আলোকচিত্রী শ্রেয়ভি
ছোটবেলায় বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর সময় তাদের বাবা-মায়েরা গল্পের বই থেকে পড়া বিভিন্ন ধরনের গল্প বলে থাকেন, কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটির ক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের ঘুম পাড়ানোর সময় কোনও গল্পের বইয়ে পড়া ঘটনা বলে ঘুম পাড়াতে হয়নি, কারণ তার বাবা-মায়ের বিভিন্ন জঙ্গলে সাফারি করার সময় যে-সমস্ত ঘটনা ঘটেছিল সেগুলোই ছিল তাদের ছোট্ট মেয়ের ঘুমপাড়ানি গল্প। আর এই সমস্ত দুঃসাহসিক গল্প শুনতে শুনতেই অল্পবয়সে প্রকৃতি-প্রেমিক হয়ে উঠেছিল বাচ্চা মেয়ে শ্রেয়ভি মেহেতা। এ-বছর ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম লন্ডনের ষাটতম ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অফ দি ইয়ার প্রতিযোগিতার রানার আপ হয়েছে শ্রেয়ভি।
ফরিদাবাদ-এর শিব নাদার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শ্রেয়ভি। মাত্র ন’বছর বয়সেই তার অবিশ্বাস্য প্রতিভা এবং বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফির প্রতি অনুরাগের জন্য শ্রেয়ভি সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে বিশ্বব্যাপী ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি তথা বিবিসি ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আরও পড়ুন-১৫০ বছরে হাওয়া অফিস
ফরিদাবাদ-এর বাসিন্দা শিভাং এবং কাহিনির মেয়ে হচ্ছে শ্রেয়ভি। শ্রেয়ভির বাবা একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। আর সেই কারণেই ছোট থেকেই শ্রেয়ভি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণে যেতেন। ভরতপুরের লীলাভূমি করবেট থেকে শুরু করে মাত্র চার বছর বয়সেই শ্রেয়ভি মাসাই মারা জাতীয় উদ্যানেও ভ্রমণ করে ফেলেছিল। সে ছোট থেকেই তার বাবাকে ক্যামেরা তাক করে বন্যপ্রাণীর ছবি তুলতে দেখেছে। এবং সে আরও দেখেছিল যে তার বাবা বহুক্ষণ ধরে ধৈর্য সহকারে বন্যপ্রাণীদের নিখুঁত মুহূর্তের ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করেন। বাবার কাঁধে ঝোলানো ওই ক্যামেরাটা ছোট্ট থেকেই ভীষণ টানত শ্রেয়ভিকে। মাত্র দু’বছর বয়সে শ্রেয়ভি তার বাবার ডিএসএলআরটি স্পর্শ করেছিল। কিংবা বলা যায় বাবা তার মেয়েকে ক্যামেরাটি স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁরা রণথম্ভোর জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণ করছিলেন। ক্যামেরা স্পর্শ করার সাত বছর পরে কেওলাদেও জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণ করার সময় মাত্র নয় বছর বয়সে দুটি ময়ূরের একটি অতি আশ্চর্য ছবি তোলে শ্রেয়ভি। আর এই ছবিটাই ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম লন্ডনের আন্ডার টেন ইয়ার্স ক্যাটাগরিতে রানার্স আপ হয়। আর ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ফটোগ্রাফার শ্রেয়ভির হাতে উঠে আসে লন্ডনের ষাটতম ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার-এর পুরস্কার।
বন্যপ্রাণীদের মাঝেই বেড়ে উঠেছিল শ্রেয়ভি। প্রকৃতি এবং বন্যপ্রাণীর ওপর ভালবাসা তার বাবা-মায়ের চোখ এড়াতে পারেনি। আর সেই কারণেই যখনই সম্ভব হত তখনই তাঁরা তাঁদের মেয়েকে নিয়ে জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণে যেতেন। শ্রেয়বির বাবা শিভাং বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির জন্য পরিবারের থেকে দূরে থাকতেন। আর সেই কারণে ছোট থেকে শ্রেয়ভিকে তিনি শুধুমাত্র প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণীর সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর জন্যই জাতীয় উদ্যানগুলোতে নিয়ে যেতেন না, তিনি তাঁর মেয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যও মেয়েকে সঙ্গে করে জাতীয় উদ্যানে যেতেন। আর এইভাবেই ক্যামেরার প্রতি ভালবাসা তথা ফটোগ্রাফির দিকে শ্রেয়ভির যে ঝোঁক সেটা তাঁরা লক্ষ্য করেন। শ্রেয়ভিও যখন তার বাবার সঙ্গে জাতীয় উদ্যান ভ্রমণে বেরোত তখন সে তার বাবার বড়সড় ক্যামেরাটা হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করত। শ্রেয়ভির মা কাহিনির একটি পুরনো পয়েন্ট অ্যান্ড স্যুট ক্যামেরা ছিল। যখন তাঁর মাত্র চার বছর বয়স তখন তাঁর বাবা-মা তাঁকে এই ক্যামেরাটি দেন। আর সেই মায়ের পুরনো ক্যামেরাটা নিয়েই ফটোগ্রাফিতে যাত্রা শুরু হয় শ্রেয়ভির। ক্যামেরাটাতে ভাল জুম করা যেত। আর এই ক্যামেরাটা নিয়েই বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত শ্রেয়ভি।
আরও পড়ুন-ইংরেজি শেখান কিন্তু জোর দিন বাংলাতেও, পরামর্শ দিলেন ব্রাত্য
শ্রেয়ভি যে পরিবেশে বড় হয়েছে সেই পরিবেশটি ছিল প্রকৃতিবিদ এবং ফটোগ্রাফদের দ্বারা বেষ্টিত। সেই সমস্ত প্রকৃতিবিদ এবং ফটোগ্রাফারদের কাছ থেকেই সে ফটোগ্রাফির বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষা লাভ করেছিল। ফলে ছোট বয়সেই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির বিষয়ে নানাবিধ জ্ঞানলাভ হয়েছিল শ্রেয়ভির। মাত্র ছয় বছর বয়সেই তার হাতে উঠে এসেছিল প্রথম পেশাদার ক্যামেরাটি। আর তার উদীয়মান ফটোগ্রাফির কেরিয়ারে এটাই ছিল উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। তবে ছোট্ট শ্রেয়ভির কাছে ক্যামেরাটি একটু ভারী ছিল। কিন্তু তবুও শ্রেয়ভির ছোট্ট মন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। এই পেশাদারি ক্যামেরাটিতে খুব উত্তেজিত ছিল শ্রেয়ভি। আর এই ক্যামেরাটা হাতে আসার পরেই নেচার ওয়ান্ডার্স-এর ফটোগ্রাফারদের পরামর্শ অনুযায়ী ফটোগ্রাফির সূক্ষ্ম দিকগুলো শিখতে শুরু করে সে। ফ্লেমিং, অ্যাঙ্গেল, ক্যামেরা সেটিং এবং আরও অনেক কিছু সে এই পেশাদারি ক্যামেরাতে শিখতে শুরু করে।
মাত্র ১০ বছর বয়সেই শ্রেয়ভি দশটা জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ করে ফেলেছে। এই বয়সেই বছরে ৩০ থেকে ৪০ দিন বন্য অঞ্চল সাফারি এবং অভিযানে ব্যস্ত থাকে সে। ছোট ছোট শিশুদের জঙ্গল সাফারিতে গিয়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে হাঁটা বা সবকিছুর সঙ্গে সব সময় মানিয়ে নেওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু শ্রেয়ভি এই সমস্ত ব্যাপারটাকে একটা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। শ্রেয়সী এই বয়সেই মানসিকভাবে শক্ত, উদ্যমী এবং উদ্যোগী। তার জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট ছোট পাহাড় ট্রেক করা, রুক্ষশুষ্ক ভূখণ্ডে হাঁটা— কোনওটাই তার কাছে কষ্টকর নয়। এই সমস্ত ব্যাপারে প্রচণ্ডই উৎসাহ শ্রেয়ভির। আর তাই এই সমস্ত কাজের জন্য যে সমস্ত অনুশীলন করতে হয় তার জন্য প্রতিদিনই সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে যায় শ্রেয়ভি।
আট বছর বয়স থেকেই শ্রেয়ভি স্কুলে যাওয়ার আগে তার ফটোগ্রাফির দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অনুশীলন করে, আর সেই কারণে সকাল সাড়ে চারটের সময় ঘুম থেকে ওঠে সে। প্রতিদিন সকাল পাঁচটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত নেচার ওয়ান্ডারার্স-এর পরামর্শদাতাদের কাছ থেকে কতটা নিপুণভাবে এবং সঠিকভাবে ছবি তুলতে হয় তার পাঠ নেন শ্রেয়ভি। এই প্রতিদিনের রুটিন তার মধ্যে একটা দৃঢ় এবং শৃঙ্খলা বোধ জাগিয়ে তুলেছে। সপ্তাহ শেষে শ্রেয়ভির বাবা-মা হাতে-কলমে ছবি তোলা শেখানোর জন্য ফরিদাবাদের জলাভূমি বা কাছাকাছি খোলা জায়গাগুলোতে নিয়ে যান। শ্রেয়ভির ছবি তোলার সাধনাকে সে যে স্কুলে পড়ে অর্থাৎ ফরিদাবাদের শিব নাদার স্কুল তাকে সমর্থন করে।
গত বছরই শ্রেয়ভি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম পরিদর্শন করেছিল। এবং সেই প্রদর্শনীতে থাকা ছবিগুলো দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায় শ্রেয়ভি। এবং তখন থেকেই মনে মনে ফটোগ্রাফার হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে দৃঢ় করে তোলে সে।
আরও পড়ুন-লাগাতার ব্যর্থতার নজির বিএসএফের, মালদহ-মেখলিগঞ্জ সীমান্তে অশান্তি
এবং তার চেষ্টা অবশেষে ফলপ্রসূ হয়েছে। এ বছরই অক্টোবর মাসে তার ছবি সেই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।
যে ছবিটার জন্য পুরস্কৃত হয়েছে সেই ছবিটির শিরোনাম ইন দ্য স্পটলাইট। ছবিটি কেওলাদেও ন্যাশনাল পার্কে তোলা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভোরবেলা দুটো ময়ূর পরস্পরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। এবং মনে হচ্ছে তাদের ছবিটা একটি গাছের অত্যাশ্চর্য ছাউনি দ্বারা ফ্রেম করা। এই ছবিটা ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে তুলেছিল সে। নভেম্বরের এক ভোরে কেওলাদেও জাতীয় উদ্যানে বাবার সঙ্গে হাঁটছিল শ্রেয়ভি। তখন সূর্যদেব সবেমাত্র তাঁর মুখ দেখিয়েছেন, সূর্যের সেই নরম ঐশ্বরিক আলোতে শ্রেয়ভি লক্ষ্য করে দুটি ময়ূর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। শ্রেয়ভি দেখার সাথে-সাথেই দ্রুততায় বাবার ক্যামেরাটা নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে ছবি তোলে। সেই সময় তার বাবা কীভাবে ফ্রেম করতে হবে তার নির্দেশনা দেন। আর এর সাথেই ক্যাপচার হয়ে যায় ভারতের কনিষ্ঠ ফটোগ্রাফারের পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিটি। সেই সময় শ্রেয়ভির বয়স ছিল মাত্র নয় বছর।
শোলে গার্ল রেশমা
একটি ওটিটি চ্যানেলে ২০১৯ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবসে মুক্তি পেয়েছিল ওয়েব সিরিজ দ্য শোলে গার্ল। বলিউডের প্রথম স্টান্ট ওম্যান রেশমা পাঠানের জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সিরিজটি।
রেশমা পাঠান, যাঁকে সবাই এক ডাকে চেনে শোলে গার্ল হিসাবে তাঁর জীবনটা বলিউডের সিনেমাগুলোকেও হার মানিয়ে দেয়। গুজরাতের অত্যন্ত দরিদ্র রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম হয়েছিল রেশমা পাঠানের। চার ভাই-বোনের মধ্যে রেশমা ছিলেন সবার থেকে বড়। রেশমার বাবা-মা চাল চুরি করে তাঁদের সংসার চালাতেন। আর এটাই ছিল তাঁদের পেশা। একবার চাল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন রেশমার মা। তখন রেশমা নয় বছরের বালিকা। সে সময় তাঁর বাবার শরীরও খুব একটা ভাল ছিল না। এবং তিনি সেই সময় কাজ করতে অক্ষম ছিলেন। আর তাই ভাই-বোনদের মধ্যে সবথেকে বড় হওয়ার জন্য সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ে রেশমার কাঁধে। জেলবন্দি মাকে দেখতে যাওয়ার সময় কিছু টাকা রোজগারের আশায় রেশমা লুকিয়ে চুরিয়ে অন্য বন্দিদের কাছে বাইরে থেকে বিড়ির প্যাকেট এনে পৌঁছে দিতেন। এতে তাঁর সামান্য উপার্জন হত। আর এই এত সামান্য উপার্জনের টাকায় তিনি তাঁদের এত বড় সংসার চালাতে পারতেন না। আর তখন থেকেই কিছু উপার্জনের আশায় তিনি নিজের জীবনকে বাজি রাখতে শুরু করেন। রাস্তাতেই বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখাতে শুরু করেন তিনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সির ওপর থেকে যখন তিনি ডিগবাজি খেয়ে রাস্তায় পড়তেন তখন সেখানে ভিড় জমে যেত। আর সেই ভিড় থেকে টাকা উড়ে আসত তাঁর দিকে। আর এভাবেই দিন কাটতে থাকে। সংসারেও সবার খাবারের টাকা জুটে যেত এর থেকেই। একদিন একজন স্টান্টম্যান রেশমার এই ট্যাক্সির ওপর থেকে ডিগবাজি খাওয়া দেখে ফেলেন। সেই সময় রেশমার বয়স ছিল ১৪ বছর। এই স্টান্টম্যানের নাম ছিল আজিম। আজিম রেশমাকে বলিউডের সিনেমায় স্টান্ট করার প্রস্তাব দেন। সেই সময় সিনেমা করাটাকে কেউ ভাল চোখে দেখত না। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ তখন সিনেমা করার কথা ভাবতেও পারত না। রেশমা যখন বাড়িতে গিয়ে বাবাকে সমস্তটা জানান তখন তাঁর বাবাও এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। কারণ উপার্জন করতে গিয়ে যদি মেয়ের বিপদ হয়, সেটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। এছাড়াও চারপাশের সমাজের একটা চাপও ছিল সে-সময়। কিন্তু সমস্ত বাধা দূরে ঠেলে স্টান্টওম্যান হিসাবে বলিউডে পা রাখেন রেশমা।
সালটা হচ্ছে ১৯৭২। বলিউডে তখন ‘এক খিলাড়ি বাওয়ান পাত্তে’ নামে একটি সিনেমার শ্যুটিং চলছিল। সেই সিনেমায় প্রথম স্টান্টওম্যান হিসাবে কাজ করেন রেশমা। প্রথমে কথা হয়েছিল তাঁকে প্রতিদিন ১৭৫ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। কিন্তু প্রথম দিন কাজ করার পর হাতে পান মাত্র ১০০ টাকা। বাকি টাকা তাঁকে দেওয়া হয় না। রেশমা বুঝে যান যে এই জায়গায় প্রতিবাদ করে কোনও লাভ নেই। এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে গেলে তাঁকে সমস্ত কিছু মেনে নিতে হবে। এরপর ওয়াহিদা রহমান, ডিম্পল কাপাডিয়া, শ্রীদেবী, হেমা মালিনী, রেখা, মীনাক্ষী শেষাদ্রির মতো সেই সময়কার তাবড় তাবড় নায়িকাদের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন রেশমা।
আরও পড়ুন-চলো যাই পিকনিকে
রেশমার সবথেকে জনপ্রিয় স্টান্ট শোলেতে বাসন্তীর ঘোড়ার গাড়ির ছুট। এই সিনেমাটা ছিল তাঁর স্টান্ট জীবনের মাইলস্টোন। সিনটা ছিল রামগড়ের পাহাড়ি রাস্তায় ডাকাতদের তাড়া খেয়ে বাসন্তী নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে মরিয়া হয়ে তাঁর ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়েছিলেন। আর এই দৃশ্যটা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। আর এই দৃশ্যের পেছনে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তিনি ছিলেন রেশমা। এই দৃশ্যটি শ্যুটিং করতে গিয়ে বড়সড় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন রেশমা। প্রথমবার চাকা ভেঙে যাওয়ার ফলে ঘোড়ার গাড়িটি উল্টে যায়। আর সেই দুর্ঘটনা-কবলিত গাড়িটি থেকে ছিটকে পড়েন রেশমা। আর গাড়িটি তাঁর পায়ের উপর গিয়ে পড়ে। কিন্তু এই রকম অবস্থাতেও রেশমা শ্যুটিং শেষ করেন। ১৯৮০ সালে নির্মিত হয় কর্জ নামক সিনেমাটি। এই সিনেমার একটা দৃশ্য ছিল যেখানে অভিনেত্রী দুর্গা খোটেকে গাড়িতে ধাক্কা মারবে। আর দুর্গা খোটের হয়ে গাড়ির ধাক্কা খেতে হয়েছিল রেশমা পাঠানকে। পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী রেশমার পিঠে গাড়িটি এমনভাবে ধাক্কা দিয়েছিল যে রাস্তার ওপর ছিটকে পড়েছিলেন রেশমা। গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি, আর তাই তাঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল শ্যুটিং স্পট থেকে। এছাড়াও কাশমে ওয়াদে সিনেমায় ঝোপের মধ্যে দৌড়াতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন রেশমা। আচমকা পড়ে যাওয়ার ফলে তাঁর হাত ভেঙে গিয়েছিল।
নিজের জীবনকে বাজি রেখে বলিউডে স্টান্টওম্যান হিসেবে কাজ করতে ঢুকেছিলেন রেশমা। কিন্তু তাঁর এই কাজের জন্য তাঁদের সংসারে সুখ ফিরে এসেছিল।
১৯৮০ সালে স্টান্ট ডিরেক্টর শকুর পাঠানকে বিয়ে করেন রেশমা। দু’জনের সংসার খুব ভালভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই চার বছর পর তাঁদের জীবনে দুঃসময় নেমে আসে, জীবনের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তাঁরা। ১৯৮৪ সালে হঠাৎ করেই সিনেমার ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর তার ফলে রেশমা এবং তাঁর স্বামী শকুর কাজ হারান। সেই সময় রেশমার ওপর তাঁর বোনের দুই ছেলে এবং তাঁর এক সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব ছিল। কাজ চলে যাওয়ার ফলে তাঁরা অসহায় হয়ে পড়েন। কিছু টাকা জমানো ছিল রেশমার, কিন্তু আস্তে আস্তে সেই জমানো টাকাও ফুরিয়ে আসে। এক সময় এমন অবস্থা হয় যে পরের দিন একবেলা খাবারের টাকাও তাঁর কাছে তখন মজুত ছিল না। যখন রেশমার রোজগার ছিল তখন রেশমার অভ্যাস ছিল ঘরের এখানে সেখানে অর্থাৎ কোনও বাক্সে অথবা কোনও কৌটোর মধ্যে টাকা রেখে দেওয়া। এমত অবস্থায় ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে তিনি ১৬০০ টাকা পেয়েছিলেন। আর এই টাকাটা পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। সেই ঘরের আনাচকানাচ থেকে সংগৃহীত টাকা দিয়ে বেশ কিছুদিন সংসার চালিয়েছিলেন তাঁরা। সেই সময় রেশমা উপলব্ধি করেছিলেন যে স্টান্ট মাস্টারদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয়। তাই তিনি চেয়েছিলেন তাঁর এবং তাঁর বোনের সন্তানেরা যেন পড়াশুনা করে ভাল কোনও চাকরি পায়। এই দুর্দশা একটা সময় কেটে যায় রেশমা পাঠানের। এরপরে তাঁর বোনের দুই ছেলে এবং তাঁর ছেলেকে সুন্দর ভাবে মানুষ করতে সক্ষম হন তিনি। তাঁরা সবাই পড়াশুনা করে প্রতিষ্ঠিত হন। রেশমার বোনের এক ছেলে হন ইঞ্জিনিয়ার এবং আরেক ছেলে একটি গাড়ি প্রস্তুত কোম্পানির ম্যানেজার হিসাবে যোগদান করেন। আর তাঁর নিজের ছেলে চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।
আরও পড়ুন-আর জি কর কাণ্ডের চূড়ান্ত রায়ের দিন ঘোষণা আদালতের
অদম্য শক্তি এবং অটুট চেতনার মহিলা রেশমা পাঠান ভারতের প্রথম সফল স্টান্টওম্যান ছিলেন। তিনি সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েরা শুধুমাত্র সংসার নয়, সবকিছুই দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে। যদি কারওর নিজের মধ্যে কিছু করার শক্তি থাকে তাহলে তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। প্রায় চারশোটি ছবিতে কাজ করেছেন রেশমা। রেশমা পাঠান তাঁর কাজের জন্য ক্রিটিক চয়েজ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড (CCFA) পুরস্কারে ভূষিত হন।