মা-মাটি-মানুষের সরকারকে অপদস্থ করার একটা পরিকল্পিত প্রয়াস। কিছু লোক বলে বেড়াচ্ছেন— পশ্চিমবঙ্গ, প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা বা সুদূর গ্রিসের মতো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। এ-সব হয় তাঁরা না জেনে বলছেন, নয়তো চক্রান্ত করছেন।
সকলের জ্ঞাতার্থে জানাই, ২০০৩-এ রাজস্ব শৃঙ্খলায় একটা বাঁধন কেন্দ্রীয় সরকার সারা ভারতে দিয়েছেন। এর জন্য একটা আইনও পাশ করেছিল কেন্দ্র। ‘The Fiscal Responsibility and Budget Management Act’। এই আইন সংসদে পাশ করে ২০০৪-’০৫ থেকে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ের জন্য চালু করা হয়। যদিও প্রথম দিকে এটি পশ্চিমবঙ্গে চালু হয়নি, বাম সরকারের বিদায় লগ্নে ২০১১-র ৪ এপ্রিল এটি পশ্চিবঙ্গে কার্যকর হয়েছিল। এই নিয়ন্ত্রণবিধির প্রথম ও প্রধান শর্ত হল, রাজস্ব ক্ষেত্রে গোল্ডেন রুল চালু করতে হবে। অর্থাৎ রাজস্ব ক্ষেত্রে কোনও ঘাটতি চলবে না। দ্বিতীয়ত, রাজকোষ ঘাটতি জিএসডিপির ৩ শতাংশের মধ্যে আনতে হবে। ঋণের অনুপাত জিএসডিপির ৩৫ শতাংশের মধ্যে আনতে হবে। বাকি সব রাজ্য সরকার মানলেও বামফ্রন্ট সরকার এটা মানেনি। তাই শেষ বছরে অর্থাৎ ২০১০-’১১-তে দেখা যায়, পশ্চিবঙ্গে রাজস্ব ঘাটতি ছিল জিএসডিপির ৩.৬ শতাংশ। রাজকোষ ঘাটতি ছিল জিএসডিপির ৪.১ শতাংশ এবং ঋণ ছিল ৪১.৯ শতাংশ। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রথম থেকে এই বিধি মেনে চলছে।
দ্বিতীয় নিয়মানুসারে রাজকোষ ঘাটতি জিএসডিপির ৩ শতাংশের মধ্যে আনতে হবে। এই নিয়ম বর্তমান রাজ্য সরকার কোভিডের আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৯ পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। ২০১৯-’২০ অর্থবর্ষেও রাজ্যের জিএসডিপির ৩ শতাংশ ছিল রাজকোষ ঘাটতি। কিন্তু কোভিডের বছরে প্রত্যেকটি রাজ্যেই বেড়েছে এমনকী কেন্দ্রেও বেড়েছে ঘাটতির পরিমাণ। ২০২০-’২১-এ কেন্দ্রের ঘাটতি ছিল ৯.২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের সেখানে ৩.৪৩ শতাংশ। ২০২০-’২১-এর সংশোধিত বাজেটে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের ঘাটতি যেখানে ৬.৯ শতাংশ সেখানে পশ্চিমবঙ্গের ৩.৬১ শতাংশ। ২০২২-’২৩-এ এটা ধরা হয়েছে ৩.৬৪ শতাংশ। এটা কোভিডের জন্যই বেড়েছে। এখানে উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক রাজ্যেরই রাজকোষে ঘাটতি অনেক বেশি। যেমন কেরল, পঞ্জাব, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় এবং তামিলনাড়ুর।
নিয়মানুযায়ী রাজস্ব ঘাটতির ক্ষেত্রে কোনও ঋণ চলবে না। কিন্তু বাম আমলের শেষ বছরে রাজস্ব ঘাটতি ছিল জিএসডিপির ৩.৬ শতাংশ। বর্তমান সরকার এই ঘাটতি অনেকটা কমিয়ে এনেছে। যেমন, ২০১৯-’২০ অর্থবর্ষে মানে কোভিডের আগের বছরে, রাজস্ব ঘাটতি জিএসডিপির ১.৬ শতাংশ। বামফ্রন্টের শেষ বছরে রাজস্ব আয়ের প্রায় ৯৯ শতাংশ খরচ হয়েছিল শুধু বেতন, পেনশন ও সুদ দিতে। কার্যত ঋণ করেই বামফ্রন্ট পরিকল্পনাব্যয় চালিয়ে ছিল। বামফ্রন্টের শেষ বছরের আগের বছরে ১০০ টাকা রাজস্ব আয়ে ১১২ টাকা খরচ হয়েছিল শুধু মাত্র বেতন, পেনশন, সুদ বাবদ। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে চিত্রটা আমূল বদলেছে।
২০১৯-’২০-তে রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতি ছিল জিএসডিপির ১.৬ শতাংশ। রাজস্ব আয় হয়েছিল ১ লক্ষ ৪২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং বেতন, পেনশন, সুদ বাবদ খরচ হয়েছিল ৯৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা দিয়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকার নানান উন্নয়মূলক প্রকল্পে ব্যয় করেছেন। অর্থাৎ শতকরা ১০০ টাকা রাজস্ব আয়ের ৬৮ টাকা বেতন, পেনশন, সুদ বাবদ খরচ হয়েছে। পরিকল্পনার জন্য খরচ হয়েছে ৩২ টাকা। ২০২০-’২১, কোভিডের বছরেও আয় কমে গেলেও ১০০ টাকা আয়ে বেতন, পেনশন, সুদ বাবদ খরচ হয়েছে ৭৫ টাকা এবং ২৫ টাকা পরিকল্পনা ব্যয়ে খরচ হয়েছে। অর্থাৎ এ-বছরে রাজস্ব আয়ের ৩৭ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল। সেটাই সরকার বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পে ব্যয় করেছেন।
২০২০-’২১-এ রাজস্ব আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। বেতন, পেনশন, সুদ বাবদ খরচ হয়েছে ১০০ টাকায় ৬৭ টাকা। উন্নয়নমূলক ব্যয়ের জন্য উদ্বৃত্ত থেকেছে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বর্তমান বছরে ১ লক্ষ ৯৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। বেতন, পেনশন, সুদ বাবদ খরচ করার পরেও অবশিষ্ট থাকছে ৭৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই খরচের পরেও পরিকল্পনা খাতে রাজ্য ৩৮ শতাংশ টাকা খরচ করতে পারছেন। দেনা করে খরচের প্রশ্নই ওঠে না।
ঋণ করতে হচ্ছে, তবে তা ঋণ পরিশোধের জন্যই করতে হচ্ছে। ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঋণ করছে ৫৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে খরচ হচ্ছে ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০০ টাকা ঋণ করছি আর শোধ করছি ১২০ শতাংশ টাকা। এই মুহূর্তে মার্চ, ২০২৩ সাল পর্যন্ত পশ্চিবঙ্গের দেনা ধরা হচ্ছে ৫ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকার মতো। মার্চ, ২০২২ সাল পর্যন্ত এই দেনা ৫ লক্ষ ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। এটা রাজ্যের জিএসডিপির ৩৬.৫ শতাংশ। এর থেকে বেশি দেনা অনেক রাজ্যের আছে। পাঞ্জাবের দেনা জিএসডিপির ৫৩.৩ শতাংশ। কেরলের দেনা ৩৮.৩ শতাংশ। অন্ধ্রপ্রদেশের ৩৭ শতাংশের বেশি। রাজস্থানের দেনা প্রায় ৪০ শতাংশ। হরিয়ানার ৩৬ শতাংশের বেশি। উত্তরপ্রদেশের দেনা জিএসডিপির ৩৪.৫ শতাংশ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) ঋণ যেখানে ৫ লক্ষ ২৮ হাজার কোটি টাকা, সেখানে উত্তরপ্রদেশের ঋণ ৬ লক্ষ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। তামিলনাড়ুর ৬ লক্ষ ৫৯ হাজার কোটি। মহারাষ্ট্রের ৬ লক্ষ ৯ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ বেশি ঋণ নেয় এটা ভুল কথা। আর কেন্দ্র তো পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য ৯০ হাজার কোটি টাকাই দিচ্ছে না। তা যদি দিত, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ আরও ভাল জায়গায় থাকত।
সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) আর্থিক অবস্থা নিয়ে যাঁরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ঘুম নেই’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিক্ষোভ’ কবিতার লাইন ধার করে বলি— ‘যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি’।