তিন দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে তিনি চলে গেছেন অথচ তাঁর আকর্ষণ মানে তাঁর গানের আকর্ষণ কিছু মাত্র কমেনি। দেবব্রত বিশ্বাস। জর্জ বিশ্বাস নামেই সমধিক পরিচিত। ব্যারিটোন কণ্ঠের পৌরুষ ও লাবণ্যে, অভিব্যক্তিময় উচ্চারণে, আত্মমগ্নতায় আজও তিনি অপ্রতিরোধ্য। বিচ্ছিন্নভাবে নানা ধরনের গান গাইলেও রবীন্দ্রসংগীতই তাঁর আসল জায়গা, তাতেই সিদ্ধি।
আরও পড়ুন-এশিয়া কাপে নেই আফ্রিদি
ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান দেবব্রতর গান-বাজনার প্রতি টান তৈরি হয় পারিবারিক অনুকূল পরিবেশে ও মা-র মাধ্যমে। মা গান জানতেন, সমাজে নিয়মিত গাইতেন। স্বভাবতই মা-র কাছেই দেবব্রতর প্রাথমিক শিক্ষা। মা ছেলেকে শিখিয়েছিলেন যা তার বেশিরভাগ ব্রহ্মসংগীত। এ ছাড়া কোনও প্রথাগত তালিম দেবব্রতর ছিল না। স্বরলিপি ভালই দেখতে জানতেন, স্বরলিপি দেখে দেখেই গান তুলতেন।
গত শতকের চারের দশকে রেকর্ড জগতে প্রবেশ করলেন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। প্রথম দুটি রেকর্ড সে-সময়ের নামী শিল্পী কনক দাশের সঙ্গে, যিনি সম্পর্কে বৌদি ছিলেন। কনক দাশের সঙ্গে যুগ্মকণ্ঠে ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বরে বেরল ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ ও ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ এবং ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা’ ও ‘ওই ঝঞ্ঝার ঝঙ্কারে’। দুটিরই প্রকাশক এইচএ ভি। অতঃপর ১৯৪৬-এ এককভাবে প্রথম গাওয়া, ‘এ শুধু অলসমায়া’ ও ‘আছ আকাশপানে তুলে মাথা’— কলম্বিয়া কোম্পানিতে। ১৯৫৪ পর্যন্ত এইচএমভি ও কলম্বিয়া থেকে কয়েকটি রেকর্ড করলেন। এই প্রথম পর্বে ‘আমি চঞ্চল হে’, ‘চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে’, ‘ওই আসনতলের’ বা ‘তুমি রবে নীরবে’ গানের মধ্য দিয়ে নিজের মুনশিয়ানাটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আর তখন ‘তুমি রবে নীরবে’ নিয়ে একটা সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৯-এ রেকর্ড করেন দেবব্রত ‘তুমি রবে নীরবে’। গীতবিতানে আভোগে আছে ‘মম সফল স্বপন’, কিন্তু তিনি গাইলেন ‘মম সকল স্বপন’। রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ অনাদিকুমার দস্তিদার তা অনুমোদন না করলে দেবব্রত নিজের সমর্থনে ‘বীণাবাদিণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত স্বরলিপির কথা বলেন। তাতেও কাজ হয়নি।
আরও পড়ুন-চা-শ্রমিক সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন
শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা দেবী চৌধুরানি দেবব্রতর কথাকে সমর্থন করলে রেকর্ডটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়। এই ভাবে প্রথম জীবন থেকেই তিনি বিতর্কের সম্মুখীন। পরবর্তী কালে হিন্দুস্তান কোম্পানিতে রেকর্ড করার সময়ও। ১৯৬৪ ও ১৯৬৯ সালে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড দেবব্রতর কিছু গানে আপত্তি জানায় কোথাও অত্যধিক যন্ত্রানুষঙ্গ, আবার কোথাও বা স্বরলিপি-বিচ্যুতির কারণে। ‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গানে সঞ্চারী স্বরলিপি অনুযায়ী নয় বলা হল, কিন্তু পরে শান্তিদেব ঘোষ শুনে দেখেন ঠিকই আছে, তখন গানটি ছাড়পত্রও পায়। তবে ১৯৬৯-এ দেবব্রতর রেকর্ড-করা ‘তোমার শেষের গানের’ ও ‘পুষ্প দিয়ে মারো যারে’ গান দুটিকে তখন অনুমোদন দেওয়া হয়নি। দেবব্রত দেখলেন যে, তাঁর অনুজ শিল্পীরা তাঁর গানের বিচারক— এই ব্যাপারটি তাঁর একেবারেই ভাল লাগল না এবং ১৯৭১ থেকে দেবব্রত দুঃখে-অভিমানে রেকর্ড-করা বন্ধ করলেন। এর পর কোনও বাড়িতে বা ঘরোয়া আসরে অনেকটাই ইচ্ছাকৃতভাবে বা মজা করে দেবব্রত একটু অন্যরকম করে গেয়েছেন আর তা পরে বিভিন্ন কোম্পানি দেবব্রতর বাজারদর দেখে সেসব গানে তালবাদ্য, অন্যান্য যন্ত্র যোগ করে বাজারজাত করেছেন মুনাফার আশায় যা অত্যন্ত অন্যায় কাজ হয়েছে। সেইসব ক্যাসেট-সিডি থেকে দেবব্রত সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়ে ওঠা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। অথচ প্রথমে এইচএমভি-কলম্বিয়া ও পরে হিন্দুস্তান কোম্পানি প্রকাশিত বহু গান অন্য সাক্ষ্য দেবে যেখানে তিনি স্বরলিপিকে সর্বদাই মান্য করেছেন। এবং সে-সময়ের অনেক গানই রবীন্দ্রসংগীত জগতের চিরকালীন সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
আরও পড়ুন-হাতি ও শাবকের রহস্যমৃত্যু
জীবনে মৃত্যুর মতো অমোঘ আর কী আছে! সেই অনিবার্য সময়ে নিবিড় শান্তি দেয় তাঁর কণ্ঠের ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’, ‘নয়ন ছেড়ে গেলে চলে’ বা ‘পথে চলে যেতে যেতে’। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কবির সেই একান্ত সত্য অনুভব— ‘তবুও শান্তি তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’ মূর্ত হয় দেবব্রতর মরমি রূপায়ণে। যখন গাইছেন ‘কে গো অন্তরতর সে’ বা ‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’ তিনি যেন এক তদ্গত সাধক। ‘সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই, কেবল কাজে বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে’ গানে তাঁর গায়নে ‘ভর্ৎসনা’ ভর্ৎসনা হয়েই বাজে। তাঁর কণ্ঠে পূজার ‘নয় নয় এ মধুর খেলা’, ‘তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই’ বা ‘নাইবা ডাকো রইব তোমার দ্বারে’-রও অভিঘাত কম নয়। যখন নিবিষ্ট হয়ে গাইছেন ‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল’ আজকের রবীন্দ্রসংগীত জগতের সত্যিটা যেন উন্মোচিত হয়। এই সূত্রেই মনে পড়ে তাঁর গাওয়া ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’। আবার ভালবাসার গানেও তিনি বড় আন্তরিক। ভালবাসার বিভিন্ন স্তর যেভাবে সাজিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নানা গানে, দেবব্রত সেইভাবেই রূপায়িত করেন। প্রেমিক দেবব্রতকে আমরা অন্তরঙ্গ ভাবে পেয়ে যাই ‘তুমি রবে নীরবে’, ‘পুরানো জানিয়া চেও না’, ‘আমি যে গান গাই’— এমনতর সব গানে। ‘গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’র সঞ্চারীতে যখন উচ্চারণ করেন, ‘চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি/ আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি’, তখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় যে, আঁধারে নীরব ব্যথা কীভাবে ঢেকে যায়। প্রকৃতির গানে কথায়-সুরে ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, দেবব্রত সেই ছবিকে বাঙ্ময় করেছেন কত না গানে: ‘চিত্ত আমার হারাল’, ‘আজি শ্রাবণঘনগহন মোহে’, ‘আমার রাত পোহাল’ বা ‘ঝরঝর ঝরঝর ঝরে রঙের ঝরনা’। রবীন্দ্রনাথের জীবনভাবনা তাঁর ‘বিচিত্র’ পর্যায়ের গানে নানাভাবে উদ্ভাসিত। ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’, ‘আমি চঞ্চল হে’ বা ‘চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে’ গানে রবীন্দ্রনাথের সেই স্বতন্ত্র ভাবনাকে যথোচিত মর্যাদা দেন দেবব্রত।
আরও পড়ুন-লর্ডসেই সম্ভবত বিদায় ঝুলনের
দেবব্রতর গায়নে যে স্বাতন্ত্র্য তা অনেকটাই স্বরক্ষেপণ ও অভিব্যক্তির জন্য। তা ছাড়া তাঁর গানের আরেকটি দিক— যন্ত্রানুষঙ্গ। এ-বিষয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তা ভাবনা ছিল, তাই প্রয়োগ করেছেন। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য যন্ত্র নিয়ে তাঁর কোনও ছুঁতমার্গ ছিল না। গানে যন্ত্রায়োজন নিয়ে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, অথচ সুবিনয় রায়ের ‘এ কি সুধারস আনে’-তে অ্যাকরডিয়ান বা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’-তে আধুনিক যন্ত্রাদি বেজেছে। এক্ষেত্রে বলা দরকার, রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রের ব্যবহার কোথায় কেমন হবে, সে-ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলে যাননি। রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রের ব্যবহারে দিশি বিলিতি বাছবিচার না থাকাই ভাল।’ তাঁর এ-ও মনে হয়েছিল যে, ‘…কর্ডের ব্যবহার ছাড়া গান খোলে না।’ আসলে কোন গানে কোন যন্ত্র কীভাবে বাজবে সেটাই যথার্থ সংগীতবোধ দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। গানের কথা, সুর, ভাবের দিকে লক্ষ্য রেখেই যন্ত্রানুষঙ্গ রচনা করতে হবে।
আরও পড়ুন-নৃশংস খুন তৃণমূল কর্মী
একাধিক চলচ্চিত্রে নেপথ্যে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন দেবব্রত। আমরা নিশ্চয়ই ভুলতে পারি না জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সংগীত পরিচালনায় ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০)-য় গীতা ঘটকের সঙ্গে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ বা ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১)-এ ‘আকাশভরা সূর্য- তারা’ এবং ঋত্বিক ঘটকেরই সংগীত পরিচালনায় ‘যুক্তি তর্ক আর গপ্পো’-তে (১৯৭৭) সুশীল মল্লিকের সঙ্গে ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’।
চারের দশকেই দেবব্রত ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। হিন্দুস্তান ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতে করতে সে-সময়ই সহকর্মী চিন্মোহন সেহানবিশের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। তা গণনাট্য সঙ্ঘের হয়ে মাঠে-প্রান্তরে রবীন্দ্রনাথের উদ্দীপনাময় দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বেড়ালেন। ১৯৪৩-এ মনুষ্য সৃষ্ট মন্বন্তরের প্রেক্ষিতে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র লিখলেন ‘নবজীবনের গান’, এর সুরযোজনা জ্যোতিরিন্দ্ররই, সহযোগ দিয়েছিলেন দেবব্রত। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরির লেখা গণ-জাগরণের গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন দেবব্রত। গণনাট্য সঙ্ঘের রেকর্ডে সলিল চৌধুরির ‘ও আলোর পথযাত্রী’ ও ‘হাতে মোদের কে দেবে’ গানে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ১৯৬৩-তে চিন আক্রমণের সময় সলিল চৌধুরির কথায়-সুরে গেয়েছিলেন ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ আর ‘চলো চলো মুক্তিসেনানী’। ১৯৫৩ ও ১৯৫৫-তে সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে চিন যান, তাঁর গান চৌ এন লাই প্রমুখকে মুগ্ধ করে।
১৯৭১-এ রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করা বন্ধ করার পর সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়-সুরে, তা ছাড়া অনাথবন্ধু দাসের সুরে বিষ্ণু দে, মণীন্দ্র রায়ের কবিতার গীতিরূপ রেকর্ড করেন।
আরও পড়ুন-মাঠে লিমা, এলেন ইভান
রেকর্ডে বিভিন্ন রচয়িতার ব্রহ্মসংগীত ‘অনন্ত অপার তোমায় কে জানে’, ‘অন্তরতর অন্তরতম’ প্রভৃতি গান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। নজরুলের গানও গেয়েছেন, ‘বনকুন্তল এলায়ে’ ও ‘দোলনচাঁপা বনে দোলে’।
বিভিন্ন ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া অন্য গান নেপথ্যে গেয়েছেন, যেমন, ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮), ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ (১৯৬২), ‘দাদাঠাকুর’ (১৯৬২) ইত্যাদি ছবিতে।
দু-একবার অভিনয়ও করেছেন নাটকে। ১৯৪৭-এ দেবব্রত বামপন্থী মহিলাদের এক সমিতির সাহায্যার্থে ‘রক্তকরবী’ অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন শ্রীরঙ্গম মঞ্চে। বিশু পাগল সেজেছিলেন তিনি, তা ছাড়া কণিকা মজুমদার নন্দিনী, তৃপ্তি মিত্র চন্দ্রা। ১৯৪৮-এ বহুরূপী-র ‘ছেঁড়া তার’-এ শম্ভু মিত্র তাঁকে একবার অভিনয় করিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-জয়ের হ্যাটট্রিক ডায়মন্ড হারবারের
এমন প্রতিভাধর যথার্থ শিল্পী মানুষটি কিন্তু কোনও পুরস্কার পাননি। তবে প্রকৃত পুরস্কার অগণিত শ্রোতার ঐকান্তিক ভালবাসা। ১৯৮০-র এই অগাস্টে তিনি চলে গিয়েছিলেন, আবার জন্মও এই অগাস্টেই ১৯১১-তে। প্রণাম রইল।