স্বনির্ভর হওয়ার ডাক দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী

ঠাট্টা-মশকরা করা যেতেই পারে। কিন্তু কোনও মতেই উপেক্ষা করা যাবে না স্বনির্ভর হওয়ার আহ্বান। চাকরি-খোঁজা বঙ্গবাসীর জন্য নয়া জীবন দিশার সুলুক-সন্ধান। লিখছেন অশোক মজুমদার

Must read

ঘটনা ১
‘‘অশোক আমি একটা রোলের দোকান দেব।”— প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে এমন ভাবনার কথা আমায় বলেছিল আমার বন্ধু সৌমিত্র। পরবর্তীকালে সে রোলের দোকান দিয়েছিল কিন্তু মুম্বইয়ে। কারণ কর্মসূত্রে সে মুম্বইয়ে থাকত। সৌমিত্র আর আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু মুম্বইয়ের সেই রোলের দোকান আজ তার ভাইঝি দেখাশোনা করে।

আরও পড়ুন-স্বাধীন ব্যবসার প্রতি অনাগ্রহ অযৌক্তিক আত্মঘাতী প্রবণতা

ঘটনা ২
‘‘পুজোর সময় ঘোরা-বেড়ানোর মাঝে একটু ছোলা-ঘুগনি নিয়ে বসুন। প্রচুর লোক ঠাকুর দেখতে আসে দেখবেন বিক্রি হয়ে যাবে। পুজোর সময় কিছু বাড়তি আয় করতে পারবেন।”— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিকল্প রুজির অনুসন্ধানে বাঙালিকে ঘুগনি বিক্রির পরামর্শ আসলে গর্হিত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে!! মুখ্যমন্ত্রী সেই কাজটিই করেছেন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই অতি-প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালি চটে গিয়ে চিল-চিৎকার শুরু করেছে কয়েকদিন ধরে যে লেখাপড়া শিখে ঘুগনি বিক্রি করতে হবে? এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নোংরা মিম বানানো থেকে তাঁকে আবারও মনে করিয়ে দেওয়ার ধুম লেগেছে যে একজন বস্তিবাসীই এমন একটা প্রস্তাব দিতে পারেন।

আরও পড়ুন-দুর্গাপুজোর প্রহর গুনছে বাংলাদেশ

কি বাঙালি তাই তো?
বাঙালি জাতি সবসময় বুক ফুলিয়ে নিজেদের স্বাধীনচেতা বলে গর্ব করে। বাঙালির ভাবনা-চিন্তা, সমাজবোধ ভারতবর্ষের আর পাঁচটা জাতির মতো একমুখী নয়। আর বহুমুখী চিন্তার বলেই বাঙালি কালচারের বিশ্ব জুড়ে সুনাম। কিন্তু এই স্বনামধন্য সাধারণ বাঙালির একটি অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে— এদের একটা স্থির বিশ্বাস যে গ্র্যাজুয়েট হয়েই সন্তান চেয়ারে বসে কলম চালানোর কাজ করবে। অর্থাৎ চাকরি করবে। সারাজীবন দশটা-পাঁচটার অফিস করবে। চাকরির লেভেল অনুযায়ী একটা দু-চাকা কিংবা চার-চাকা থাকবে। বছরে একবার-দুবার ঘুরতে-বেড়াতে যাওয়া থাকবে। ছেলেমেয়েদেরও ছোট থেকেই একই মোটো মনে ঢুকিয়ে তাদেরও চাকরির প্রতি আকৃষ্ট করে তোলার কাজটিও করে যাবে। এতেই বাঙালি জাতির শান্তি।

আরও পড়ুন-নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ চঞ্চল নন্দী হাইকোর্টে হার, আদালতে পুলিশি তদন্তের অনুমতি

আর এইখানেই বেধেছে গোল। বর্তমান সময়ে প্রায় সব ছেলেমেয়েই স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরনো শিক্ষিত। কতিপয় কিছু মেধাবী ছাড়া বাকিদের জ্ঞান, দূরদৃষ্টি কতটা হয়েছে সে নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকলেও খাতায়-কলমে শিক্ষিত তো বটে। তা এই তথাকথিত শিক্ষিতদের চাকরি ছাড়া আর অন্য কিছু করার কোনও ইচ্ছে মোটেই নেই। এর একটা কারণ, পারিবারিক ভাবে এরা এভাবেই ভাবতে শেখে।
আমি স্কুলের শেষদিক ও কলেজের সময়কালে যখন হাওড়া রেল কোয়ার্টারে থাকতাম তখন ওখানকার আমার বন্ধুরা প্রায়ই খোঁচা দিয়ে একটা কথা বলত, ‘কীরে কবে ঢুকছিস?’ মানে একটা সাধারণ ধারণাই ছিল বাবা যেহেতু রেলে চাকরি করে তাই আমিও রেলেই যাহোক করে ঢুকে পড়ব। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা বাঙালির।

আরও পড়ুন-এবার লোডশেডিংমুক্ত দুর্ঘটনাহীন দুর্গাপুজো

যাই হোক— কয়েকদিন ধরে টিভি, কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া দেখে আমার যেটা ধারণা হয়েছে যে এদের সরকার পড়াশোনা শিখিয়েছে, ডিগ্রি দিয়েছে অতএব চাকরিও দিতে হবে। এটা নাকি সরকারের কর্তব্য। সেটা না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চপ, ঘুগনি বিক্রির কথা বলেন কোন সাহসে?
সারা বিশ্ব জুড়ে বড় শিল্পের মন্দা চলছে এটা আর কে না জানে! ভারতবর্ষে এমনিও নোটবন্দি, অপরিকল্পিত জিএসটি ও করোনার ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়। সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের দিন চালানোই দুষ্কর। সেই জায়গায় একজন মুখ্যমন্ত্রী মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গাপুজোর মতো বৃহৎ একটি উৎসব অনুষ্ঠানে কাউকে যদি দু’পয়সা আয়-ইনকামের পথ বাতলে দেন তাতে এত গেল গেল রব তোলার কী আছে? আচ্ছা উনি কি আপামর সব বাঙালিকে এটা করতে বলেছেন? যারা মনে করবে তারা করবে।

আরও পড়ুন-ডিসেম্বরে টেট পরীক্ষা, চূড়ান্ত তালিকা নভেম্বরে

এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে একবার আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পুজোর সময় গিরিশ পার্কে চপ-কাটলেটের দোকান দিয়েছিলাম। এখনও কত মানুষ এগুলো করে থাকেন বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে! কিন্তু ওই কিছু অতি-বিপ্লবীর জেনেও না জানার ভড়ং রোগের ফলাফল মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব। আমি নিশ্চিত জানি আপনারা বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা দিব্য জানেন কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে করার দম নেই কারণ অবচেতনে চাকর হওয়ার বিষয়টিই আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে একটি অলস বচনবাগীশ ব্যক্তি বানিয়ে ফেলেছে। আপনি তাই পুজোয় বন্ধুদের নিয়ে একটা রোলের স্টল করার কথা ভাবতেও পারবেন না।
যে কারণেই আমার প্রশ্ন সেইসব শিক্ষিত বিপ্লবীদের যারা চাকরি নিয়ে রীতিমতো অবসেশনে ভোগেন— আপনারা ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসিতে চিকেন ভাজা খেতে যেতে পারেন সানন্দে। এমনকী ওদের আউটলেটে কাজ করাটা নাকি চাকরি— সেটা আবার সগর্বে বলতেও পারেন কিন্তু নিজেরা চপ, বেগুনি, ঘুগনি বিক্রি করার কথা শুনে নাক সিঁটকিয়ে এমন করেন যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এটা ঠিক কোন ধরনের দ্বিচারিতা একটু বলবেন?

আরও পড়ুন-ডিসেম্বরে টেট পরীক্ষা, চূড়ান্ত তালিকা নভেম্বরে

আসলে বাঙালি ঘুগনি বেচবে? বাপরে বাপ! এটা কখনও হয়? ঘুগনি, চপ বেচার মতো সাব-স্ট্যান্ডার্ড কাজ করবে একটা শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট? ওসব ছোটলোকেদের কাজ। এটাই আপনাদের মানসিকভাবে এক-একজন আত্মবিশ্বাসহীন জীবে পরিণত করেছে। আপনাদের খোলা বাস্তববাদী ভাবনায় মোটা তালা লাগানো হয়েছে বহু বছর ধরে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাবনাকে ছোটলোকের কাজ আখ্যা দিয়ে আপনারা আপনাদের ভাষায় খিল্লি করে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
(এরপর আগামীকাল)

Latest article