ঘুরে দেখুন রাঢ়বাংলার দুর্গাপুজো

বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শক্তি সাধনার নানা পীঠ, পীঠস্থান। কয়েকটি আছে রাঢ় বাংলার জেলাগুলোয়। সেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে হয় মাতৃ আরাধনা। পুজোর সময় টুক করে ঘুরে আসতে পারেন। নিজস্ব গাড়ি ছাড়াও যেতে পারেন বাসে অথবা ট্রেনে। সরকারি, বেসরকারি অতিথি নিবাসে দু-একদিন যায় থাকা। রাঢ়ের কোন কোন মাটির পুজো মণ্ডপ ঘুরে দেখা যায়, লিখলেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

কয়রাপুরের দেবী অষ্টভুজা
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম ১ নং ব্লকের বিল্বগ্রাম অঞ্চল। সেখানে বর্ধমান সিউড়ি এনএইচ টু-বি রোডের ধারে কয়রাপুর গ্রামে সুবৃহৎ মন্দিরে রয়েছেন দেবী। মন্দিরটি উঁচু একরেখ দেউলের আদলে তৈরি। একটি গোলাকার চ্যাপ্টা চূড়া মন্দিরের (Rarh Bengal- Durga Puja) শীর্ষে লৌহ শলাকা গাঁথা। মন্দির চত্বরে বেদীর উপরে কালো কষ্টিপাথরের খোদিত, দুই ফুটের মতো উচ্চতা বিশিষ্ট অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী মূর্তি পূজিতা হয়ে আসছে। গ্রামের অনেকেই এই দেবীকে ত্রৈলোকতারিণীও বলে।

উজানি নগরের দেবী মঙ্গলচণ্ডী
পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের অজয়-কুনুর সঙ্গমস্থলে উজানিনগর। রাজা বিক্রমাদিত্যের প্রাচীন রাজ্যপাটের স্মৃতিধন্য অজয় তীরে কোগ্রাম গ্রাম। কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের স্মৃতি বিজড়িত সেই গ্রামেই দেবী মঙ্গলচণ্ডীর আটন। আটনটি পৌরাণিক ৫১ পীঠের অন্যতম। বহুকাল আগে সেই মূর্তি চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে প্রাচীন মূর্তির আদলে কষ্টিপাথরের আকর্ষণীয় সিংহবাহিনী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মূর্তিটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদরঞ্জনের পৌত্র সুধেন্দু মল্লিক।

মানকরের আনন্দময়ী মা
গোপভূমের রাজধানী অমরাবতীর নামের অমরারগড়ের গ্রাম থেকে সামান্য পশ্চিমে বুদবুদ গুসকরা পাকা পিডব্লুডি রোডের ধারে, মানকর গ্রামের সন্নিকটে বিখ্যাত কবিরাজ বাড়ির উল্টোদিকে পুকুরপাড়ে রয়েছে আনন্দময়ী মা। এখানকার পুজো (Rarh Bengal- Durga Puja) করেই নাকি বর্ধমান মহারাজার মান থাকত। তাই গ্রামের নাম ‘মানকর’। আর ইতিহাস খ্যাত কবিরাজরা ছিলেন বর্ধমান রাজ পরিবারের রাজবৈদ্য। সেই মানকর গ্রামে অতীত দিন থেকেই শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য ছিল। তার পাশাপাশি ছিল শক্তি সাধনার প্রাধান্য। মানকরের বৈদ্য কবিরাজদের কুলদেবী আনন্দময়ী শক্তিমূর্তি।

মাড়োর মা খড়্গেশ্বরী
গোপভূম পরগনার আউশগ্রাম ২ নং ব্লকের মানকর গ্রামের পশ্চিমে মাড়ো প্রাচীন গ্রাম। এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন নিত্যানন্দ বংশীয় পরম পণ্ডিত রঘুনন্দন গোস্বামী। বহু গ্রন্থের সঙ্গে ‘রামরসায়ন’ মহাকাব্যও রচনা করে বিখ্যাত হন তিনি। গোস্বামী পরিবারের রাধামাধবের বিগ্রহ পরম নিষ্ঠার সঙ্গে পূজিত হলেও, গ্রাম্য দেবী হিসেবে খড়্গেশ্বরী দেবী বহু প্রাচীনকাল থেকেই পূজিতা হয়ে আসছেন।

দেবী শাকম্ভরী
প্রাচীন গোপভূমের অন্তর্গত মঙ্গলকোট থানার মাজি গ্রামের গ্রাম্য দেবী শাকম্ভরী। বর্ধমান কাটোয়া ভায়া নতুনহাট বাসে সরাসরি মাজিগ্রামে যাওয়া যায়। দেবী শাকম্ভরীকে শস্যের দেবী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। যিনি সকলকে ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য শাক, ফলমূল প্রদান করেন। তাই দেবী ‘শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যস্যাম্যহং ডুবি’ বা দেবী শাকম্ভরী নামে খ্যাত। কালো কষ্টিপাথরে খোদিত চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি এখানে শাকম্ভরী নামে খ্যাত। দেবীর চার হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, ত্রিশূল ও কৃপাণ। পদতলে মহিষাসুর মোষের পেট থেকে অর্ধনির্গত অবস্থায় যুদ্ধরত। মূর্তির উচ্চতা প্রায় দেড় ফুটের মতো।

পশ্চিম বর্ধমানের কল্যাণেশ্বরী
পশ্চিম বর্ধমান জেলার বরাকর নদীর পূর্ব প্রান্তে কুলটি থানা এলাকার হালদা পাহাড়ে চালানদহের পাশেই ইতিহাসের কল্যাণেশ্বরী মন্দির অবস্থিত। পূর্বে এই এলাকা ছিল জঙ্গলে ভর্তি। বরাকর থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান। ‘ধলেতে রঙ্কিণী মাগো শিখরে কল্যাণী’— এই লোকগাথাটি ছড়িয়ে রয়েছে দেবীকে ঘিরে। ধলভূমের রঙ্কিণী দেবী শিখরভূমে মা কল্যাণেশ্বরীতে পরিণত হয়েছে।

মা বিশালাক্ষী
গলসী থানার খড়ি নদীর দক্ষিণে চান্না গ্রাম অবস্থিত। গ্রামের উত্তরে নির্জন মাঠের মধ্যে গ্রাম্য দেবী বিশালাক্ষী মায়ের মন্দির। কমলাকান্তের কালী নামে পরিচিত হয়েছিল। সেই কমলাকান্তই প্রথম জীবনে এই চান্না গ্রামের বিশালাক্ষী মা-র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। খড়ি নদীর কোল ঘেঁষে নির্জন স্থানে বিশালাক্ষী মায়ের মন্দির। যদিও বহু আগে মায়ের সেই মূর্তি চুরি হয়ে গেছে। বর্ধমানের রাজা তেজচাঁদবাহাদুর পুকুর-সহ মাতৃপূজার জন্য নব্বই বিঘা জমি দান করে গেছেন।

কুমীরকোলা জমিদার বাড়ির পুজো
বিদ্যা, বুদ্ধি, বৈভব এবং বিচক্ষণতায় বাংলার গৌরব জমিদার পিয়ারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সন্তান কামনায় দেবীর স্বপ্নাদেশে কুমীরকোলা গ্রামে দুর্গাপুজো (Rarh Bengal- Durga Puja) শুরু করেছিলেন। ১৮৩০ খ্রিঃ এই গ্রামে দেবখালের বুকে ভেসে আসা দুর্গা প্রতিমার ঠাট সযত্নে তুলে এনে শুরু করেছিলেন শারদোৎসবের ।

লাউদোহা জমিদার বাড়ির পুজো
পশ্চিম বর্ধমানের লাউদোহা থানার নাচন গ্রাম জিটি রোডের গান্ধীমোড় থেকে সাত কিমি দূরে। প্রাচীন কালে মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে রানি হরসুন্দরীর দেওয়ান রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায় কাশীতে থাকার সময় স্বপ্ন দেখে এই সিংহবাহিনীর পুজো শুরু করেছিলেন। লাউদোহা নাচন গ্রামে বাবুদের দুর্গাপুজো ১৮৭০ সালের। মহা অষ্টমীর দিন এখানে শ্বেত পাঁঠাবলি হয়। নবমীতে ১৫-২০টি কালো পাঁঠা পড়ে। নহবত আসে গৌরবাজার থেকে। ঢাকিরা আসেন অজয় পাড়ের গ্রাম থেকে।

গুসকরার চোংদার বাড়ির পুজো
কলকাতা, বিহারের ধূলিয়ান ও সুলতানগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় গুসকরার জমিদার চোংদারের প্রতাপ ছিল। এখন সে জৌলুস কমেছে। বড় বড় থামের বিশাল দুর্গামন্দিরটি দেখার মতো। অতীত দিনে বাহান্নটি উনুন জ্বেলে ঠাকুরের ভোগ রান্না হত। ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় হত পুজো। যাত্রা হত। বিখ্যাত আলাউদ্দিন খান ঢাক বাজাতেন। শশী অধিকারীর দল আসতেন যাত্রা করতে। নবমীতে মোষ বলি ছিল এবং মোষের মাথা নিয়ে বলির পর শুরু হত কাড়াকাড়ি।

আরও পড়ুন-কোন্নগর আনন্দ আশ্রমে পূজিতা ১৮ হাতের দুর্গা

দেবী বাড়াইচণ্ডী
প্রাগৈতিহাসিক যুগের সময়কার সৃষ্টি পাষাণদেবী পাণ্ডুকের বাড়াইচণ্ডী। বেশ কয়েকটি চণ্ডীর মূর্তি পাললিক শিলার এখনও স্থানটিতে পড়ে আছে। স্থানটি পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম থানার রামনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় পড়ে। সেখানকার ‘পাণ্ডু রাজার ঢিবি’র পাশে স্থানটি পাণ্ডুক গ্রামে অবস্থিত। জানা যায় বাড়াইকে বিধর্মী সাধক কালাচাঁদ রায় কেটে দেন।

কাটোয়ার গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ির পুজো
কাটোয়ার গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ির পুজো পুরানো তালপাতার পুঁথি ধরেই পুজো হয়। এই পুজো ষষ্ঠীতলার গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ির পুজো বলে খ্যাত। শুধু তাই নয়, পুজোয় জোড়া ইলিশ মাছ দিয়ে ভোগ নিবেদন করতে হয় দেবীকে। এই রেওয়াজ চলে আসছে প্রায় ৩৫০ বছর ধরে। কাটোয়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ষষ্ঠীতলার গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল উমেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। কিন্তু বর্তমানে বংশধর না থাকায় দৌহিত্ররাই পুজোর দায়িত্ব নেন।

কেতুগ্রামের সীতাহাটির দুর্গাপুজো
কেতুগ্রামের সীতাহাটিতে চট্টোপাধ্যায় জমিদার বাড়ির দুর্গোৎসব ভাগীরথীর দুই পাড়ের মেলবন্ধনের পুজো হিসাবে পরিচিত। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে সীতাহাটির তৎকালীন জমিদার জগবন্ধু চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে এই পুজো শুরু হয়েছিল।

বীরভূমের বিপ্রটিকুরি গ্রামের দুর্গা
বীরভূমের বিপ্রটিকুরি। এই গ্রামের ঐতিহ্য, বেশ প্রাচীন। ষষ্ঠীর দিন থেকে শুরু হয় গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পুজো। এই প্রস্তুতি পুজোর দু-তিন মাসে আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। কাশফুল ও দেওয়ালে আলকাতরার গন্ধ গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ভালবাসার হাত ধরে। সপ্তমীর সকালে গ্রামের সমস্ত প্রাণ একত্রিত হয় সাজারবাড়ির প্রাঙ্গণে। আনন্দ ভাগ করে নেয় একে-অপরের সঙ্গে। কেউ ঘট হাতে, কেউ কাঁধে দোলা নিয়ে মানুষের ভিড়ে এগিয়ে যায় তার শূন্যতা পূরণ করতে।

বীরভূমে বাংলাদেশের পুজো
প্রতিবছর দুর্গাপুজোর আগে পুকুর পাড়ে পাওয়া যেত মোহর। সেই মোহর বিক্রি করেই দুর্গাপুজোর খরচ উঠত। মা মনসাই নাকি সেই সমস্ত মোহর দিতেন। একসময় মোহর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন মা মনসা। আর তারপরে হয়েছিল দেশভাগ। বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ধামরাই গ্রামের সেই দুর্গাপুজো এখন হয়ে থাকে বীরভূমের সিউড়ির মালিপাড়ার বসাক বাড়িতে। অনেকে একে ‘বাংলাদেশের মায়ের পুজো’ বলে থাকেন।

বাঁকুড়ার পাঠক পাড়ার দুর্গা
প্রায় ১২৫ বছরেরও আগের কথা। আকাশে বাতাসে মা জানান দিচ্ছেন তিনি আসছেন বাপের বাড়ি। পাশের পল্লি পাড়ার বেশ কিছু মহিলা গান করতে করতে গন্ধেশ্বরী নদীতে ভাদু বিসর্জন দিতে যাবার দৃশ্য চোখে পড়ে বাঁকুড়া শহরের পাঠক পাড়ার তৎকালীন বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। সেখানে বসেই তাঁরা ঠিক করলেন পাঠক পাড়াতেও মায়ের পুজো শুরু করলে কেমন হয়। যদিও পাঠক পাড়ার মানুষরা দুর্গাপুজোয় ঘটক পাড়াতে অংশগ্রহণ করত। অবশেষে নিজেদের পাঠকপাড়ার বিষ্ণু মন্দিরের আটচালায় শুরু হল মাতৃ আরাধনা।

Latest article