সবুজ মেরুন ভদ্রলোক

তাঁর হঠাৎ প্রয়াণে নিঃস্ব শতবর্ষপ্রাচীন ক্লাব। সবুজ-মেরুনে এখন পড়ে আছে শুধু তাঁর স্মৃতিকথা। লিখলেন অলোক সরকার

Must read

লিগের ম্যাচে তিনি হাজির থাকবেনই। শত ব্যস্ততাতেও নিপাট ধুতি-পাঞ্জাবিতে মোহনবাগান মাঠে হাজির হতেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর হঠাৎ প্রয়াণে নিঃস্ব শতবর্ষপ্রাচীন ক্লাব। সবুজ-মেরুনে এখন পড়ে আছে শুধু তাঁর স্মৃতিকথা। লিখলেন অলোক সরকার

ভরসন্ধ্যায় ফ্লাড লাইটের নিচে বসতে পারলেই শান্তি। মখমল মোলায়েম সবুজ ঘাসের উপর আলোর ঢেউ দেখতে খুব ভালবাসতেন দাদা। মোহনবাগনিরা দাদাই বলেন। বড় দাদার মতো কাছে টেনে নিতেন সবাইকে। তখন কোথায় তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা। পাশের বাড়ির সুব্রতদা হয়ে সবার খোঁজ নিতেন।

আরও পড়ুন-থিম নয় সাবেকিয়ানা

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলতেন, বুঝলি, ক্লাবে এলে খুব শান্তি পাই। মনে হয় যতক্ষণ পারি বসে থাকি।
ক্লাব লনে আসর জমিয়ে বসতেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি। সুদর্শন চেহারা। মুখে সেই হাসি। মোহনবাগানিরা বলেন, এই হাসি শুধু সুব্রতদাই পারেন। চেনা-অচেনা সবার জন্য বরাদ্দ ছিল এই হাসি। শত ব্যস্ততাতেও মোহনবাগানের ম্যাচ দেখতে আসতেন। জিতলে খুব খুশি হতেন। তবে হারলেও মুষড়ে পড়তেন না। একসময়ের মোহনবাগান তারকা মানস ভট্টাচার্য মনে করতে পারলেন, দাদা খেলার পর ড্রেসিংরুমে আসতেন। জিতলে সবার পিঠ চাপড়ে দিতেন। কিন্তু হারলেও খুব উৎসাহ দিতেন। সুব্রতদা তখন বলতেন, আজ জিতিসনি তো কী হয়েছে। তোরা অনেক ম্যাচ জিতেছিস। আবার জিতবি। একটা হারে সব শেষ হয়ে যায় নাকি। দেখবি এবার অনেক গোলে জিতবে। কাল একটা নতুন দিন। নতুন ভোর। পিছনে তাকাবি না তোরা।

আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় আরও তিন মামলা কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে

ক্লাবে ঠিক যেখানে দেবাশিস দত্ত, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়রা সুব্রতর প্রতিকৃতিতে মালা দিলেন, ঠিক ওখানেই তো কত সময় কাটিয়ে গিয়েছেন প্রয়াত পঞ্চায়েতমন্ত্রী। কিন্তু সুব্রতদাকে মন্ত্রী বলে কখনও মনেই হয়নি ক্লাবের অর্থসচিব দেবাশিসের।

বললেন, সুব্রতদা যখন ক্লাবে আসতেন, মন্ত্রী আর রাজনীতির পোশাক খুলে সাধারণের মতো আসতেন। ওঁকে দেখে কখনও মনেই হয়নি উনি কত বড় নেতা। কত বড় মন্ত্রী। যখন যে দরকার নিয়ে আমরা সুব্রতদার কাছে গিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে উনি কাজটা করে দিয়েছেন। ওঁর কাছে মোহনবাগান ছিল ফার্স্ট প্রায়োরিটি। ক্লাবকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন।

আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগর মেলা আসবে, থাকবেন না প্রাণপুরুষ

ঠিক এই কথাটাই বলছেন সবাই। ক্লাব সচিব সৃঞ্জয় বোসের কাছে সুব্রত মুখোপাধ্যায় হলেন ফ্যামিলি মেম্বার। বললেন, আমাদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। এত ব্যস্ত মানুষ, তবু রোজ লিগের ম্যাচ দেখতে আসতেন। শুনেছি আমার ক্লাবে আসার আগেও তিনি এরকমই ছিলেন। ক্লাব অন্তপ্রাণ ছিলেন। ওঁকে দেখে শিখেছি মোহনবাগানের জন্য কাজ করতে কোনও পোস্ট লাগে না। অসম্ভব ভালবাসতেন আমাদের ক্লাবকে। আদ্যন্ত মোহনবাগানি। ক্লাবের নানা কাজে ওঁর কাছে গিয়েছি। সবসময় পরামর্শ পেয়েছি। ওঁর অভাব কোনওদিন পূরণ হবে না।

আরও পড়ুন-বামেদের কাছ থেকেও আদায় করেছেন সন্মান

সুব্রতকে নিয়ে নানান অভিজ্ঞতা আছে মানসের। তিনি ফিরে গেলেন সাত ও আটের দশকের ময়দানি উন্মাদনার দিনে। বললেন, সুব্রতদা রোজ মাঠে আসতেন। আর উনি এলেই মনের ভিতরে অদ্ভুত জোর পেতাম। ভাবতাম এই মানুষটা এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের খেলা দেখতে এসেছেন। এঁকে নিরাশ করা চলবে না। আজ গোল করতেই হবে।

বাটানগরের মানসকে সুব্রত আলাদা করে চিনতেন তিনি নিজেও ওখানকার লোক বলে। ওখানকার মিলন সংঘের সদস্য ছিলেন দু’জনেই। সেই থেকে খেলার মাঠের মানসের উপর আলাদা নজর ছিল সুব্রতর। মানসের মনে আছে, খেলার পর দাদা ড্রেসিংরুমে আসতেন। সবার সঙ্গে কথা বলতেন।

এমনকী দিল্লিতে ডুরান্ড বা মুম্বইয়ে রোভার্স কাপের ম্যাচেও চলে যেতেন উনি। অবশ্যই রাজনীতির কাজে ওইসব শহরে গেলে। একবার মোহনবাগান ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারাল। উনি মানস-বিদেশদের হোটেলে ডেকে খাইয়ে দিলেন। এমনই সবুজ মেরুন-পাগল লোক ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন-৩৫ ফুটের মহাকাল ভৈরব

আরও অনেক গল্পগাথা ছড়িয়ে আছে ময়দানে। শিলিগুড়িতে মিটিং করতে গিয়েছেন। তখন দার্জিলিং গোল্ড কাপে মোহনবাগান খেলছে। মিটিং শর্টকাট করে সোজা চলে গেলেন প্রিয় ক্লাবের খেলা দেখতে। যখন প্রিয়-সুব্রতর জমানায় ওঁরা বাংলার দামাল ছেলে, তখনও এই খেলা দেখায় ভাটা পড়েনি। টুক করে বেরিয়ে ক্লাবের খেলা দেখে আসতেন। দেবাশিস বলেছিলেন, মোহনবাগান মাঠে ফ্লাড লাইট বসার পর খুব খুশি হয়েছিলেন সুব্রত। লাইটে খেলা হলে উনি আসতেনই। সন্ধ্যার ম্যাচ মাঠে বসে দেখা খুব উপভোগ করতেন।

সবসময় বলতেন, আমার কোনও পোস্ট লাগবে না। আমার কাছে সবার আগে হল এই প্রতিষ্ঠান। মোহনবাগান আমার রক্তে। দেবাশিসের আরও মনে পড়ে গেল, ক্লাবের তখন টালমাটাল অবস্থা। ক্লাব সভাপতি, সচিব-সহ চার শীর্ষ কর্তা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

সুব্রত বলে দিলেন, এঁদের ছাড়া মোহনবাগান চলতে পারে না। তাই পদত্যাগপত্র তুলে নিতে হবে। সেই মুহূর্তে একটা সঠিক নেতৃত্বের দরকার ছিল। পোড়খাওয়া সুব্রত তাই করলেন। বললেন, আমি কোনও পক্ষ নই। আমার কোনও চেয়ার লাগবে না। শুধু যারা ক্লাব চালাতে পারবে, আমি তাদের পাশে।

আরও পড়ুন-গ্রামের সঙ্গে যুক্ত করা হবে শহর উন্নয়নের ব্লুপ্রিন্ট শোভনদেবের

এই সুব্রতকে খেলার মাঠে গুরু মানেন স্বপন বন্দোপাধ্যায়। বিওএ সভাপতির মনে পড়ছে মোহনবাগান ক্লাব, রাজ্য কবাডি সংস্থায় একসঙ্গে কাটানো দিনগুলির কথা। কোথাও নিজের গুরুত্বের জানান দিতেন না। হাসিমুখে মিশতেন সবার সঙ্গে। হাসপাতালে সুব্রতদাকে দেখতে গিয়ে স্বপন দেখেন, তখনও মাঠ নিয়েই কথা বলে যাচ্ছেন তিনি। বুকে স্টেন্ট বসেছে। হাসিখুশি মানুষটাকে দেখে কে বলবে। আপনি এখন বিশ্রাম করুন, বাড়ি ফিরুন, তারপর কথা হবে বলে সেদিন বেরিয়ে এসেছিলেন ময়দানে সবার কাছের মানুষ বাবুন। কিন্তু এখন আফসোস করছেন। দাদাকে আর কখনও কাছে পাবেন না।

আরও পড়ুন-

ঠিক এই আফসোসই ময়দানের সর্বত্র। একহাসি মুখ নিয়ে কেউ ডাকলেই চলে আসতেন দাদা। বলতেন ময়দান আমার অক্সিজেন। এখানে এলে কত স্মৃতি মনে পড়ে। এখন সেই তিনিও স্মৃতি হয়ে গেলেন। ময়দান খুঁজে বেড়াবে সবুজ-মেরুন ভদ্রলোককে। আর তিনি উপর থেকে হাসি ছড়াবেন, আরে, আমি তো আছি!

Latest article