নয় বছর বয়স হয়ে গেল মোদি শাসনের। এই মহালগ্নে সংসদ ভবন নরেন্দ্র মোদির তরফে ভারতবাসীকে উপহার নয়, এটা আসলে ভারতবাসীকে দেওয়া গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত। এখন এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, মোদি জমানায় হিন্দুত্বের আগ্রাসী প্রচার চালাচ্ছে গেরুয়াবাহিনী। হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইতিহাস মুছে ও বদলে দেওয়া হচ্ছে। মন্দির নির্মাণ ও সেখানে যাতায়াতের আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলাটাই এই সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। হিন্দু-হিন্দুত্ব-হিন্দুত্ববাদ করার জন্য অন্য ধর্ম, বিশেষত সংখ্যালঘুদের উপর সবধরনের আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। এবার সংসদের মতো গণতন্ত্রের সর্বোৎকৃষ্ট ভবনের উদ্বোধনেও সোচ্চারে ঢুকে পড়েছে ধর্মীয় আচার-বিচার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকল কি না সেই সঙ্গত প্রশ্নটি উঠেছে। দেশ দেখল, রবিবার রাজধানীর বুকে গণতন্ত্রের পীঠস্থানে যেন মোদি নামক এক দুর্বিনীত, আত্মপ্রচারসর্বস্ব ব্যক্তির ‘রাজ্যাভিষেক’ ঘটল। এটাই মোদি জমানার নবম বর্ষে ভারতীয় জনগণের পরম প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন-মোবাইকে হাসপাতালে
রেসলিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান তথা বিজেপি এমপি ব্রিজভূষণ শরণের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন অলিম্পিক পদকজয়ী কুস্তিগিররা। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও দিল্লি পুলিস অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তাই ব্রিজভূষণের গ্রেপ্তার এবং কঠোর শাস্তির দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন কুস্তিগিররা। এই ইস্যুতে রাজধানীর রাজনীতি মাসাধিকাল যাবৎ উত্তাল। সুবিচারের আশায় দিল্লিতে ধর্নায় বসেন বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগতের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগিররা। কিন্তু পদকজয়ীরা সেখানে উল্টে পুলিসি হিংসার শিকার হলেন। এদেশে বরাবরই আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়াবিদের আকাল। হাতেগোনা কয়েকজন নিতান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশের পতাকা উঁচুতে তুলে ধরতে সফল হন। আর সেই তাঁদেরই বিরুদ্ধে মোদি সরকারের এই লজ্জাজনক ভূমিকা নিঃসন্দেহে মোদি জমানার নবম বর্ষে পরম প্রাপ্তির তালিকায় থাকবে।
আরও পড়ুন-স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স
বিধানসভা ভোটের প্রচারে বেরিয়ে কর্ণাটকের মানুষকে হুঁশিয়ার করেছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, কংগ্রেস জিতলে রাজ্যে দাঙ্গা বাধবে! অন্য কয়েকটি বিরোধী রাজ্যে দাঙ্গার প্রসঙ্গও টেনেছিলেন তিনি। কিন্তু তুলনায় ক্ষুদ্র একটি ডাবল ইঞ্জিন রাজ্য মণিপুরে আগুন জ্বলছে একমাস ধরে, তা থামেনি এখনও। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য প্রথমে কার্ফু জারি এবং ইন্টারনেট বন্ধ করার মতো একাধিক সস্তা পন্থা নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে সাময়িক বিরতির পর ফের শুরু হয় গোষ্ঠী সংঘর্ষ এবং তা ভয়াবহ আকার নেয়। তীব্র হানাহানিতে অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছেন। অথচ, ৩ মে অশান্তির শুরুতেই বিভিন্ন মহল থেকে কেন্দ্রের তরফে কঠোর পদক্ষেপের দাবি ওঠে। তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমস্যাটিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কারণ সেসময় তাঁকে শুধু কর্ণাটক নিয়েই ব্যতিব্যস্ত দেখা গিয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবিবো সিং দাবি করেছেন, এখন মণিপুর যেভাবে জ্বলছে, এই রাজ্যের ইতিহাসে তার কোনও নজির নেই। এটাই নবম বর্ষীয় মোদি জমানায় পরম পাওয়া।
আরও পড়ুন-গদ্দারকে জবাব দিল তৃণমূল কংগ্রেস
ঠিক রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ নয়। আসলে একটা ভয়ের জন্ম হয়— যখন আমরা জানতে পারি রাষ্ট্র তার দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করছে। আবার রাষ্ট্রকে দেশবাসী বিশ্বাসও করছে না। রাষ্ট্র তার দেশবাসীকে মানুষ হিসেবে নয়, পুতুল হিসেবে দেখছে। রাষ্ট্র ভাবছে, আমি যখন যা করব, সেটা দেশবাসীর মেনে নেওয়াই ভবিতব্য। সে প্রতিবাদ করলেই তাকে অ্যান্টি ন্যাশনাল বলা হবে। এই উপলব্ধিই মোদি জমানার বছরে আম জনতার চরম প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন-ED-CBI ওকে জেলে ঢোকাবে: নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে শুভেন্দুকে তোপ অভিষেকের
আমরা ভোট দিই। আমরা আয়কর দিই। আমরা জিএসটি দিই। আমরা প্রতিটি আইন মেনে চলি। যখন যা নির্দেশ আসে, সেগুলি পালন করি। কিন্তু রাষ্ট্র এসবের বিনিময়ে আমাদের শাস্তি দিচ্ছে। কিছু না কিছু কারণে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে। এই কার্ডের সঙ্গে ওই কার্ডের লিঙ্ক। সেই কার্ডের কেওয়াইসি। আধার আপডেট না করলে সুবিধা মিলবে না। যখন-তখন আমাদের পরিকল্পিতভাবে হেনস্থা করা চলছে। আর রাষ্ট্র যখন-তখন এমন সব সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে, যাতে আমাদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ আবার বাধাপ্রাপ্ত হয়। নতুন নতুন চিন্তা, উদ্বেগ, সমস্যার পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ২০১৬-র নভেম্বর মাসে দুটি নোট বাতিল করে দিয়ে নতুন নোট চালু করে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল এবার আর কোনও সমস্যা আসবে না।
আরও পড়ুন-নবজোয়ারে অভিনন্দন
সাধারণ নাগরিক যদি সরকারের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তার ঘরে যখনই সময় পেয়েছে ২ হাজার টাকার নোটই সঞ্চয় হিসেবে জমিয়ে রেখেছে। আইনত বৈধ নোট সে রেখেছে অসময়ের ভরসা হিসেবে। কিন্তু সে দেখল, যে কোনও সময় যে কোনও নোটই সরকার বাতিল করে দিতে পারে। এরকম একটি বার্তাই সরকার দিতে চায়। অর্থাৎ মানুষকে সর্বদা একটি অনিশ্চয়তার জীবনের দিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এরপর আর কি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে কোনও টাকাকে ভরসা করবে? লেনদেনে বিশ্বাস থাকবে? এই সংশয়-দীর্ণতাই মোদি জমানার নয় বছরে নিট প্রাপ্তি।