বাংলা থেকে ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিদায় যাত্রা শুরু

Must read

পূর্ণেন্দু রায় : অশান্ত সময়। কট্টর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আর বিকৃত পুঁজিবাদের মিলিত আস্ফালন ফ্যাসিবাদের নিশ্চিত আগমন বার্তা বয়ে আনছে। ওই দুই অপশক্তির রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের আক্রমণটা পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। সমাজজীবনের সর্বস্তরে ,সর্বক্ষেত্রে। কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী চরিত্র ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে জনসমক্ষে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংসদীয় গণতন্ত্রের এই দেশে পরিকল্পিত আঘাতে ভেঙে ফেলা হচ্ছে বহুল প্রচারিত গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিকে।পরিকল্পিতভাবে সংসদকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছে। সংখ্যাধিক্যের আস্ফালনে সংসদের নিয়ম-নীতিকে অস্বীকার করার প্রয়াস চলছে।কৃষক বিরোধী তিনটি আইন তৈরী করা হয়েছে সংখ্যাধিক্যের জোরে। সেই আইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা ২৩৭ দিন ধরে রাজধানীর সীমান্তে অবস্থানে শামিল , সরকার নির্বিকার সংসদে সংখ্যাধিক্যের অহংকারে। বিচার ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ নতুন কিছু নয়। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরে এই হস্তক্ষেপ বর্তমান সময়ে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে জনমানসে অনেক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে । সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্নেহভাজন হলে ,আদালত থেকে অবসরগ্রহণের পরেও পাওয়া যেতে পারে লোভনীয় পদ বা চাকরি। এই চিন্তায় আচ্ছন্ন বিচার ব্যবস্থার প্রথম ,দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। প্রচারমাধ্যমের বড় অংশটাই এখন ক্ষমতাসীনদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা আজ পরিণত হয়েছে শাসকের পদলেহনে। অসৎ উপায়ে অর্জিত পুঁজি এখন নিয়ন্ত্রণ করে প্রচারমাধ্যমের একটা বড় অংশকে। সম্পূর্ণভাবেই দিল্লির শাসকদের মদতে।

আরও পড়ুন : শিশুপাচারকাণ্ড : কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলে বাঁকুড়ায় বিক্ষোভ তৃণমূলের

গণতন্ত্রের স্তম্ভ হিসাবে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে কুক্ষিগত অথবা অকেজো করে দেবার পাশাপাশি বর্তমান শাসকের নজরে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নামে স্বাধীন চিন্তা চেতনাকে নস্যাৎ করার প্রয়াস চলছে গোটা দেশজুড়ে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ,বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় , হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কখনো প্রশাসন ,কখনোবা বহিরাগত সমাজবিরোধীদের দিয়ে ছাত্রদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা হচ্ছে। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কার ছবি টাঙানো হবে তা নির্দিষ্ট করে দিতে উদ্যোগী বহিরাগত অ-পড়ুয়া একদল মানুষ ,যারা শাসকদলের মদতপুষ্ট। বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার পরিবর্তে পৌরাণিক ,অলৌকিক কাহিনীর আধারে পাঠ্যসূচীকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া চলছে। ইতিহাস বদলে দেবার সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছে শাসক বিজেপি , তাদের আদর্শগত নিয়ন্ত্রক আরএসএস’র নির্দেশিত পথে ।

আরও পড়ুন : অভাবনীয়! মোদি-যোগীর রাজ্য থেকে বাংলায় স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড পেতে অসংখ্য আবেদন

এটা ওদের করতেই হবে ,কারণ আধুনিক ইতিহাসে বর্তমান শাসকের আদর্শপুরুষদের জনস্বার্থে কোনো অবদান নেই। তাই ওদের মেতে উঠতে হয় রাম ,গোমাতা অথবা হনুমানকে নিয়ে। বারে বারে আক্রান্ত হচ্ছে দলিত ,ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। আর এইসব আক্রমণে উৎসাহ দিচ্ছেন বিজেপির নেতা ,মন্ত্রী ,জনপ্রতিনিধিরা। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আদিবাসী মানুষদের উচ্ছেদ করে জল ,জঙ্গল ,জমি কেড়ে নেবার প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। উন্নয়নের নামে মাটির তলা থেকে খনিজ পদার্থ তুলে আনার জন্য হাজার হাজার একর জমি বহুজাতিক অথবা দেশীয় পুঁজিপতিদের লিজ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে কয়লা খনির মালিকানা , রেলের মালিকানা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। করোনা অতিমারীর সংকটকে কেন্দ্রীয় সরকার জনবিরোধী সিদ্ধান্তগুলিকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেছে।

কালো টাকা উদ্ধারের নাম নজিরবিহীন ‘নোট বাতিল’ এর সিদ্ধান্ত , জিএসটি লাগু করার অসময়োচিত সিদ্ধান্ত এবং করোনা সংকটের প্রেক্ষিতে তৈরী হওয়া ভয়াবহ আর্থিক মন্দা থেকে কৃষি ,শিল্প ,পরিষেবা ক্ষেত্রকে উদ্ধারের জন্য প্যাকেজ ঘোষণার নামে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পাঁচদিন ধরে দফায় দফায় দেশের পাতাল থেকে আকাশ এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি স্বদেশী-বিদেশীপুঁজির হাতে তুলে দেবার কথা ঘোষণা করেছেন। প্রতিবাদী জনতার রাস্তায় নেমে আসার সুযোগ ছিলোনা ,কারণ করোনা লকডাউন-এ জমায়েত নিষিদ্ধ। কিন্তু লকডাউনে থেমে থাকেনি প্রতিবাদী স্বত্বাকে পিষে ফেলার পুলিশি পদক্ষেপ। মিথ্যা মামলায় গণআন্দোলনের ,অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো ,৬০ থেকে ৮০ বছর বয়স্ক অসুস্থ্য কবি ,অধ্যাপক,লেখকদের জামিন নামঞ্জুর করার নিয়মিত ব্যবস্থাগুলি পুলিশ নিয়মনিষ্ঠ ভাবেই কার্যকর করেছে। গত জানুয়ারি মাসে দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চার্জশিটে প্রাক্তন আইএএস ও সমাজকর্মী হর্ষ মন্দর ,বিভিন্ন গণআন্দোলনের পরিচিত মুখ গান্ধীবাদী যোগেন্দ্র যাদব ,সমাজকর্মী ড.উমর খালিদ ,সিএএ বিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেত্রী সাফুরা জারগার ,দেবাঙ্গনা কলিতা ,নাতাশা নারওয়ালদের নাম জড়িয়ে দিতে বা জেলে পাঠাতে করোনা অতিমারী বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অসমে গণ আন্দোলনের নেতা অখিল গগৈ,বিট্টু সোনোয়াল ,ধৈর্য কুঁয়োর ,মানস কুঁয়োর দের একের পর এক মিথ্যা মামলায় জেলে বন্দি রাখতে অসুবিধা হয়না সরকারের। অসুবিধা শুধু মানুষ পথে বেরোলে।সরকারের সমালোচনা করলেই দেশদ্রোহী চিহ্নিত করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: মাসে ১ কোটি করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের

গত বছর চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতে ২০জন ভারতীয় জওয়ান শহীদ হলেন। তাদের হাতে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র ছিলোনা।যদি কেউ প্রশ্ন করে ,কেন ছিলোনা ? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলবেন ,আপনার প্রশ্ন চিনকে মদত দিচ্ছে। অর্থাৎ বুঝিয়ে দেওয়া হলো প্রশ্নকর্তা দেশদ্রোহী। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী শাসকের এই প্রতিক্রিয়াগুলিই ফ্যাসিবাদের আগমনবার্তা বয়ে আনছে। আর যখনই এরা প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে ,তখনই শাসক উর্দিধারী ঘাতকবাহিনীকে নামিয়ে দিচ্ছে সেই প্রতিরোধকে গুড়িয়ে দিতে। গোটা দেশজুড়ে সর্বক্ষেত্রে শাসকের এই আক্রমণ দেশের মানুষকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই অন্যায় , অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের রায়কে মেনে নিতে পারেনা এরা স্বাভাবিক নিয়মেই। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রায়কে নস্যাৎ করে বিজেপি রাজ্যপালের নেতৃত্বে নব-নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন মদতে বাংলা ভাগের দাবি তুলে রাজ্যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছে।কারণ, বিজেপির অন্যতম ‘আদর্শ পুরুষ’ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ও কর্মস্থান পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠনে ব্যর্থতার আক্রোশ। কারণ , মমতা ব্যানার্জির কাছে নরেন্দ্র মোদি – অমিত শাহ জুটির পরাজয়। এ জাতীয় পরাজয় ফ্যাসিস্টদের আরও হিংস্র করে তোলে। গণতন্ত্রের ওপর আঘাত নেমে আসে।

Latest article