২০১৯ সালে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী (সিএএ) বলবৎ হল। সিএএ হল ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন। এই নতুন আইন ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ,পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে যে-সমস্ত অমুসলিমরা (হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি) ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁদের নির্দিষ্ট নথি ও শর্ত মিলিয়ে নাগরিকত্বের শংসাপত্র দেবে। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক শরণার্থীদের মর্যাদা বিষয়ক সম্মেলনের অনুচ্ছেদ ১এ-তে সংক্ষিপ্ত আকারে শরণার্থীর সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়, সেখানে বলা হয় একজন ব্যক্তি যদি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন ও দেখতে পান যে তিনি জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ ও নির্দিষ্ট সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তাকে সেই দেশের নাগরিকের অধিকার থেকে দূরে সরানো হচ্ছে, সেখানে ব্যাপক ভয়-ভীতির পরিবেশ বিদ্যমান এবং রাষ্ট্র তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তখনই তিনি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন। নতুন বলবৎ হওয়া এই নাগরিকত্ব আইন তাই পরিষ্কারভাবেই শরণার্থীদের প্রতি ঘটা যে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা যার মধ্যে ধর্মীয় সহিংসতা যেমন আছে তেমনি রাজনৈতিক, নির্দিষ্ট আদর্শগত কারণে সহিংসতা রয়েছে সেই জায়গাগুলোকে উপেক্ষা করে নির্দিষ্টভাবে ধর্মীয় সহিংসতার জায়গাটির উপরেই গুরুত্ব আরোপ করেছে। প্রশ্ন আসে যে, ভারত রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের উল্লেখ তাহলে এই আইন কি সেই প্রস্তাবনার পরিপন্থী নয়?
আরও পড়ুন-দিলীপের উসকানিতেই আক্রমণ, জখম তৃণমূল কর্মীকে দেখতে এসে অভিযোগ কীর্তির
তর্কের খাতিরে যদি মেনে চলি যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীরা কেবলমাত্র ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে শরণার্থী হয়ে এই রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছেন তাহলেও তো আইন প্রণয়নকারীদের দৃষ্টি একটু ব্যাপ্ত হওয়া দরকার ছিল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বৌদ্ধদের কথা উল্লেখ থাকলেও জেনে রাখা প্রয়োজন, প্রতিবেশী তিব্বত, নেপাল ও ভুটান থেকেও বিভিন্ন সময় বৌদ্ধরা এদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, বসবাস করছেন বহুদিন। চিনের আগ্রাসনের ভয়ে ১৯৫০ সাল থেকে দলাই লামার অনুগামী অনেক বৌদ্ধধর্মালম্বী মানুষ পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। মূলত দার্জিলিং, কালিম্পং থেকে সিকিমের লাচুং, লাচেনের নানা দিকে তাদের বাস। তাদের আবেদনের জায়গা কোথায়?
আবেদন এবং তার ভিত্তিতে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য দু-রকম নথি জমা দিতে হবে। প্রথম ভাগের জন্য ২০১৪ সালের আগের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে এবং দ্বিতীয় ভাগের জন্য ভারতে প্রবেশ এবং বসবাসের তারিখ সংক্রান্ত প্রমাণ দিতে হবে। প্রথম ভাগের জন্য যে আটটি নথির কথা বলা আছে তার মধ্যে যে কোন একটি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ একাধিকবার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়েছে, তার জেরে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা অনেকে বিভিন্ন সময় ভারতে চলে এসেছেন। প্রশ্ন সেখানেই যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে, সর্বস্ব হারিয়ে যারা আশ্রয় নিলেন ভারতের মাটিতে তাদের পক্ষে এই নথি দেওয়া কীভাবে সম্ভব? সিএএ-র জন্য আবেদন করে উপযুক্ত তথ্যের অভাবে তা খারিজ হলে কী হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। ধোঁয়াশা সেখানেও থেকে যায়। সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে আতঙ্কের আরও একটি দিক ধরা পরে, কে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী আর কে শরণার্থী তা চিহ্নিতকরণের উপায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেই স্পষ্ট নয়, তাই বলা যায় প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে শরণার্থীদের কপালেও হয়তো জুটবে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর তকমা।
আরও পড়ুন-বাংলার পানের জিআই, আবেদন কৃষি বিভাগে
১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা অনেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে চলে এসেছেন। তাদের একটা বড় অংশ নমঃশূদ্র জাতির মানুষ, যাদের অনেকেই মতুয়া ধর্ম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের অধিকাংশের এতদিনে ভারতীয় নাগরিকের প্রাপ্য সব রকম পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা হয়ে গেছে, রেশন কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড-সহ ভোটার কার্ড তাদের আছে এবং তারা নিয়মিত ভারতের নির্বাচনে ভোট দেন। উচ্চশিক্ষা বা কাজের জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন হলে তারা পাসপোর্টও তৈরি করান। সেখানে তারা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নিজেদেরকে উল্লেখ করেন, ভারতের জাতীয় সংগীতে তারা সশ্রদ্ধার সাথে উদাত্ত কণ্ঠে গলা মেলান। নতুন করে সিএএ-তে আবেদন করে ভারতীয় হিসাবে নিজেদেরকে প্রমাণ করা ও ভারতীয় হওয়ার জন্য শপথবাক্য পাঠ করা তাদের পক্ষে অত্যন্ত অমর্যাদার। এই গ্লানি, এই অমর্যাদা ভারতীয়দেরকেই কি অবমাননা করা নয়?
আরও পড়ুন-গোয়ায় খোঁজ মিলল নেপালের মেয়র-কন্যার
সিএএ যে একান্তভাবে একটি ধর্মীয় বিভাজনকারী আইন তা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জায়গাটি থেকেই পরিষ্কার হওয়া যায়। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্টভাবে পার্লামেন্টে জানায় যে ভারতে এই মুহূর্তে ৪০০০০ জন রোহিঙ্গা মুসলমান অনুপ্রবেশকারী বসবাস করছে, এই ৪০০০০ রোহিঙ্গা মুসলমানও মায়ানমার রাষ্ট্র থেকে ধর্মীয় সংঘাতের কারণে বিতাড়িত হওয়া মানুষ যারা প্রকৃতই শরণার্থী কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাদের শরণার্থী হিসাবে মানতে নারাজ মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে, তাদের একমাত্র পরিচয় তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে এই সংকীর্ণ দৃষ্টি কি কোথাও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিটাকে নড়িয়ে দিচ্ছে না? মায়ানমারের রাকাইন প্রদেশে বসবাসকারী এই রোহিঙ্গা মুসলমানরা ২০১২-র পরবর্তী সময় থেকে অনুপ্রবেশ ঘটায় ভারতে, ২০১৪-র পরবর্তী সময়ে সেটা বৃহৎ আকার ধারণ করে। ভারতের সীমান্তে সুরক্ষা প্রদানের জন্য যে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী মোতায়ন থাকে তাদের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের উপরেই ন্যস্ত। তাহলে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর নজর এড়িয়ে এই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের যে অনুপ্রবেশ তা কি সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী-সহ কেন্দ্রীয় সরকারের গাফিলতির দিকটাকে চিহ্নিত করে না?