একটা নির্দিষ্ট সময়ের বৃত্তে উৎসবগুলো কেমন আপতিত হচ্ছে, সেটা লক্ষ্য করলে অবাক হতে হয়। বিশ্বব্যাপী, সময়টা এখন মহাবিষুবের। স্মরণাতীত কাল থেকে পৃথিবী জুড়ে এই সময়টায় মানুষ আন্দোৎসব পালন করে আসছে। ভারতে যেন এই কেন্দ্রানুগ আনন্দময়তা আধিকতর স্পষ্ট।
আরও পড়ুন-ইসির হ্যাটট্রিক, ফাইনালে মুম্বই
ক’দিন আগে চলে গেল চৈত্র অমাবস্যা। হিন্দু বিক্রম সংবতের অন্তিম দিন। শুরু হয়ে গিয়েছে ২০৮০। বহু মানুষ এই পঞ্জিকা মেনে চলেন, ভারতের সরকারি নববর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্ষশেষের সন্ধ্যায় তুলসীতলার প্রদীপ জ্বালিয়ে অনেকেই পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন।
ক’দিন আগে পালিত হল পার্সি সম্প্রদায়ের ‘নভরোজ’ও। এটাও নববর্ষ পালনের উৎসব। নববর্ষের প্রারম্ভে এ-সময় তাঁরা পরলোকগত পূর্বপুরুষদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। স্মর্তব্য, ‘নভরোজ’-এর এই রীতি কেবল মধ্য এশিয়া নয়, কাশ্মীর থেকে আলবেনিয়া পর্যন্ত এক বিরাট অঞ্চলে প্রচলিত।
আরও পড়ুন-নেত্রীর নেতৃত্বে জোট বাঁধছে বিরোধীশক্তি
এই সময়েই দাক্ষিণাত্যের উচ্চভাগে এবং পশ্চিম ভারতে উদ্যাপিত হল নববর্ষ, মহারাষ্ট্রে এই নববর্ষ পালনের উৎসব হল ‘গুড়ি পড়ওয়া’। গোয়াতেও তাই, আবার অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা আর কর্নাটকে এই উৎসবের নাম ‘যুগাড়ি’। ‘যুগ’ হল ‘বছর’ আর ‘আড়ি’ হল ‘সূচনা’ তাই বর্ষারম্ভের উৎসবের নাম ‘যুগাড়ি’। সিন্ধ্রি সম্প্রদায়ের কাছে এই উৎসব ‘চেতি চান্দ’ নামে পরিচিত। তবে বহু ভারতীয় এটিকে ‘চৈত্র শুক্লাড়ি’ নামে চেনেন। ‘গুড়ি পড়ওয়া’ পালনকালে মারাঠিরা জানালায় জানালায় ধ্বজা বা পতাকা ওড়ান, প্রতিপদে এমন পতাকা বাড়িতে ঝোলালে গৃহ থেকে অশান্তি বিতাড়িত হয় আর শান্তি-সমৃদ্ধি আসে, এমনটাই লোকবিশ্বাস।
আরও পড়ুন-যৌথ নেতৃত্বেই বীরভূমে লড়বে তৃণমূল
একশো বছর আগে ব্রিটিশ লেখক আন্ডারহিল দেখেছিলেন লোকজন বাধ্যতামূলকভাবে কাঁচা নিমপাতা চিবোচ্ছে। বসন্তে নানা রোগের উৎপাত। সে-সবের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিষেধক ক্ষমতা গড়ে তুলতেই সম্ভবত বাধ্যতামূলকভাবে কাঁচা নিমপাতা খাওয়ার রীতি, আসলে এ-সময়েই বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, ভাইরাসের আক্রমণে নানা রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়।
পবিত্র যুগাড়ি পালন সাধারণত শুরু হয় স্নানাভিষেক দিয়ে। তারপর প্রার্থনা অনুষ্ঠানে সকালে যোগদান করে। কর্ণাটকে এই উপলক্ষে ঘরে ঘরে প্রস্তুত হয় ওব্বাত্তু বা পুরাণ পোলি। আটা আর গুড়ের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি পুর রুটির মধ্যে ভরে সেটার ওপর ঘি বা দুধ ঢেলে পরিবেশন করা হয়। এই বস্তুটার নামই হল ওব্বাত্তু বা পুরাণ পোলি।
আরও পড়ুন-রাহুলের সাংসদ পদ বাতিল, কেন্দ্রকে তোপ তৃণমূলনেত্রী ও অভিষেকের
অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় এই উৎসব উপলক্ষে তৈরি করা হয় পোলেউ। তৈরি হয় যুগাড়ি পছাড়ি। এটা আসলে ছ’টা স্বাদের সমাহার। তেতো হিসাবে থাকে নিম, মিষ্টি হিসেবে থাকে গুড় বা পাকা কলা, ঝাল হিসেবে থাকে কাঁচা লঙ্কা বা গোলমরিচ, টক স্বাদের জন্য থাকে তেঁতুল বা কাঁচা আম।
এই স্বাদ-সমাহার থেকে স্পষ্ট বসন্তে যেসব রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দেয় সেগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য দরকার পড়ে এরকম একটা পাঁচন। করোনার উৎপাতের পর এরকম পাঁচনের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা আরও বেশি করে উপলব্ধি করছি।
আরও পড়ুন-নারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত, স্বীকার শুভেন্দুর, গ্রেফতারের দাবি তৃণমূলের
আগামী সপ্তাহে শুরু হচ্ছে বাসন্তী নবরাত্রি। শুরু হবে উপবাস ও কৃচ্ছ্রসাধনের পর্ব। ঘটনাচক্রে এই সময়েই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রোজা পালন, সংযম ও উপবাস পর্ব।
আবাক লাগে সব কিছু এই সময়েই! ধর্মীয় পার্থক্য, প্রাদেশিক বিভিন্নতা সবকিছু মুছে দিয়ে এই সময়েই রচিত হয় উৎসবময়তা।
ভারতাত্মাই যে বিবিধের মাঝে মিলন মহানের প্রতীকী প্রকাশ।
এটা তো অস্বীকার কারার কোনও উপায় নেই।