অতীতে আমরা দেখেছি, কেরলে যখন ‘ওনাম’ উৎসব হয়, মহারাষ্ট্রে যখন গণেশচতুর্থী হয় বা রাজধানীতে দীপাবলি হয় তারপর সেই সকল জায়গায় কোভিড সংক্রমণের গ্রাফ ঊর্ধমুখী হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলা।
২০২০ সালে দেখেছি। ২০২১-এও দেখেছি। কথাতেই আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এখানে মানুষ শারোদোৎসব পালন করেছেন। দীপাবলি হয়েছে, ছটপুজো হয়েছে, জগদ্ধাত্রী পুজো হয়েছে। ইদ হল। বড়দিন গেল। প্রশাসনিক তৎপরতায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সাধারণ মানুষের সার্বিক সহযোগিতায় সে অর্থে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কোভিড সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়েনি।
কিন্তু, বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সার্বিক অসহযোগিতা এবং বৈমাতৃকসুলভ আচরণ সর্বস্তরে রয়েছেই। একাধিক উদাহরণ আছে।
এই মুহূর্তে সারাদেশে যত ওমিক্রন সংক্রমণের কেস আছে তার ১০ শতাংশের বেশি কেস আছে গুজরাতে। তা সত্ত্বেও যখন কেন্দ্রীয় দল পাঠানো হচ্ছে, তখন গুজরাতে তা পাঠানো হচ্ছে না। ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের মানুষ। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
প্রথম থেকেই কোভিড মোকাবিলায় একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকারের গা-ছাড়া মনোভাব চোখে পড়েছে।
মধ্যপ্রদেশে সরকার গড়ার জন্য, ‘নমস্তে ট্রাম্প’ করার জন্য আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা খুলে না রাখলে ভারতে কোভিডের ভয়াবহতা আটকানো যেত। এরপর পরিকল্পনাহীন লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরা— সবই ভারতবাসী দেখেছে।
প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আসার মধ্যে যে-সময় মোদি সরকার পেল, তার মধ্যে কোভিড মোকাবিলার জন্য কোনও পরিকাঠামোগত প্রস্তুতি নিল না। তার ফলে আমরা দেখলাম, নদীতে, গঙ্গায় মানুষের শবদেহ ভেসে যাচ্ছে। অক্সিজেনের জন্য দেশবাসীর হাহাকার দেখলাম। রাজধানীর রাজপথে মানুষকে অক্সিজেনের অভাবে মরতে দেখলাম। এরপর ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতা দেখলাম।
ভারতের টিকাকরণ প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে নিন্দিত হয়েছে। ল্যানসেড থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন দেশ ভারতের ‘কোভিড মোকাবিলা পদ্ধতি’কে তিরস্কৃত করেছে।
এদিকে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক যোগ দিবসে, নিজের জন্মদিনে, ক্রিসমাস ইভে নানারকম রাজনৈতিক চমক দিয়ে চলেছেন।
আরও পড়ুন-গ্রামোন্নয়নের জন্য দিশা দেখাচ্ছে রুরাল ম্যানেজমেন্ট
সারাদেশের মানুষ কোভিডের দ্বিতীয় ডোজ কবে পাবেন সেটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। একের পর এক প্রতিশ্রুতিভঙ্গ হচ্ছে। অথচ তিনি এরই মধ্যে অবলীলায় ঘোষণা করে দিলেন— জানুয়ারি মাস থেকে ১৫ বছরের মানুষদের নতুন করে কোভিড টিকাকরণ চালু হবে। অথচ তা কোথা থেকে আসবে তার কোনও দায়বদ্ধতা দেশের মানুষের প্রতি নেই।
বাংলায় কোভিড টিকাকরণ ভাল হয়েছে। ভ্যাকসিন নষ্টের হার সবথেকে কম এই বাংলায়। অথচ কেন্দ্রের নীতি, উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন আছে বলে সেখানে ঢেলে টিকা দাও, আর বাংলাকে বঞ্চিত কর।
এর আগেও দেশবাসী দেখেছে নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে বাংলায় তৈরি অক্সিজেন সিলিন্ডার অন্য রাজ্যের জন্য তুলে নিয়ে চলে যাওয়া হল। রেমডিসিভির যখন বাংলায় দরকার ছিল তখন তা পাঠায়নি। সর্বোপরি উল্লেখযোগ্য, কোভিডের জন্য বাংলার প্রাপ্য অর্থও কেন্দ্রীয় সরকার দিচ্ছে না।
নানাভাবে অসহযোগিতা করে বাংলাকে বেকায়দায় ফেলার নির্লজ্জ চেষ্টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে মোদি-শাহ রাজনীতি ছাড়া কিছু জানেন না! অহরহ বাংলাকে কালিমালিপ্ত করা, বদনাম করার প্রবণতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতার প্রবৃত্তি থেকে কেন্দ্রীয় সরকার মুক্ত হতে পারেনি।
ওমিক্রনের কথা যদি ধরি, এটি একটি করোনা ভাইরাস। জিনোম সিকোয়েন্সি পদ্ধতিতে ওমিক্রন শনাক্তকরণ হয়। চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, ওমিক্রনের সেই অর্থে ভয়াবহতা এখনও পর্যন্ত খুব বেশি দেখা যায়নি। তবে নিশ্চিত, আমরা যদি কোভিডের জন্য যে সতর্কতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করছি, তা যদি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি, তা হলে কোভিড থেকেও বাঁচব এবং ওমিক্রন থেকেও বাঁচতে পারব। এক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হচ্ছে, মাস্ক পরা। এ নিয়ে সমাজের একাংশের মানুষের মধ্যে খানিকটা শিথিলতা দেখা যায়। প্রসঙ্গত মানতেই হবে, বাংলার মানুষ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। সম্প্রতি আমি বিহার গেছিলাম। সেখানে দেখলাম সার্বিকভাবে মাস্ক পরার প্রবণতা ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষের মধ্যে আছে। সেখানে বাংলায় অন্তত ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরেন। বাকি যাঁরা এখনও পরছেন না তাঁদের মাস্ক পরতে হবে। স্যানেটাইজ করতে হবে বারবার। সর্বত্র যেখানে যতটা সম্ভব শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলতে হবে। সর্বোপরি, এগুলিকে দৈনন্দিন অভ্যেসে পরিণত করতে হবে। তা হলেই আমরা ওমিক্রনের মোকাবিলা করতে পারব। অযথা ভয় পাবেন না বা আতঙ্কিত হবেন না। প্রশাসনকে সাহায্য করতে হবে। সরকারি নির্দেশনামা মেনে কোভিডবিধি মেনে চললেই আমরা অনতিলম্বে কোভিডমুক্ত, ওমিক্রনমুক্ত সমাজ, দেশ, বিশ্ব পেতে পারি।
এ-সবের মাঝেও আশার আলো, রাজ্যে সরকার নিজের চেষ্টায় লড়ে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন বলে। তিনি আছেন বলেই, বাংলার সাড়ে দশ কোটি মানুষ সরকারি পরিকাঠামোয় বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান এবং বেসরকারি পরিকাঠামোতে ‘স্বাস্থ্যসাথী’র মাধ্যমে পরিষেবা পান। তিনি আছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি ‘দেশটা এখনো গুজরাট হয়ে যায়নি’, বাংলাই আছে।
পরিশেষে একটা কথা বলেতেই হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে গুরুত্ব দিয়ে সব রাজ্যের কথা শোনা। মনে রাখতে হবে, সব রাজ্যে কোভিডের প্রকোপ যেমন এক নয় তেমনই তা মোকাবিলা করার পন্থাও সমান নয়। ফলে কেন্দ্রের উচিত অবিলম্বে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যেকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।