প্রতিমার কাঠামোই তৈরি হয়নি, অথচ ঢাকে কাঠি। পুজো এসেছে আর আমরাও তৈরি, চারদিকে এরকম একটা পরিবেশ প্রচারের আলোয় এনে ভোট মেশিনে ফায়দা তোলার আয়োজন। সিএএ (ক্যা) নিয়ে বিজেপি যা করছে, তাতে এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে বেশ কিছু ভারতীয় নাগরিককে ভারত সরকার স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। সৌজন্যে অবশ্যই কাবুল বিমানবন্দরে ঘাঁটি গাড়া মার্কিন সেনা। উদ্ধার করে আনা ব্যক্তিদের মধ্যে আফগানিস্তানের নাগরিকও কিছু সংখ্যায় আছেন। ধর্ম পরিচয়ে তাঁরা হিন্দু ও শিখ।
ব্যস! ওই ছুতোয় ভারতীয় জুমলা পার্টির সভাপতি জে পি নাড্ডা আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি একবার সিএএ নিয়ে প্রচার সেরে নিলেন। সগর্বে ঘোষণা করা হল, এজন্যই সিএএ লাগু করা দরকার। কিন্তু সত্যি কথাটা হল, সিএএ-তে আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার করে আনা হিন্দু বা শিখদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, নাগরিকত্ব পেতে গেলে ডিসেম্বর,২০১৪-র আগে থেকে ভারতের বাসিন্দা হতে হবে। তাছাড়া, আইনটা পাশ করার পর বিশ মাস কেটে গেলেও সিএএ প্রয়োগ করার নিয়মকানুন স্থির করার ব্যাপারটা বিশ বাঁও জলে। তদুপরি, ক্যা এখনও বিচারবিভাগের কাছ থেকে সাংবিধানিক বৈধতার স্বীকৃতি পায়নি। আদালত এখনও পরিষ্কার করে জানায়নি যে সিএএ সাংবিধানিকভাবে বৈধ। শরণার্থীদের নিয়ে ভারতের নীতি পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিক হয়।
আরও পড়ুন-জোড়া নিম্নচাপের জেরে ফের বৃষ্টিতে ভাসবে দক্ষিণবঙ্গ
তাই এদেশে যেসব মানুষ আশ্রয় পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে তিব্বতি, শ্রীলঙ্কা থেকে আগত তামিল, মায়ানমারের চিন জনগোষ্ঠী ও আফগান, এমনকী চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত সংখ্যালঘু চাকমারাও রয়েছেন। ১৯৭০-৭১-এ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত মানুষদের আশ্রয় দিয়ে ভারত জগৎসভায় অভিনন্দিত হয়েছে। এজন্যই নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর চিন্তাভাবনা যখন করা হয়েছিল, তখন ভাবা গিয়েছিল যে এই পদক্ষেপ ভারতের অতীত ঐতিহ্য অনুসারী হবে। কিন্তু অচিরেই তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মোদি-শাহ জমানায় যে সিএএ আনা হল তাতে সংবিধানের সাম্য নীতিই লঙ্ঘিত হল। কী রয়েছে সিএএ-তে? সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আগত নির্যাতিত হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টানরা এদেশে নাগরিকত্ব পাবেন। মোদি-শাহদের যুক্তি, যেহেতু উল্লিখিত দেশসমূহে মুসলমানরা শাসক শ্রেণি, সেহেতু তাঁরা নির্যাতিতের বন্ধনীভুক্ত হতে পারেন না।
আরও পড়ুন-হাঁটুব্যথা ও অস্টিওআর্থ্রাইটিস
নির্যাতিতের এই ধর্মভিত্তিক বিভাজন কিন্তু রাষ্ট্রসংঘের নীতি অনুসারী নয়। ১৯৫১তে প্রণীত রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী বিষয়ক নীতির ১ক(২) নং অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, নিজদেশের সীমানার বাইরে যদি কাউকে জাতি-ধর্ম সম্প্রদায়গত পরিচয়ের কারণে কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শ বা বিশেষ সামাজিক পরিচয়ের কারণে নির্যাতিত হওয়ার আতঙ্কে চলে আসতে হয়, তবে সে-ই শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে ‘well-founded fear of persecution’ (নির্যাতিত হওয়ার দৃঢ় প্রোথিত ভীতি) একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ধর্ম নয়। এটাই সারা বিশ্বে অনুসৃত শরণার্থী নীতির ভিত্তি। এই নীতিতে কোনও ধর্মভিত্তিক বিভাজন স্বীকৃত নয়। নির্যাতিতের ধর্ম পরিচয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর নির্যাতনের পরিমাণ, সে সংক্রান্ত আতঙ্ক। মোদি-শাহ জমানার এই নয়া সিএএ-র ধ্যান-ধারণায় তাই আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হয়েছে। সরকারি প্রচার বলছে, সিএএ নাকি নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধি, নাগরিকত্ব কাড়ার ছুতো নয়। কিন্তু কথার প্যাঁচে আড়াল করা হচ্ছে একটা ভয়ানক সত্য। কাল যদি বাংলাদেশ থেকে একদল হিন্দু কিংবা আফগানিস্তান থেকে একদল শিখ অথবা পাকিস্তান থেকে একদল খ্রিস্টান সেদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশে আশ্রয়ের খোঁজে আসেন তবে তাঁদের নাগরিকত্বদানের কথা সিএএ-র কোথাও বলা নেই। তাঁদের ভারত আশ্রয় দেবে, দেবেই, এমন গ্যরান্টি সিএএ দেয় না। একইভাবে, মায়ানমারের রোহিঙ্গা কিংবা আফগানিস্তানের হাজরাদের মতো কোনও সম্প্রদায় নিজদেশে নির্যাতনের শিকার হলেও এদেশে যে ঠাঁই পাবেন, এমন কথাও সিএএ বলছে না।
আরও পড়ুন-রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আসছে শুনেই ভয়ে ওরা কাঁপছে
সংক্ষেপে, যে তিনটি দেশের কথা সিএএ-তে উল্লিখিত হয়েছে, সেই তিনটি দেশেও যেসকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার, তাঁদের আশ্রয় নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয় কিন্তু সিএএ নিশ্চিত করছে না। ওই তিন দেশের যে ছয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কথা সিএএ-তে পরিষ্কারভাবে উল্লিখিত তাঁদেরও যদি কেউ স্বদেশে নির্যাতিত হয়ে ভারতভূমে আশ্রয়ের অন্বেষণে আসেন, তাঁকেও বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হবে। এদেশে নাগরিক অধিকার অর্জন করে মাথা উঁচু করে বাঁচবেন, তেমন সুযোগ অন্তত সিএএ করে দেবে না। এর মানে এই নয় যে শরণার্থী হয়ে এদেশে কেউ এলে তিনি আশ্রয় বা সাহায্য পাবেন না। এমনকী কিছু কিছু শর্ত পূরণ করলে তিনি এদেশের নাগরিকত্ব পেতে পারেন। তাঁকে সেই নাগরিকত্ব অর্পণের অধিকার সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকার হিসেবে ভারত সরকারের আছে। এবং সেই অধিকার বা ক্ষমতা সিএএ সঞ্জাত নয়। যবে থেকে দেশে সংবিধান কার্যকর হয়েছে, তবে থেকে ভারত সরকারের এই ক্ষমতা আছে। এর সঙ্গে এই সিএএ-র কোনও সম্পর্ক নেই। সিএএ চালু হোক বা না হোক, ভারত সরকারের এই ক্ষমতা ছিল এবং আজও আছে। সুতরাং, মিথ্যে প্রচারের ঢাক না পিটিয়ে, ফাঁকা বুলি না আওড়ে, সরকার বাহাদুর যেটা করতে পারেন সেটা হল আফগানিস্তানের নাগরিকদের এদেশে থাকার জন্য ভিসার সময়সীমা বৃদ্ধি। যাঁরা এদেশে আছেন তাঁদের জন্য তো বটেই, যাঁরা সবে এলেন, তাঁদের জন্যও। এর বাইরে আর কিছু করার ক্ষমতা নেই মোদি-শাহদের।