আজ থেকে ঠিক চার-পাঁচদিন আগে মহারাষ্ট্রে বিজেপির একটি রাজনৈতিক সভায় তীব্র তাপপ্রবাহে এগারো জনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ একশোর উপর। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির সেকেন্ড ইন কমান্ড অমিত শাহ-সহ উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে ও উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য চেয়ে সই সংগ্রহ
সারা দেশ জুড়ে চলা তাপপ্রবাহকে গুরুত্ব না দিয়েই দিকে দিকে এখন লোকসভা ভোটের দামামা বাজানোর ডাক দিয়ে চলেছে বিজেপি। মানুষ মরুক কিংবা বাঁচুক চব্বিশের গদি ছাড়া যাবে না। এমন অমানবিক, কুৎসিত, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল ভারতবর্ষ এই প্রথম দেখছে। যাদের রাজনীতি মানুষকে সর্বদাই নির্যাতনের শিকার করা। সে ধর্ম কিংবা শাসন যা-ই হোক মানুষকে হয়রান করতে এরা ওস্তাদ।
মজার বিষয় বিজেপি সংগঠন দিয়ে ভোট করানো অর্থাৎ মাঠে ঘাটে পড়ে থেকে মানুষের সুখ-দুঃখের খবর নেওয়া, তাদের সুবিধা-অসুবিধা শোনা, বিপদে পাশে দাঁড়ানো— এসব চিরাচরিত রাজনীতির পরিচিত দৃশ্যের বিশ্বাসী নয়। কারণ ওরা ক্ষমতায় বিশ্বাসী। কাজে নয়। ওদের লক্ষ্য একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার।
আরও পড়ুন-দায়রা কোর্টেও ধাক্কা খেলেন রাহুল
সেই কারণে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে হাজারো সংস্থার থেকে পাওয়া অনুদানে তারা মিলিওনেয়ার বিলিওনেয়ার পার্টি। তাই তারা ভোট করে কর্পোরেট স্টাইলে। কোটি কোটি টাকার আইটি সেল তাদের। বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে মিডিয়াকে পর্যন্ত কন্ট্রোল করা তাদের কাছে নস্যি। হেলিকপ্টারে চড়ে এসে উঁচু মঞ্চের ভাষণ ছাড়া তাদের পা মাটিতে পড়ে না।
এখন বিষয় হচ্ছে, বিগত ন’ বছর ধরে বিজেপি কেন্দ্রে বসে একটিও জনদরদি সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বা বলা ভাল নেয়নি। মাত্র ন’ বছরে বিজেপি শাসনে দেশের গণতন্ত্র তথা সংবিধান লুণ্ঠিত হয়ে চলেছে। চরম রাজনৈতিক দৈন্যতার শিকার হয়ে সারা দেশ আজ দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন দামে বিপর্যস্ত। ধর্মীয় হানাহানিতে যেখানে সন্ত্রস্ত সেখানে লোকসভা ভোটের এখনও ঢের বাকি থাকলেও শাহবাবুদের রাজ্যে রাজ্যে বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে ওদের প্রাণভোমরা যে লোকসভায় লুকিয়ে আছে সেটা স্পষ্ট।
আরও পড়ুন-ইয়েমেনে ত্রাণসামগ্রী নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত ৮৭ জন
দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হিংসা যে-করেই হোক— যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা যে কোনও রকম সিদ্ধান্ত নিতে তারা পিছ-পা নয় সেটা উনিশের লোকসভায় পুলওয়ামায় কী হয়েছিল তা আজ দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এমনিতে বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা শুনে শুনে অভ্যস্ত যে এক-একটা নির্বাচন আসে আর বর্তমান বিজেপি দলের নতুন নতুন সংখ্যার সিটের হিসাবনিকাশের তর্জন-গর্জন শোনা যায়। গেল একুশের বিধানসভায় দুশো পারের ডাক ছিল। মিডিয়ার আকাশে-বাতাসে সেই ডাক ছড়িয়ে দেবার সে কী প্রতিধ্বনি!! যদিও কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল পঞ্চাশ-ষাটেই ধপাস। এবার চব্বিশের লক্ষ্যে বঙ্গে নতুন স্লোগান ‘অব কি বার প্যাঁত্রিশ পার।’
আরও পড়ুন-পরিযায়ী শ্রমিকদের তিন মাসের মধ্যে রেশন কার্ড দেওয়ার সুপ্রিম নির্দেশ
আসলে মুশকিল হয়েছে ভারতবর্ষের বিচিত্রতা। নানা রাজ্যের হরেকরকম বৈচিত্র্য। বহু রাজ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতাসীন দলগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী। ফলে অ-বিজেপি রাজ্যগুলোকে শাহবাবুরা কোনওভাবেই নিজেদের কবজায় আনতে পারছে না। যে কারণেই যতবার ভোট আসে ততবার কেন্দ্রীয় এজেন্সির বিরোধী রাজ্য সরকারদের হেনস্থা করার নিত্য নতুন ফন্দিফিকির দেখতে পাওয়া যায়। আসন্ন লোকসভাতেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
চোদ্দো সালে আচ্ছে দিনের ফেক-বাণী শুনিয়ে সেই যে ভারত দখলের নোংরা খেলা শুরু করেছে বিজেপি— আর সেই খেলার সবথেকে বেশি বিরুদ্ধতা করে আসছে বাংলা। পরিষ্কার করে বললে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদিশাহ বাহিনীর দখলরথ কে বারবার আটকিয়ে যেতে হচ্ছে এই বাংলায় একজন সাধারণ মেয়ের অসাধারণ রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার কাছে। আসলে বাংলা চিরকালই বিজয়কেতন ওড়ায় চেতনা চৈতন্যের।
এর ফলে বাংলা দখল করার জন্য বিজেপি যত রকমের কুকৌশল মাথায় খেলছে তার সবগুলোই প্রয়োগ করে চলেছে দিনের পর দিন। একদিকে সরকারকে জনগণের কাছে বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, সড়ক যোজনার মতো কেন্দ্রীয় সহযোগিতা বন্ধ করেছে। অন্যদিকে, দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে হেয় প্রতিপন্ন করতে এজেন্সি দিয়ে রোজই কাউকে না কাউকে গ্রেফতার করে গায়ে প্রভাবশালী তকমা লাগিয়ে জেলে আটকিয়ে রেখেছে আর মিডিয়া ট্রায়াল চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-নিষিদ্ধপল্লি, সংশোধনাগারে ভ্রাম্যমাণ পরিষেবা কালনায়
বিগত কয়েক বছর ধরে এসব দেখে দেখে বাঙালি ক্লান্ত। এমনিতে বঙ্গে বিজেপি বলে কিছুই নেই। সিপিএম নামক দলটির চৌত্রিশ বছরের জমিদারি হুড়মুড়িয়ে এগারো সালে ভেঙে যাওয়ার পর ওদের যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। ফলে মমতাকে জব্দ করতে ওরা নিজেদের সংগঠন পর্যন্ত বিজেপির চরণে অর্পণ করে হনুমানের পুজোয় মেতেছে।
সে যাই হোক, বাংলা আবারও যে খালি হাতেই ফেরাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শেষ করব একটি ঘটনার প্রসঙ্গ দিয়ে।
২০১৬-র বিধানসভা ভোটের সময় তখন। রানিগঞ্জের কোনও একটি জায়গায় মিটিং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমি কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছি। লোকজন আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু সেদিন অসহ্য তাত। যেন আগুন ঝরছে। রীতিমত লু বইছে। মিটিংয়ে আসা নেতা-কর্মী, মানুষজন থেকে পুলিশ, ভলেন্টিয়ার— সবারই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কিছুক্ষণ পরই দিদি হেলিকপ্টার থেকে নামলেন। হালকা সাদা চাদর গায়ে মাথায় জড়ানো। মঞ্চে উঠেই বললেন…
আরও পড়ুন-মোহনবাগানের নজরে এএফসি কাপ, কোচ নিয়ে ধোঁয়াশা অব্যাহত ইস্টবেঙ্গলে
‘‘আমি কোনও বক্তব্য রাখব না। এই রোদে এরা তো অসুস্থ হয়ে পড়বে! কোনও মিটিং হবে না। এখানের নেতৃত্বে যারা রয়েছ এদের প্রত্যেককে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করো। খোলা মাঠে কোনও আচ্ছাদন নেই!! এরপর কোনও মিটিংয়ে আমি যেন এরকম দেখি না। এইরকম তীব্র গরমের কথা আমাকে আগে কেন জানানো হয়নি? আমি এখানে একটা কথাও বলব না। এখুনি সকলকে বাড়ি পাঠাও। বয়স্কদের গাড়ি করে দিয়ে আসবে। আপনারা এসেছেন, এত গরমের মধ্যে বসে আছেন আমার কথা শোনার জন্য, এতেই আমার প্রতি আপনাদের আস্থা বোঝা যাচ্ছে। আপনারা ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে যান। এভাবে রোদের মধ্যে বসে থাকলে আপনারা অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
আরও পড়ুন-জোশীমঠে নতুন ফাটল ফের ছড়াল তীব্র আতঙ্ক
কয়েকদিন আগে অমিত শাহের মহারাষ্ট্রের সভাতেও আচ্ছাদন ছিল না। তবুও বিজেপি সভা বন্ধ করেনি। ফলস্বরূপ মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটল। বিজেপির কেউ ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। মিডিয়ারও হেলদোল নেই। ক্ষমতালোভী শাসক এমনই হয়। মানুষের জীবনের দাম কানাকড়িও নেই এদের কাছে।
ঠিক একইরকম আচ্ছাদনহীন সভা ছিল রানিগঞ্জেও। মুখ্যমন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকে নেমে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত বুঝিয়ে দিয়েছিল মানুষের জীবনের উপরে কিছু হতে পারে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপির তফাতটা বারবার এখানেই থেকে যাবে।