শে আসার পর কষ্ট শুরু হওয়া বা বেড়ে যাওয়া ( যেমন ধোঁয়া, ধুলো, ঠান্ডা বাতাস ইত্যাদি)।
বুকে ব্যথাও হতে পারে। এর সঙ্গে যদি ঘন ঘন ঠান্ডা লাগে, হাঁচি হয়, নাক দিয়ে জল পড়ার সমস্যা হয় তাহলে সেটা হাঁপানির লক্ষণ হতে পারে।
পরিবারে কারও হাঁপানির ইতিহাস থাকলে তবে সেক্ষেত্রে হাঁপানি হতে পারে।
অনেকসময় হাঁপানিতে টান বা সোঁ সোঁ শব্দ না হয়ে শুধু কাশি হয়। কারও কারও প্রচুর শ্লেষ্মা বেরোয়। আবার কারও রাতের বেলাতেই শুধু কাশি হয়। এটাও হাঁপানির লক্ষণ হতে পারে৷

আরও পড়ুন-ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে, চোটে নেইমার

চিকিৎসা
হাঁপানির চিকিৎসা মানেই ট্যাবলেট আর ইনজেকশন, এই ধারণার বদল এসছে। ওষুধ খেলে বা ইনজেকশন নিলে হাঁপানির উপশম হলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিছু কিছু ওষুধে হাত-পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, ঘুম হয় না। কিন্তু মজার বিষয় হল, ওষুধটা দরকার শুধুমাত্র ফুসফুসে পৌঁছনোর জন্য, হার্টে বা মস্তিষ্কে নয়। তাই ওই একই ওষুধ অনেক কম মাত্রায় ফুসফুসে পৌঁছনোর উপযুক্ত উপায় বা সমাধান হল প্রশ্বাসের সঙ্গে ওষুধটা নেওয়া। টেনে নেওয়া বাতাসে ভেসে সূক্ষ্ম ওষুধের কণা পৌঁছে যায় সূক্ষ্মতম শ্বাসনালিতেও, ফলে সঙ্গে সঙ্গে উপকার এবং আরাম পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে অনাবশ্যক কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকে না।

এই পদ্ধতির নামই হল ইনহেলেশন চিকিৎসা। যা ইনহেলার-এর সাহায্যে রোগী নেন। অনেকের ভুল ধারণা ইনহেলার নেওয়া একটি খারাপ অভ্যাস, নির্ভরতা এসে যায়, ইনহেলার ছাড়া তখন একমুহূর্ত চলে না। কিন্তু ইনহেলারই এখন হাঁপানির সঠিক, সফল চিকিৎসা পদ্ধতি। নিয়মিত ইনহেলার নিশ্চিন্তে নেওয়া যায়। স্টেরয়েড ইনহেলারই নিতে হবে। হাঁপানির জন্য এটাই প্রাথমিক চিকিৎসা। যদিও সিওপিডির ক্ষেত্রে একটু আলাদা চিকিৎসা হয়। তবে সাধারণ হাঁপানি বা অ্যাজমা রয়েছে যাঁদের, তাঁদের স্টেরয়েড ইনহেলার দেওয়া হয়।

তাছাড়া শ্বাসনালির সংকোচন কমানোর জন্য ব্রঙ্কোডায়লেটর জাতীয় ইনহেলার দেওয়া হয়। ইনহেলার সাধারণত একটানা নেওয়া উচিত, কখনওই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বন্ধ করা উচিত নয়। চিকিৎসকরা বুঝে ডোজ কমান। অনেকেই একটু সুস্থ হলেই ইনহেলার বন্ধ করে দেন। ফলে অ্যাজমার সমস্যা পরে আবার ফিরে আসে। রোগী ইনহেলার ছেড়ে দেওয়ার অনেকদিন পর যখন আবার সেই একই সমস্যা নিয়ে এল, দেখা যায় তাঁর ফুসফুসের ক্ষমতা অনেক কমে গেছে যেটা হয়তো রেগুলার ইনহেলার নিলে হত না। স্টেরয়েড এবং ব্রঙ্কোডায়লেটর ইনহেলার দিয়ে চিকিৎসার পরেও যদি হাঁপানি না কমে তবে কিছু অ্যাডভান্সড চিকিৎসা রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে সেটা চিকিৎসক প্রয়োজন বুঝে তা প্রয়োগ করেন।

আরও পড়ুন-হাইকোর্ট না বললে বিজ্ঞপ্তি নয়

সতর্কতা
হাঁপানি যদি ঠিকমতো চিকিৎসা না হয় তবে রোগীর শ্বাসনালির কিছু গঠনগত পরিবর্তন ঘটে। শ্বাসনালি সরু হয়ে যায় এবং তখন হাজার চিকিৎসা করালেও শ্বাসনালি আগের সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে না। ফলে চিকিৎসা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে। যাঁদের হাঁপানির বহুদিন কোনও চিকিৎসা হয়নি সেইসব রোগীর রক্তে অক্সিজেন অপর্যাপ্ত থাকে। এর ফলে হৃৎপিণ্ডের উপর কুপ্রভাব পড়ে।

ফুসফুসের ধমনিতে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং ডানদিকের হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। একে বলা হয় কর পালমোনালে (cor palmonale)। এমনটা হলে রোগী অনেক সময় শয্যাশায়ীও হয়ে পড়ে। বিপরীতে সময়মতো চিকিৎসা করালে রোগী সব সময় সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

শীতকালে খুব সাবধান থাকতে হবে। কার কীসে হাঁপানি বাড়ছে, সেই বিষয়ে জেনে সেগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। যেমন— কারও ঠান্ডা লাগলে, কারও ধুলো ময়লা থেকে অ্যালার্জি হয়। এগুলো খেয়াল রাখতে হবে।
দরকার হল চিকিৎসক যে ওষুধগুলো বা ইনহেলারগুলো দেন সেগুলো ঠিকমতো নিয়ম মেনে নেওয়া। এর ফলে হঠাৎ করে যে অ্যাজমাটিক অ্যাটাকগুলো হয় সেগুলো কমে যাবে।

যাঁদের অ্যাজমা রয়েছে তাঁদের ঠান্ডা যেন না লাগে এবং শীত পড়ার আগে থাকতে চিকিৎসককে বলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাহলে অনেকটা আটকানো যাবে।

আরও পড়ুন-দুয়ারের রেশন প্রকল্পের উদ্বোধনে বিপুল কর্মসংস্থানের ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর

শীতে হাঁপানির ঘরোয়া টোটকা

বিশেষজ্ঞের মতে, রোজ রাতে শুতে যাওয়ার আগে একচামচ মধু এবং দারচিনি গুঁড়ো মিশিয়ে খেলে শ্বাসকষ্ট অনেকটা লাঘব হবে সর্দি-কাশিও কমবে।
এককাপ দুধের মধ্যে তিন কোয়া রসুন দিয়ে ফুটিয়ে নিন। রসুনটি তুলে নিন। ঠান্ডা করে ওই রসুন আর দুধের মিশ্রণটি খেয়ে নিন। ফুসফুসের যে কোনও রোগের জন্য খুব উপকারী এই মিশ্রণ।

পাতিলেবুতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে একগ্লাস উষ্ণ গরম জলে একটা পাতিলেবুর রস চিপে খান। এতে হাঁপানির কষ্ট কিছুটা কমবে।
কফি শ্বাসনালির প্রদাহ কম করে। তাই শীতকালে গরম কফি খান, এতে শ্বাসকষ্টর উপশম হবে।
আদার রস ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি কমাতে বহুযুগের একটি টোটকা। আদার রসে হাঁপানির কষ্ট কম হয়। এক কাপ জলে একটুকরো আদা থেঁতো করে দিয়ে ফুটিয়ে নিন। তারপর ঠান্ডা করে সেই মিশ্রণটি পান করুন। শুধু ফুসফুসের রোগ নয়, সর্দি-কাশি, ঠান্ডা লাগা, গা-হাত-পায়ে ব্যথা, সব কিছু থেকেই দূরে রাখবে।

ল্যাভেন্ডার এসেন্সিয়াল অয়েল হাঁপানির জন্য খুব উপকারী। এক কাপ ঈষৎ উষ্ণ জলে পাঁচ থেকে ছ’ফোঁটা ল্যাভেন্ডার অয়েল দিয়ে ভাপ নিন। শ্বাসকষ্ট অনেকটা লাঘব হবে।
হলুদে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ। এটি শরীরকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে। হলুদে রয়েছে কারকিউমিন, যেটা অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া এবং হিস্টামিন নিঃসরণ বন্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শীতকালে গরম দুধের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে পান করলে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, হাঁপানির প্রকোপ কম হয়।

শীতকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রার জল না খেয়ে হালকা গরম জল পান করুন। ফ্লাস্কে গরম জল রেখে দিন ফুটিয়ে নিয়ে। ঠান্ডা জলের সঙ্গে মিশিয়ে নিন, ঠান্ডাভাব কাটিয়ে পান করুন। এতে হাঁপানির কষ্ট কমবে।

Latest article