একডালিয়া এভারগ্রিন–এর দুর্গাপুজো ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রাণ। পুজোর সমস্ত পরিকল্পনা করতেন নিজেই। থিম নয়, পছন্দ করতেন সাবেকিয়ানা। জানালেন তাঁর দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী স্বপন মহাপাত্র
১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে আমি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী। তাঁর ছোট-বড় সব ঘটনার সাক্ষী। একডালিয়া এভারগ্রিনের দুর্গাপুজো ছিল সুব্রতদার প্রাণ। ওঁর হাত ধরেই এই ক্লাবে আমার আসা। তারপর ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে পড়ি। গত পনেরো বছর ধরেই আমি বিশেষ দায়িত্ব পালন করছি।
বর্তমানে আমি কোষাধ্যক্ষ। সুব্রতদা ছিলেন সভাপতি। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবকিছুতেই আমার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। কীভাবে পুজো করতে হয়, শিখেছি সুব্রতদার কাছে। উনি সাবেকিয়ানা পছন্দ করতেন। থিমের পুজো একেবারেই পছন্দ করতেন না। যদিও যেতেন বিভিন্ন থিম পুজোয়।
তবে নিজের পুজোয় বরাবর সাবেকিয়ানা বজায় রেখেছেন। পুজোর খুঁটিনাটি বিষয়ে ছিল তাঁর নজর। প্রতিমা তৈরির সময় নিজে কাপড়ের দোকানে গিয়ে ঠাকুরের জন্য বেনারসি বাছাই করে কিনতেন। আগে আমাদের প্রতিমা শিল্পী ছিলেন রমেশ পাল। এখন এই দায়িত্ব পালন করেন সনাতন রুদ্রপাল।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় আরও তিন মামলা কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে
প্রতিমা কীরকমের হবে সুব্রতদা শিল্পীকে বুঝিয়ে দিতেন। দুর্গা কীভাবে দাঁড়াবে, মহিষাসুর কেমন হবে সবকিছু নিজে ঠিক করে দিতেন। ভালবাসতেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। আসলে তাঁর শয়নে স্বপনে জাগরণে ছিল একডালিয়া এভারগ্রিনের দুর্গাপুজো।
গত দুই বছর কোভিডের জন্য রাজ্যের পুজোর চেহারায় কিছুটা বদল ঘটেছে। কিন্তু একডালিয়া এভারগ্রিন নিজের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। আমাদের প্যান্ডেলে আমরা তুলে ধরেছি বিভিন্ন মন্দির। কখনও দক্ষিণ ভারতের, কখনও নেপালের কোনও মন্দির। তারমধ্যে আমরা মা-কে প্রতিষ্ঠা করেছি।
এই মণ্ডপ নির্বাচন ফটো দেখে হত না। এখন আমাদের মণ্ডপ নির্মাণ করেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার শিল্পীরা। উনি শিল্পীদের চেন্নাই বা নেপাল পাঠাতেন। যে-মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি হবে সেটা দেখে আসার জন্য। শিল্পীরা নিখুঁতভাবে মন্দির দেখে ছবি তুলে আনতেন। তারপর আলোচনা করে মণ্ডপ তৈরি করতেন। এই ভাবনাও সুব্রতদার।
আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগর মেলা আসবে, থাকবেন না প্রাণপুরুষ
আমাদের পুজোয় আলোকসজ্জা হয়। আগে চন্দননগর থেকে আসত। এখন আসে খড়দা থেকে। সবাই আমাদের আলোকসজ্জা পছন্দ করেন। এই ক্ষেত্রেও মূল পরিকল্পনা সুব্রতদার। আমাদের পুজো হয় নিষ্ঠার সঙ্গে। সংকল্প হত সুব্রতদার নামেই। নিজেই বসতেন সকাল এবং সন্ধেবেলার পুজোয়। উনি ফতোয়া জারি করে দিয়ে চলে যেতেন না। যতটা সম্ভব নিজে উপস্থিত থাকতেন। সবার সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করতেন।
আমাদের পুজোয় মা-কে বিভিন্ন রকমের ভোগ দেওয়া হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, সকালে এবং বিকেলে। সেই ভোগ কোনও সাধারণ ভোগ নয়। খিচুড়ি, পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, তিন রকমের তরকারি, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি। এককথায় রাজকীয় ভোগ।
সুব্রতদা মায়ের এই প্রসাদ পাঠাতেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে আরম্ভ করে সমাজের বহু বিশিষ্ট মানুষের বাড়িতে। সুব্রতদা খেতে এবং খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। পছন্দ করতেন সাবেকি খাবার। বাঙালি খাবার। প্রিয় ছিল মিষ্টি এবং আম। এককথায় মিষ্টির অনুরাগী ছিলেন। বহরমপুরের ছানাবড়া, জনাইয়ের মনোহরা খুব ভালবাসতেন।
একডালিয়া এভারগ্রিনের প্রতিমা নিরঞ্জন হত বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে। পুজোর পরে হত বিজয়া সম্মিলনী। সেখানেও মধ্যমণি সুব্রতদা। নিজে শিল্পী পছন্দ করতেন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বহু বিশিষ্ট শিল্পী সংগীত পরিবেশন করেছেন। শ্রীকান্ত আচার্য, শুভমিতা, রূপঙ্কর, জয়তী চক্রবর্তী এই অনুষ্ঠানে গান গেয়ে গেছেন। এছাড়াও পুজোর পর পাড়ার লোকেদের নিয়ে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করতেন। বহু বিশিষ্ট মানুষ তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এসেছেন।
আরও পড়ুন-বামেদের কাছ থেকেও আদায় করেছেন সন্মান
সুব্রতদা একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রীও। থাকতেন খুব ব্যস্ত। তবু সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন। শুনতেন এলাকার সুবিধা- অসুবিধার কথা। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় নবান্ন থেকে ফিরে আসতেন একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে সবার সঙ্গে বসে গল্পগুজব করতেন। কেউ মিষ্টি দিয়ে গেলে উনি একা খেতেন না। সবার সঙ্গে ভাগ করে খেতেন।
৭৯ বছর হল একডালিয়া এভারগ্রিনের দুর্গাপুজোর। অসুস্থ শরীর নিয়েই এই বছরের পুজোয় উপস্থিত ছিলেন সুব্রতদা। সামনের বছর পুজোর ৮০ বছর।