পৃথিবীর ইতিহাসে যতসব ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী
গত কয়েক বছরে বেড়েছে নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়। একটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেজেগুজে হাজির হচ্ছে আরেকটা। এসে তছনছ করে দিচ্ছে জনজীবন। অতিবৃষ্টি এবং প্রবল ঝড়ের প্রভাবে সমস্যায় পড়ছেন সমুদ্র উপকূল অঞ্চলের বহু মানুষ। ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে জল, নয়তো তুমুল ঝড় ধ্বংস করে দিচ্ছে বাসস্থান, গাছপালা। তাই আবহাওয়া অফিস নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিলেই চিন্তার ভাঁজ দেখা দিচ্ছে উপকূলবর্তী বহু মানুষের কপালে।
আবহাওয়াবিদরা বলেন, নিম্নচাপে বাতাসের চাপ অনেকটাই কমে যায়। তাই লঘু চাপে যেখানে মাঝারি মানের বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে নিম্নচাপে হয় প্রচুর বৃষ্টিপাত। এমনকি ঘূর্ণিঝড়ও হতে পারে।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় গণতন্ত্র নেই, শপথ নিয়েই তোপ সুস্মিতার
নিম্নচাপের সময় কোনো জায়গার বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। তাই ওই স্থানটি প্রায় বায়ুশূন্য হয়ে পড়ে। এইভাবে সমুদ্রে গভীর নিম্নচাপ তৈরি হলে আশেপাশের বাতাস ওই শূন্যস্থান পূরণের জন্য তীব্র বেগে ধেয়ে আসে। ফলে চতুর্দিকের বাতাস মাঝখানে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ও একটি ঘূর্ণির সৃষ্টি করে। সঙ্গে প্রচুর জলীয়বাষ্প তো আছেই। এভাবেই নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যতসব ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের ৩৫টি সবচাইতে ভয়ঙ্কর মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। সেই তালিকার ২৬টি ঘুর্ণিঝড়ই বঙ্গোপসাগরের। তুলে ধরা যাক আরও একটি তথ্য। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে রেখেছে যে তটরেখা, সেখানে বাস করে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। যাঁরা এই নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বঙ্গোপসাগরে কেন এত বেশি নিম্নচাপ ও ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় হয়? কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে অবতল আকৃতির অগভীর বে বা উপসাগরে। মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র হাওয়া যখন এইরকম জায়গায় সাগরের জলকে ঠেলতে থাকে, তখন ফানেল বা চোঙার মধ্যে তরল যেরকম আচরণ করে, এখানেও সেইরকম ঘটে। এর সঙ্গে যোগ হয় আরও কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রা এই পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে। কারণ, বঙ্গোপসাগর একটি উষ্ণ সাগর। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে আছে অনেক উপসাগর। যেখানে উপকূলে বরাবর এই ধরনের জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি আছে। যেমন লুইজিয়ানার গালফ কোস্ট। বিশ্বের আর যে কোন উপকূলের থেকে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূল এই ধরনের জলোচ্ছ্বাসের সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করেন আবহাওয়াবিদরা। সেই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে উপকূলজুড়ে ঘনবসতি। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের প্রতি চারজন মানুষের একজন থাকে বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশগুলিতে। বিগত বছরগুলোতে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে আয়লা, লায়লা, বুলবুল, ফণি, আমফান প্রভৃতি ঘূর্ণিঝড়। পাশাপাশি আসছে ঘনঘন নিম্নচাপ। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, আরব সাগর বা বঙ্গোপসাগরে যেসব ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, প্রতি দশ বছরে তার মাত্র একটি হয়তো প্রচণ্ড ক্ষমতা বা শক্তির ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরে আগের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে। এর প্রধান কারণ সম্ভবত উষ্ণতা।
আরও পড়ুন-Depression over Bay of Bengal
কথা হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক, বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ডঃ রামকৃষ্ণ দত্তর সঙ্গে। এই বিষয়ে তিনি জানালেন, আমরা স্টাডি করে দেখেছি, এই বছরে পার্টিকুলার ম্যাটার ২.৫ ডাইমেনশনে পলিউশনগুলো অনেকটাই বেড়েছে। পাশাপাশি এনসো ফেনিমেনা শুরু হয়েছে এই বছর গোড়ার দিকে। সাধারণত সমুদ্রের উপর দিকের জল গরম হয়, নীচের দিক ঠাণ্ডা। কিন্তু কোনো কোনো সময় দেখা যায় তখন নীচের দিকে গরম, উপরেও গরম। নীচের দিকে গরম হওয়ার একটা কারণ আন্ডার ওয়াটার ভলক্যানো। এই গরম হয়ে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে এনসো ফেনিমেনা। এই বছরের গোড়ার দিকে সেটা শুরু হয়েছে। এর ডাইমেনশন এক হাজার কিলোমিটার থেকে বেশি জায়গায়। এটা ঘটলে দুই ধরনের এফেক্ট হয়। সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সেটা বাড়তে বাড়তে আমাদের দিকেও এগিয়ে আসে। আবার অনেকসময় বাতাস ওঠানামা করে। বাতাস ওঠানামার সময় আবহাওয়া খারাপ হয়। নিম্নচাপ, ঘূর্ণিবঙ্গোপসাগরে-কেন-বাড়ছে-নDepression oঝড়ের সৃষ্টি হয়। আসলে এটা ওয়াকার সার্কুলেশনকে ডিসটার্ব করে। এইবছর বঙ্গোপসাগরে সেটাই ঘটছে। আমাদের এখানে সাধারণত শীতকালে শুষ্ক বাতাস এবং বর্ষাকাল জলীয় বাতাস। উপরের দিকে ঠাণ্ডা, নীচের দিকে গরম। শুষ্ক বাতাস প্রতি এক কিলোমিটার উপরে উঠলে দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমে যায়। এটা নরম্যাল। মনে রাখতে হবে, জলীয় বাষ্পের ওজন শুষ্ক বাতাসের থেকে হালকা। ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে উপরের দিকে উঠে যায়। তবে বেশিদূর যেতে পারে না। কমে যায় শুষ্ক বাতাস ও জলীয় বাষ্পের দূরত্ব। জলীয় বাষ্প এক কিলোমিটার উপরে উঠলে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমে। এক স্তরে ভাসলেও শুষ্ক ও জলীয় বাষ্পের তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে। এরফলে মেঘের সৃষ্টি ও বৃষ্টিপাত হয়। তারতম্য যত বেশি ঘটে, ততবেশি বৃষ্টিপাত হয়। এইবছর সেটাই হচ্ছে। আসলে পিএম ২.৫ টেম্পারেচার বেড়েছে। পাশাপাশি সি সারফেস টেম্পারেচার বেড়েছে। এটাও এইবছর নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড় বাড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আর একটা বিষয়, উপকূলবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মিন সি লেভেল হাইট তিন মিটারের থেকেও কম। যার জন্য সমুদ্রের জল গ্রাম-শহরে ঢুকে পড়ে, ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।
মনে পড়ছে ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনের কথা। উড়িষ্যা রাজ্যে প্রায় দশ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল সেইসময়। তার বহু আগে, ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ভোলায় যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচাইতে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ। জানা গেছে, সেই ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল, তার উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক ৪ মিটার বা ৩৪ ফুট।
২০০৮ সালের মে মাসে বার্মার উপকূলে আঘাত হেনেছিল সাইক্লোন নার্গিস। সেই সাইক্লোনে অন্তত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন এবং ২০ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছিলেন।
সবগুলোর পিছনে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। তাই নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস কানে এলেই আরও বেশি সতর্ক হতে হবে বঙ্গোপসাগর উপকূলের বাসিন্দাদের। তাতে বিপদ হয়তো কিছুটা হলেও কমবে।