কোষের মধ্যে থাকা ক্রোমোজোমের ভেতরের ডিএনএকে বলা হয় বংশগতির ধারক ও বাহক। শিশুর জন্মের পর তাদের আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং সবকিছুই এই ডিএনএর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই ক্রোমোজোমের ত্রুটি বা বলা যেতে পারে জিনগত ত্রুটির কারণে হওয়া জন্মগত অসুখ হল ডাউন সিনড্রোম। ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা বা সহজ কথায় অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের কারণে এই রোগ হয়। শিশু যখন মাতৃগর্ভে ভ্রূণ অবস্থায় একেবারে শুরুর দিকে থাকে তখনই তৈরি হয় জন্মগত ত্রুটি। বিশদে বললে শিশুর কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে অর্থাৎ ৪৬টা। যা অর্ধেক মায়ের থেকে এবং অর্ধেক বাবার থেকে আসে। যার মধ্যে ২১ নম্বর ক্রোমোজোমটি কিন্তু এক জোড়া থাকে না, তিনটে থাকে। অর্থাৎ ডাউন সিনড্রোমের শিশুর ৪৭টা ক্রোমোজোম থাকে। তাই এই ক্রোমোজোমের অন্য নাম হল ট্রাইজোমি ২১। এই রোগ নিয়ে কোনও শিশু যখন জন্মায় তার মধ্যে কিছু শারীরিক এবং মানসিক ত্রুটি বা অসুবিধা দেখতে পাওয়া যায়। ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাংডন ডাউন প্রথম এই রোগটির কথা বলেন এবং তা চিহ্নিত করেন। তাই এর নাম ডাউন সিনড্রোম। আর ২১, ৩ বলে মার্চ মাসের ২১ তারিখে ওয়ার্ল্ড ডাউন সিনড্রোম ডে পালিত হয়।
কী হয় ডাউন সিনড্রোমে
ডাউন সিনড্রোম রয়েছে যে শিশুর তার অন্য স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে শারীরিক বাড়বৃদ্ধি এবং বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ অনেকটাই কম হয়। বসতে শেখা, দাঁড়াতে শেখা, হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা সবটাই দেরিতে হয়।
চেহারার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নজরে পড়ে যেমন গলা এবং ঘাড়ের গঠন ছোট হয়।
মুখ একটু ফোলা হয়। মাংসপেশি শিথিল হয়, দাঁতের গঠন এলোমেলো হয়।
চোখ একটু উপরের দিকে ওঠা থাকে এককথায় আমন্ডের মতো আকৃতির চোখ হয়। চোখের দৃষ্টিতে সমস্যা থাকে।
চোখের ওপরের পাতায় অনেকের স্পট থাকে। শিশুর নাক এবং কানের আকার ছোট হয়। শ্রবণশক্তিতে সমস্যা থাকে।
ত্বক খুব রুক্ষ, খসখসে হয়। পায়ের আঙুলের মাঝের অংশে অনেকটা ফাঁক থাকে। বিশেষ করে বুড়ো আঙুল ও তার পাশের আঙুলের মাঝে। হাত এবং পায়ের আকার এবং আঙুলও ছোট হয়।
থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েডিজম। যেটা ডাউন সিনড্রোমের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
ঘন ঘন শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ হয়। হার্টের সমস্যা থাকে। অন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়।
কেন হয় ডাউন সিনড্রোম
বেশি বয়সে মা হলে বিশেষ করে ৩৫ বছর বয়সের পরে সন্তান নিলে সেই সন্তানের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। এ-ছাড়া কোনও মায়ের আগে এমন বৈশিষ্ট্যের শিশু থাকলে পরেও ডাউন শিশুর জন্ম হতে পারে।
আবার কিছু ক্ষেত্রে পরিবেশদূষণ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণেও ডাউন শিশুর জন্ম হতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
প্রতিরোধের উপায়
গর্ভাবস্থার প্রথম ২৪ সপ্তাহের মধ্যে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার রয়েছে যার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোম শনাক্ত করা যায়। যেমন কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পেলিং, অ্যামনিওসেন্টেসিস ইত্যাদি টেস্টগুলো দশ থেকে পনেরো সপ্তাহের মধ্যে করানো যেতে পারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে। এ-ছাড়া আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে গর্ভের শিশুর নাকের হাড় দেখা, মায়ের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোমের উপস্থিতি নির্ণয়— এ-সবের মাধ্যমে গর্ভের শিশুটির ডাউন সিনড্রোমে আছে কি না, তা সহজেই যাচাই করা যায়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, গর্ভবতীরা তাঁদের গর্ভাবস্থার খুব প্রাথমিক সময় থেকে যদি চিকিৎসকের কাছে যান ও নির্দিষ্ট সময় অন্তর যদি সব পরীক্ষা করান গর্ভের পরিস্থিতি জানতে পারবেন সঠিকভাবে। পরবর্তীতে গর্ভধারণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে সেই দম্পতি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং অসুখ ধরা পড়লে ৯৭ শতাংশ প্রসূতি গর্ভপাত করিয়ে নেন। তবে এই পরীক্ষাগুলি বেশ ব্যয়সাপেক্ষ তাই অনেকেই এড়িয়ে যেতে গিয়ে বিপদে পড়েন।
জন্মের ৬ ও ১২ মাসের মাথায় এবং তারপর বছরে একবার করে শিশুর শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষা করতে হবে। জন্মের ৬ মাসের মাথায় প্রথমবার এবং তার পর বছরে একবার থাইরয়েড প্রোফাইল চেক করতে হবে। ২ বছর বয়স থেকে প্রতি ৬ মাসে একবার দাঁত পরীক্ষা জরুরি। ২-৩ বছরের মাথায় অন্ত্রের পরীক্ষা দরকার। ৩-৪ বছরের মাথায় জানতে হয়, শিশুর অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে কি না। ৩-৫ বছরের মাথা-ঘাড়ের এক্স-রে করে দেখে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়মতো পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে ডাউন সিনড্রোম শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবন যাপন করতে পারে।
যেহেতু মায়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাউন সিনড্রোম শিশু হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে, তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে বেশি বয়স বিশেষ করে ৩৫-এর উপর যাঁদের বয়স তাঁদের মাতৃত্ব নেবার সময় খুব সতর্ক এবং সচেতন হতে বলা হয়। সব রকম পরীক্ষা করে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
কোনও মায়ের আগের বাচ্চা যদি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত থাকে, তবে পরের বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কীভাবে পরিচালনা করবেন
প্রথমত, হতাশ হবেন না। শারীরিকভাবে কোনও অঙ্গ প্রভাবিত না হলে এটি কোনও গুরুতর রোগ নয়। এই রোগীকে সহজেই পরিচালনা করা যেতে পারে। এই ধরনের শিশুদেরও আলাদা স্কুল আছে এবং মানসিকভাবে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে তারা সাধারণ স্কুলেও ভর্তি হতে পারে এবং আর পাঁচজন বাচ্চার মতোই সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে।
ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর সার্বিক বিকাশ ব্যাহত হয় তাই পরিবার তথা বাবা এবং মায়ের যত্ন ও উৎসাহ জরুরি। শিশুকে তার শারীরিক এবং মানসিক বাধা পেরিয়ে যেতে সাহায্য করতে একজন সঠিক ডাক্তারের সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ রাখুন এবং নিয়মিত চেকআপ করাতে থাকুন। স্পিচ থেরাপি করান, যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে। স্পেশাল এডুকেশন এবং কাউন্সেলিং করাতে থাকুন, যাতে মানসিক রোগ শনাক্ত করা যায় এবং সময়মতো নিরাময় করা যায়।
ডাউন সিনড্রোম
‘ওয়ার্ল্ড ডাউন সিনড্রোম ডে’। প্রতিবছর ২১ মার্চ এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী এই রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাশাপাশি ২১তম ক্রোমোজোমের ত্রিগুণ বা ট্রাইসোমি-র স্বতন্ত্রতাকে বোঝানো। ডাউন সিনড্রোম একটি জিনগত ত্রুটিজনিত জন্মগত অসুখ। সঠিক পরিচালনা এবং যত্ন এই অসুখে আক্রান্ত শিশুকে দিতে পারে স্বাভাবিক জীবন। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী