নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যের বিস্ফোরক অধ্যায়। তদন্তে ‘মিশন নেতাজি’র গবেষক চন্দ্রচূড় ঘোষ, অনুজ ধর এবং টিম। সৃজিতের ‘গুমনামি’ ছবির অনির্বাণ অভিনীত চরিত্রের আসল গবেষক চন্দ্রচূড় ঘোষের মুখোমুখি অভিজিৎ ঘোষ।
প্রশ্ন : নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য ভেদে এই মুহূর্তে কতগুলি ফাইল রয়েছে?
চন্দ্রচূড় : আমরা ‘মিশন নেতাজি’ শুরু করি ২০০৭-এ। তার আগে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন কোনও সরকার সরকারিভাবে জানায়নি নেতাজিকে নিয়ে সরকারের কাছে ঠিক ক’টি ক্ল্যাসিফায়েড ফাইল রয়েছে। আমরা আরটিআই (রাইট টু ইনফরমেশন) করি। ইউপিএ সরকার ১০০টার মতো ফাইল ডিক্ল্যাসিফায়েড করে। ২০১০-এ আমাদের চাপের কারণেই মুখার্জি কমিশনের ফাইলগুলি ডিক্ল্যাসিফায়েড করা হয়। ২০১৬-র জানুয়ারি থেকে এনডিএ সরকার ডিক্ল্যাসিফিকেশনের কাজ শুরু করে। কিন্তু ক’টা ফাইল সেখানে রয়েছে, তা কখনও জানা যায়নি। ফলে এটাও বলা যাচ্ছে না, সব ক’টি ফাইল ডিক্ল্যাসিফায়েড হয়েছে! সরকার সবমিলিয়ে ৩০৪টি ফাইল ডিক্ল্যাসিফায়েড করে। তারমধ্যে ৩০৩টি ফাইল ন্যাশনাল আর্কাইভে রাখা হয়েছে। একটি ফাইলকে ‘অতি স্পর্শকাতর’ আখ্যা দিয়ে আর্কাইভে রাখা হয়নি। এটা অবশ্য সরকারি বক্তব্য নয়। আমরা বিশেষ সূত্র জানতে পেরেছি।
প্রশ্ন : তাহলে এগুলোই কি নেতাজি সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল?
একেবারেই না। মাঝে-মধ্যেই দেখা যায়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন, সরকার নেতাজি সংক্রান্ত সব ক’টি ফাইল ডিক্ল্যাসিফায়েড করেছে। এমন কেউ যদি বলেন, তাহলে তিনি ডাহা মিথ্যা বলছেন। প্রয়োজনে সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রিভিলেজ মোশনও আনা যায়। কারণ, নেতাজিকে নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়ান্দাদের রিপোর্টগুলিই তো ডিক্ল্যাসিফাড করা হয়নি!
প্রশ্ন : ফাইলগুলোয় রয়েছে কী?
চন্দ্রচূড় : কেন্দ্রের চার দফতরের ফাইল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস, ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক আর বিদেশমন্ত্রক। আর বিষয়বস্তু? মূলত রাজনীতিবিদ আর আমলাদের নানারকমের চিঠি দেওয়া নেওয়ার তথ্য। সেখানে নেতাজির পরিবার যেমন রয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতবিদরাও আছেন। আছে ভারত সরকারের তিনটি কমিশনের চিঠি আর তার সাক্ষীদের বয়ান।
আরও পড়ুন-প্রথম দফায় ১৫৯ প্রার্থীর নাম ঘোষণা সমাজবাদী পার্টির
প্রশ্ন : এটা অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন। গুমনামি বাবার মিউজিয়ামে কী আছে? তৈরি করেও কেন এটির উদ্বোধন হলো না? কী অবস্থায় পড়ে রয়েছে মিউজিয়াম?
চন্দ্রচূড় : গুমনামি বাবার মিউজিয়াম তৈরি হয়েছিল আদালতের নির্দেশে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০১৩-র জানুয়ারিতে নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দেশ ছিল, গুমনামি বাবার সব তথ্য সেখানে রাখা হবে। সেইসঙ্গে নির্দেশ ছিল, এই রহস্যময় মানুষটি কে, তা জানার জন্য তদন্ত করতে হবে। গুমনামি বাবার তথ্য ব্যবহার করা নিয়ে মুখার্জি কমিশনের তদন্তে ক্ষুব্ধ ছিল কোর্ট। ফলে নতুন করে তদন্তের প্রয়োজন ছিল। অখিলেশ যাদব উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর গুমনামি বাবা মিউজিয়াম করতে রাজি হন। কিন্তু ফের তদন্ত চাইছিলেন না। আমরা গিয়ে বোঝাই পরিস্থিতি কী? কেন ফের তদন্তের প্রয়োজন! যুক্তি শুনে অখিলেশ রাজি হলেন। ২০১৬ তে তৈরি হলো সহায় কমিশন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বিষ্ণু সহায় মুজ্জাফফরনগর দাঙ্গা মামলার দায়িত্বে ছিলেন। আমরা কথা বলি সহায়ের সঙ্গে। কথা বলে আমার ধারণা হয়, এই তদন্ত আসলে লোক দেখানো। কিস্যু হওয়ার নেই। হলও তাই। সহায় কমিশ্ন তার রিপোর্টে জানাল, গুমনামি বাবা নেতাজি নয়। কিন্তু তিনি কে তা জানাতে পারল না। ভাবুন, তাহলে এটা কিসের কমিশন? এবার আমি আর অনুজ ধর সমস্ত তথ্য নিয়ে একটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নিই। বইয়ের নাম : কনানড্রাম : সভাষ বোসেস লাইফ আফটার ডেথ ইন এপ্রিল ২০১৯। বইটা আজ পর্যন্ত বেস্ট সেলার।
আরও পড়ুন-প্রবেশ নিষেধ
প্রশ্ন : মিউজিয়ামটা কী অবস্থায় রয়েছে?
চন্দ্রচূড় : হ্যাঁ, মিউজিয়াম তৈরি হলো। দুটো বিরাট হলে গুমনামি বাবার নানা তথ্য সাজানো হলো। মিউজিয়ামটা অযোধ্যায় রামকথা মিউজিয়ামের লাগোয়া ছিল। আদিত্যনাথ যোগীর হাতে ২০১৭ সালে উদ্বোধনের কথা ছিল। ছুটে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। সাহায্য চেয়েছিলাম। তিনি আশ্বাসও দেন। কিন্তু শেষ পাঁচ বছরে একবারও কোনও চিঠি, ফোন কোনও কিছুরই জবাব দেননি। মিউজিয়ামে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি আমি পাঠিয়েছিলাম নিজের উদ্যোগে।
প্রশ্ন : নেতাজি অন্তর্ধানের রহস্যটা এই মুহূর্তে সরকারিভাবে কোথায় দাঁড়িয়ে?
চন্দ্রচূড় : পরিস্থিতিটা রীতিমতো দুঃখজনক। দায় এড়ানোর ভঙ্গিতে ২০১৭ সালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার জানাল, নেতাজি তদন্ত নিয়ে তারা আগের ইউপিএ সরকারের অবস্থান অনুযায়ী চলছে। আমরা হাতে গরম যে তথ্য দিয়েছিলাম, তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, প্রতুলচন্দ্র গুপ্তর লেখা ‘এ আনপাবলিশড হিস্ট্রি অফ আই এন এ’ হাতে আশার কারণে আমার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামন্ত্রক মামলা করে ২০১২ সালে। প্রতিরক্ষামন্ত্রক আদালতকে কথা দিয়েছিল, দু’বছরের মধ্যে সেই তথ্য প্রকাশ করবে। কিন্তু আইএনএ-র ইতিহাসের কথা ধামাচাপা পড়ে রয়েছে, আমার বিরুদ্ধে মামলাও তোলেনি। তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বারবার বিষয়টি সংসদে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেটা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই হয়নি।
আরও পড়ুন-আমরা বুড়ো হই কেন
প্রশ্ন : আর বেসরকারিভাবে নেতাজি তদন্ত কোথায় দাঁড়িয়ে?
চন্দ্রচূড় : আমরা সবরকমের তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেছি, গুমনামি বাবা আর কেউ নন, তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস। যিনি বেঁচে ছিলেন ১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
প্রশ্ন : নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে তিনটি কমিশন হয়েছিল। এগুলোর নিট ফল কী?
চন্দ্রচূড় : নেতাজির মৃত্যু রহস্য সমাধানে তিন তিনটি কমিশন হয়েছিল কেন্দ্রের নির্দেশে। জনমতের চাপে পড়ে জওহরলাল নেহরু আমলে হয় শাহনাওয়াজ কমিশন। মৃত্যু রহস্য সমাধানে প্রথম তদন্ত কমিশন। কিন্তু এই কমিশনের কর্মপদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। তাইওয়ানে যেখানে নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল বলে প্রচারিত ছিল, সেখানেই যায়নি কমিশন! গ্রাউন্ড জিরোতেই যদি না যায়, তাহলে কিসের তদন্ত? শাহনাওয়াজ কমিটির অন্যতম সদস্য, নেতাজির সেজদা সুরেশ্চন্দ্র বসু আলাদা তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তথ্য প্রমাণ তুলে দেখান, বিমান দুর্ঘটনা আসলে নিছকই গল্প।
এরপরে ইন্দিরা গান্ধী জমানায় এক সদস্যের খোসলা কমিশন। এই কমিশন আরও এক কদম এগিয়ে সব কিছু গুলিয়ে দিল। তদন্ত শুরুই করল নেতাজির মৃত্যু হয়েছে ধরে নিয়ে। বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি মারা যাননি, সেই রিপোর্ট নথিভুক্তই করল না।
মুখার্জি কমিশন খুঁটিয়ে তদন্ত করার অভিপ্রায়ে কাজ শুরু করেছিল। কমিশন স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল, বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি নেতাজির। জাপানের রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভষ্মও নয় নেতাজির। চিতাভষ্ম তাইওয়ান সেনা ওকুরা ইচিরোর। কমিশন সোভিয়েত রহস্যও ভেদ করতে রাশিয়ে যায়। সোভিয়েত-হত্যার অভিযোগও কার্যত খারিজ হয়ে যায়।