(গতকালের পর)
ঘটনা হচ্ছে, এই ছোটলোক কারা? আমার সল্টলেকেরই নানা কমার্শিয়াল এরিয়ায়, সেক্টর ফাইভ, ইকো পার্ক, নিক্কো পার্ক, সায়েন্স সিটি-সহ বহু জায়গায় ছোট-ছোট খাবারের স্টল করে ছেলেমেয়েরা সকাল থেকে হইহই করে ব্যবসা করছে। এরা ছোটলোক?
কলকাতা তো বটেই সমগ্র বাংলা জুড়েই একটা পরিচিত দৃশ্য— তেলকালি মাখা অপরিসর একটি দোকানে লুঙ্গি পরা একজন-দুজন লোক তেলেভাজা ভাজছেন। আমরা সবাই জানি লোকটির পরিশ্রমের ফল তাঁর ঝাঁ-চকচকে বাড়ি, গাড়ি, ছেলেমেয়েদের হাইফাই জীবনযাপন। বলুন তো এই লোকটি আপনাদের নিরিখে কোন জায়গা থেকে ছোটলোক? নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে সে তার পরিবারকে আর্থিক দিক থেকে চূড়ান্ত ঐশ্বর্য্যশালী করতে পেরেছে বলে সে ছোটলোক— আর আপনি স্যুটেড বুটেড হয়ে কলম পেষেন বলে আপনি ভদ্রলোক!! বাঃ যুক্তির কী দুরন্ত উদাহরণ!
আরও পড়ুন-মহালয়ার মহারণ
তা এরা যদি আপনাদের চোখে ছোটলোকই হয় তা হলে গুমটিতে ছোট্ট চায়ের দোকানগুলোর কত ইনকাম বলে চোখ কপালে তুলে ওদের হিংসে করেন কেন? ওই লোকটি তো আপনার পকেট মেরে পয়সাওয়ালা হয়নি। নিজের ক্ষমতায় হয়েছে।
আচ্ছা, এটা মাথার দিব্যি কে দিয়েছে যে শিক্ষিত হলেই সরকার চাকরি দিতে বাধ্য? আজব দাবি তো!! আপনাদের আবদার দেখে তো মাঝেমধ্যে মনে হয় বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে গলায় আওয়াজ তুলছেন নাকি স্বপ্ন দেখতে দেখতে বলছেন?
ঘটনা হচ্ছে শারীরিক পরিশ্রমের প্রতি অনাগ্রহ ও কর্মবিমুখ বাঙালি জাতি চাকর হতে ভালবাসে। জানি আপনাদের রাগ হবে কিন্তু এটাই বাস্তব। আমাদের এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের ওই মোল্লার দৌড় মসজিদ অব্দিই।
আরও পড়ুন-দুর্গাপুজোর প্রহর গুনছে বাংলাদেশ
যদি সেটা না হয়— চাকরিই যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে গড়পড়তা ওই শিক্ষিত বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা ইউপিএসসি পরীক্ষায় বসে না কেন? কেন আর্মিতে ঢুকতে এখনও কিন্তু-কিন্তু? কেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাকরি করতে হলেই কাঁদুনি যে বাংলায় কিছু নেই? চাকরি তো দিনের শেষে চাকরিই। তা হলে এত বিচার কীসের? আপনাদের এইসব চাকরি করতে কি কেউ বারণ করেছে?
আসলে ঘটনার আরও একটি দিক রয়েছে। সেটি হচ্ছে যেহেতু এই পরামর্শ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন তাই যত লজিকই থাকুক না কেন বিষয়টিকে নিয়ে নোংরামি না করলে খেলা জমবে না। তাই যত রকমের অসভ্যতামি মনের জ্বালায় করতে পারা যায় তার কোনওটাই বাদ রাখার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একবার বেকার ছেলেমেয়েদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ছাগল, কোয়েল পাখি পোষার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রাণিসম্পদ বিকাশ দপ্তরের থেকে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কই তখন তো এইসব শিক্ষিত বাঙালিদের এত ইগোয় ধাক্কা লাগেনি! তখন তাহলে পাম অ্যাভিনিউয়ের দু কামরার ফ্ল্যাটের মুখ্যমন্ত্রীর ছাগল পোষার ব্যবস্থাটা বেকার সমস্যার সমাধান হিসেবে বেশ মনোগ্রাহী ছিল তাই না?
আরও পড়ুন-নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ চঞ্চল নন্দী হাইকোর্টে হার, আদালতে পুলিশি তদন্তের অনুমতি
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চপ-ঘুগনির স্ট্যান্ডার্ড আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছাগল পোষার স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় জানেন?
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যে চূড়ান্ত শক্তিশালী একটি মুখ। কিছু করে দেখানোর অসম্ভব রকমের ভাবনা নিয়ে এই মানুষটিকে আমি বিগত চল্লিশ বছর ধরে দেখছি। বাংলা তথা দেশের রাজনীতিতে সময়ের প্রয়োজনে কত কী পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এই মানুষটির ব্যক্তিজীবন ও সাধারণ ভাবনায় জীবনকে দেখার কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এই মানুষটির একমাত্র ট্র্যাজেডি কি জানেন? যে কারণেই ওঁর সব কথায় খুঁত ধরতে ধরতে রাজ্যে একটি দল শূন্য, কেন্দ্রের একটি দল তারকাটা হয়ে বেপরোয়া সেটি হল ওই নালার পাশে, বস্তির মধ্যে টালির ঘরে বাস করা মানুষটি একজন মহিলা তাই…
আরও পড়ুন-এবার লোডশেডিংমুক্ত দুর্ঘটনাহীন দুর্গাপুজো
হ্যাঁ, মহিলা!! মুখে যতই গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের গল্প বলি না কেন আদতে আমরা এখনও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। যে কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি কথাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাটা একটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে এই সমাজের কিছু অংশ। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই কথা গিলতে হয়েছে তবুও এদের খিল্লি করার চেষ্টা বন্ধ হয়নি। বাস্তবে কিন্তু আমরা সবাই জানি, বর্তমান সময়ের নিরিখে চাকরি অপ্রতুল। সে মুখ্যমন্ত্রীর নাম কাল যদি বদলেও যায় তিনিও চাকরি দিতে পারবেন না। তা যদি হত তাহলে প্রধানমন্ত্রীর বছরে দু কোটি চাকরি কোথায় গেল? ক’বার প্রশ্ন তোলেন? কই সারাদিন ধরে নোংরা মিম বানান? খিল্লিতে ভরিয়ে দিন ফেসবুক?
আসলে আপনারা মেনে নিতেই পারেন না একজন গরিব ঘরের— তায় মহিলা বারবার আঘাত হানবে এদের একগুঁয়ে পৌরুষে। এই ক্লীব মানসিকতার জন্যই এরা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও ওঁকে ন্যূনতম সম্মান দেখাতে পারে না। যদিও আমি ওঁকে যতটুকু চিনি উনি এ-সব নিয়ে কোনওদিনই চিন্তিত নন। উনি কাজের মানুষ। নিজে সংগ্রাম করে আজ এই জায়গায় নিজেকে নিয়ে এসেছেন। তাই পরিশ্রমের দ্বারা যুব-সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে উৎসাহ দেন। একজন চাকরি তখনই পায় যখন একজন সফল ব্যবসায়ী তৈরি হয়।
আরও পড়ুন-ডিসেম্বরে টেট পরীক্ষা, চূড়ান্ত তালিকা নভেম্বরে
তাই সারাক্ষণ একটা মানুষের প্রতি অকারণ অযৌক্তিক আক্রমণ না শানিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ও বুদ্ধিতে শান দিন। বাঙালি ব্যবসাবিমুখ জাতির তকমাটা এবার নাহয় মোছার চেষ্টা করুন। চাকরি ছাড়া জীবন অচল এই ভাবনায় জীবনকে নষ্ট করবেন না। মুখ্যমন্ত্রীর কথাকে হেয় না করে একটু ভাবুন, উনি হয়তো কথাটা সাদামাঠা সহজ করে বলেছেন কিন্তু যেটা বলেছেন সেটা বাস্তবিক অর্থে গভীর অর্থবাহী।