উত্তর কলকাতার ছোট্ট অঞ্চল কুমোরটুলি। গঙ্গার অদূরেই। আহিরিটোলা থেকে রবীন্দ্র সরণি ধরে বাগবাজার যেতে বাঁদিকে। সরু গলির ভিতর। সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী পাড়া। ভেজা মাটির গন্ধ ভেসে বেড়ায়। সেইসঙ্গে খড়ের গন্ধ, রঙের গন্ধ। বাঁশ, কাঠ, পেরেক ইত্যাদি ছড়ানো। কয়েকশো মৃৎশিল্পীর কাজের জায়গা। সারা বছর গড়া হয় নানান দেবদেবীর মূর্তি। তবে মা দুর্গার উপর নির্ভরতাই বেশি। কুমোরটুলির দুর্গা প্রতিমার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। শুধুমাত্র দেশেই নয়, বিদেশেও।
আরও পড়ুন-বাড়ছে শহরের নিরাপত্তা
সামনেই পুজো। একদিন হাজির হলাম কুমোরটুলিতে। শেষ পর্যায়ের কাজ দেখার জন্য। ভেজা অলিগলি। ঘুরে ঘুরে দেখলাম, এখন দম ফেলার সময় নেই মৃৎশিল্পীদের। শুরু হয়েছে রঙের কাজ। সময়ের মধ্যে ডেলিভারি দিতে হবে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ত্রিপল দিয়ে আগলে রাখতে হচ্ছে প্রতিমা। যেভাবে আগলে রাখা হয় ঘরের মেয়েকে। দুর্গা তো ঘরের মেয়েই। উমা। তাঁকে মনপ্রাণ ঢেলে রূপ দেন মৃৎশিল্পীরা। কয়েক মাস চরম ব্যস্ততা। পুজোর মুখে প্রতিমা মণ্ডপে চলে গেলে ঘর ফাঁকা। খাঁ-খাঁ করে। তখন মনের অবস্থা কীরকম হয়? কুমোরটুলির মহিলা মৃৎশিল্পী চায়না পাল বললেন, ‘‘মন খারাপ হয়ে যায় খুব। ঘরের মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে যেমন অনুভূতি হয়, তেমন।’’ চায়না পাল একচালার দুর্গা প্রতিমা গড়েন। বাবার দেখানো পথ ধরেই এসেছেন।
আরও পড়ুন-থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন, মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যেগকে কুর্নিশ ব্রাত্যর
এই মুহূর্তে কুমোরটুলি ঠিক কী অবস্থায় দাঁড়িয়ে? নতুন প্রজন্ম আসছে? জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘‘কুমোরটুলিতে কয়েকশো মৃৎশিল্পী কাজ করছেন। এখান থেকেই হয় অন্নসংস্থান। কেউ বেশি কাজ করেন, কেউ কম। সব থেকে বড় কথা পরবর্তী প্রজন্ম হাল ধরতে শুরু করেছে। কেউ কেউ বলেন, কুমোরটুলি সংকটের মুখে। আমি বিশ্বাস করি না। আগামী দিনে আমরা না থাকলেও কুমোরটুলি থাকবে। কোনওদিন শুনশান হবে না। বরং আরও ভাল হবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ডাবল দামে কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে। সেই তুলনায় ঠাকুরের দাম বাড়াতে পারিনি। তবে এই নয় যে আমাদের লোকসান হচ্ছে। বছর বছর লাভের মুখ দেখছি। কলকাতার পাশাপাশি বাইরেও যাচ্ছে আমার দুর্গা প্রতিমা। ভোপালে, দিল্লিতে। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। বৃষ্টি এসে মাঝেমধ্যে ছন্দপতন ঘটাচ্ছে। তা ছাড়া মোটামুটি সব ঠিকই আছে।’’
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
ঘুরতে ঘুরতে গেলাম ইন্দ্রজিৎ পালের স্টুডিওয়। দেবীর চোখ আঁকছিলেন তিনি। এক মনে। কাজ শেষ হওয়ার পর তাকালেন। বসলাম মুখোমুখি। জানালেন, ‘‘আমরা প্রায় ১০০ বছর কুমোরটুলিতে আছি। ওপার বাংলা থেকে এসেছিলেন দাদু। বাবার বয়স তখন দশ। তাঁরা এখানে মাটির কাজ করেছেন। মূলত গড়তেন দুর্গা প্রতিমা। বাবা কৃষ্ণ পাল ছিলেন এক সময়ের নামী শিল্পী। এখন আমি কাজ করছি। তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে।’’ এবার কতগুলো প্রতিমা গড়ছেন? তিনি জানালেন, ‘‘দশটা দুর্গা প্রতিমা গড়ছি। প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয় মার্চ মাসে। কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপের পাশাপাশি আমার তৈরি দুর্গা প্রতিমা বিদেশেও গেছে।’’ কুমোরটুলির সমস্যা নিয়ে তিনি বললেন, ‘‘বর্তমানে বড় সমস্যা বৃষ্টি। আমাদের অনেকের বায়না শেষ হয়েছে আড়াই-তিন মাস আগে। যাদের পরে বায়না হয়েছে সমস্যা বেশি তাদের। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা নিয়ে তাদের বেশি চিন্তা।’’
আরও পড়ুন-ডেঙ্গি বৈঠকে এবার কড়া বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
কুমোরটুলি কি সংকটের মুখে? প্রশ্ন শুনে সোজা ব্যাটে খেললেন, ‘‘কুমোরটুলি সংকটে এটা একেবারেই মনে হয় না। করোনার সময় ভেবেছিলাম, আমরা বোধহয় দশ বছর পিছিয়ে গেছি। সেই বছর পুজো আড়ম্বরহীন ভাবেই হয়েছিল। ক্ষতি হয়েছিল আর্থিকভাবে। সবারই। ২০২১ সালেও খুব ভাল কিছু হয়নি। তবে ২০২২-এ আমরা দারুণ সাড়া পেয়েছি। ছ’মাস আগেই ঠাকুরের বায়না হয়ে গিয়েছিল। হাসি ফুটেছিল মৃৎশিল্পীদের মুখে। প্রত্যেকেই দেখেছিলাম লাভের মুখ। মোটকথা এখানে কিন্তু ভালই ব্যবসা হচ্ছে। হয়তো জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সেই তুলনায় প্রতিমার দাম ততটা বাড়েনি, তবু। ব্যবসা হচ্ছে বলেই বছর বছর এত প্রতিমা গড়া হচ্ছে। ফলে হতাশ হবার কিছু নেই। সবথেকে আনন্দের কথা, পরবর্তী প্রজন্ম এখানে কাজ শুরু করেছে। তারাই কিন্তু কুমোরটুলির ভবিষ্যৎ। নিজেদের কাজটা ঠিক ভাবে করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে যোগ্যতা। চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটাতে হবে। বুঝতে হবে মার্কেটের চাহিদা। তবেই পুজো কমিটিগুলো বায়না দিতে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিধায়ক ডাঃ শশী পাঁজা কুমোরটুলির উন্নতির জন্য ভাবনাচিন্তা করেন। প্রতি মুহূর্তে পাশে থাকেন। দুর্গাপুজোকে বিশ্বজনীন করতে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকার কোনও তুলনাই হয় না। আজও শহরের বেশিরভাগ মণ্ডপে শোভা পায় কুমোরটুলির প্রতিমা। ফলে একটা শ্রেণি গেল গেল রব তুললেও, কুমোরটুলি স্বমহিমায় ছিল, আছে, থাকবে। দুর্গা পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে।’
আরও পড়ুন-আজ অভিষেকের নেতৃত্বে দিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক
একসময় কুমোরটুলিতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন রাখাল পাল, নেপাল পাল, গৌরাঙ্গ পাল, পঞ্চানন পাল, অলোক সেন, মোহন বাঁশি রুদ্রপাল প্রমুখ মৃৎশিল্পী। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁদের সুনাম। তাঁদের তৈরি করা দুর্গা প্রতিমা শোভা পেত শহরের বড় বড় পুজো মণ্ডপে। কয়েকজন শিল্পীর পরবর্তী প্রজন্ম আজ সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম মোহন বাঁশি রুদ্রপালের পুত্র প্রদীপ রুদ্রপাল। তিনি মৃৎশিল্পী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। কুমোরটুলিতে নয়, বর্তমানে তিনি কাজ করেন তেলেঙ্গাবাগানে। খোঁজ নিয়ে গেলাম তাঁর স্টুডিওয়। দারুণ ব্যস্ত। তবু সময় দিলেন। কুমোরটুলি এবং মৃৎশিল্পের সংকট নিয়ে তিনি বললেন, ‘করোনার কারণে সাময়িকভাবে সংকট দেখা দিয়েছিল মৃৎশিল্পে। তবে গত বছর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ-বছর অনেকটাই ভাল। আগে কলকাতায় মৃৎশিল্প বলতেই কুমোরটুলিকে বোঝাত। এখন কিন্তু তা আর নেই। এখন পড়ায় পাড়ায় প্রতিমা গড়া হচ্ছে। কেউ কেউ কুমোরটুলির বড় শিল্পীর কাছে কয়েক বছর কাজ করে বেরিয়ে এসে নিজের পাড়ায় প্রতিমা গড়ছেন। অনেক পুজো কমিটি এখন কুমোরটুলিতে না গিয়ে লোকাল শিল্পীদের কাছ থেকেই প্রতিমা নিচ্ছেন। এর ফলে কুমোরটুলির একাধিপত্য কিছুটা হলেও কমেছে।’’
আরও পড়ুন-বৃষ্টিতে পণ্ড রোহিতদের ম্যাচ
তিনি আরও জানান, ‘‘কুমোরটুলিতে দুটো সমিতি আছে। একটা ওপার বাংলা থেকে আসা শিল্পীদের এবং অন্যটি এপার বাংলার শিল্পীদের। ওপার বাংলা থেকে আসা কয়েকজন শিল্পীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বাংলায়। বাংলার বাইরে। বিদেশেও। তাঁরা হলেন রাখাল পাল, নেপাল পাল, গৌরাঙ্গ পাল, আমার বাবা মোহনবাঁশি রুদ্রপাল। এঁরা গত হওয়ায় কুমোরটুলিতে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। অনেকেরই পরবর্তী প্রজন্ম এই জগতে আসছে না। তার মানে এই নয় যে কুমোরটুলিতে কাজ হচ্ছে না। কাজ হচ্ছে প্রচুর। তবে অনেকেরই কাজ সেই উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে না। সেই কারণে সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এখন বেড়েছে থিম পুজোর সংখ্যা। থিম মেকারদের অনেকেই নিজেরা ঠাকুর গড়েন। তাঁদের কিন্তু কুমোরটুলির শিল্পীদের প্রয়োজন হচ্ছে না। এটাও কুমোরটুলির একটা সংকটের কারণ। যদিও ইদানীং কুমোরটুলির কেউ কেউ থিমের ঠাকুর গড়ছেন। এইভাবেই নতুন ঢেউ আসবে।’’
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলের জয়ে নায়ক ক্লেটন
এবার কলকাতার শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব, সিংহী পার্ক, পার্কসার্কাস, তেলেঙ্গাবাগান, হাওড়ার স্বামীজি স্পোর্টিং ক্লাব, শিবপুর ষষ্ঠীতলা বারোয়ারি প্রভৃতি নামী পুজো মণ্ডপে শোভা পাবে প্রদীপ রুদ্রপালের তৈরি দেবীমূর্তি। কতগুলো প্রতিমা তৈরি করছেন? তিনি জানালেন, ‘‘৬০টি। বিদেশের মণ্ডপেও আমার প্রতিমা শোভা পাবে। গেছে ভিয়েতনামে। দু-মাস আগেই চলে গেছে। জাহাজে। আগেও আমার প্রতিমা বিদেশে গেছে। এবার একটি প্রতিমা যাবে দিল্লিতে। এর পাশাপাশি কলকাতা, হাওড়া-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আমার প্রতিমা দেখা যাবে। প্রত্যেকটাই বড় বাজেটের পুজোয়। কয়েকটি থিম পুজোর মণ্ডপেও থাকবে আমার প্রতিমা।’’
আরও পড়ুন-দিল্লিতে আপ থেকে যোগ কংগ্রেসে
তিনি আরও বলেন, ‘কাঁচামালের দাম বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়েছে প্রতিমার। আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি। তবে পুজো কমিটিগুলো আমাদের সঙ্গে আছে। এটাই ভরসার। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। উনি যেভাবে পুজোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। যা-ই হোক, দুর্গাপুজোর সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। আর দুর্গাপুজো মানেই কুমোরটুলি। আমার বিশ্বাস সাময়িক সংকট কাটিয়ে কুমোরটুলি আবার স্বমহিমায় ফিরবে।’’