পুনরালোচনা সম্ভবত অনাবশ্যক। তবু নান্দীমুখে প্রসঙ্গটির পুনরুত্থাপন অনাবশ্যক নয়। স্মৃতির সলতে উসকে দেখলেই মনে পড়ে যায়, ১৯৩০-এর দশকে ফ্যাসিবাদের জন্ম প্রথমে ইতালিতে, পরে জার্মানিতে। তা ছিল গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ‘‘বাড়াবাড়ির” বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হিংস্র প্রতিক্রিয়া। মুসোলিনি ও হিটলার দাবি করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালি-জার্মানির পরাজয়ের জন্য এগুলিই নাকি দায়ী। তাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁরা জনগণের জীবনের সব দিকের ওপর চরম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। মানে ফ্যাসিবাদের উত্থানই হয়েছিল গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে রুখতে। আর এখন সেটাই উঁকি মারছে এদেশে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
কীভাবে বুঝব কোনটা ফ্যাসিবাদের লক্ষণ আর কোনটা নয়?
লুনা রুশদি ফ্যাসিবাদের চোদ্দোটি লক্ষণ শনাক্ত করেছিলেন। ২০০৩ সালে ‘ফ্রি এনকোয়ারি’ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে উল্লিখিত ফ্যাসিবাদী লক্ষণগুলি নিম্নরূপ—
১। পরাক্রমী জাতীয়তাবাদ— ফ্যাসিবাদী শাসনকালে দেশভক্তিমূলক আদর্শ, স্লোগান, গান, প্রতীক এবং অন্যান্য সাজসজ্জা ইত্যাদি ব্যবহার বেড়ে যায়।
২। মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণার প্রকাশ— ফ্যাসিবাদী সমাজব্যবস্থায় জনসাধারণকে বিশ্বাস করানো হয় যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনের’ খাতিরে মানবাধিকার উপেক্ষা করা যায়।
৩। শত্রু শনাক্তকরণ— ফ্যাসিবাদ এক বলির পাঁঠা বা ছায়াশত্রু খুঁজে নেয়।
৪। সামরিক আধিপত্য— দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্যোগ ও সমস্যা অবহেলা করেও সামরিক বাহিনীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-বিজেপি এখন অপরাধীদের আঁতুরঘর, পরিষেবায় বেহাল মোদি-রাজ্য
৫। উৎকট লিঙ্গবৈষম্য— ফ্যাসিবাদী দেশগুলোতে প্রায় একচেটিয়া ভাবেই সরকার হয় পুরুষ-আধিপত্যাধীন। ফ্যাসিবাদী সমাজ-ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের প্রথাগত ভূমিকা অনমনীয়ভাবে পালিত হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ, গর্ভপাত বা সমকামিতা নিষিদ্ধ হয়। রাষ্ট্রকে উপস্থাপন করা হয় পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত অভিভাবক হিসাবে।
৬। নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম— গণমাধ্যমকে পুরোদস্তুর কবজায় আনার বন্দোবস্ত করা হয়।
৭। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে মাতামাতি—জনসাধারণকে বৈদেশিক শত্রুর ভয় দেখিয়ে উত্তেজিত রাখা হয়।
৮। ধর্ম ও রাষ্ট্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে
৯। বড় পুঁজির সঙ্গে দহরম-মহরম—ফ্যাসিবাদে দেশে অনেক সময়েই বনেদি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোই সরকারকে ক্ষমতায় আনে। সরকার ও এসব প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সুবিধাজনক লেনদেনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
১০। শ্রমিক-কৃষকদের ক্ষমতা রোধ— কারণ, খেটে খাওয়া মানুষের সাংগঠনিক শক্তি ফ্যাসিবাদী সরকারের জন্য হুমকি স্বরূপ।
১১। বুদ্ধিবৃত্তি ও শিল্পের প্রতি অবজ্ঞা—ফ্যাসিবাদী দেশগুলো প্রায় সময়েই উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষায়তনের সঙ্গে খোলাখুলি বৈরিতা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার করা বা তাঁদের বক্তব্য সেন্সর করা বিরল নয়। শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনে স্বাধীনভাবে কথা বলতে গেলে সরাসরি আক্রমণ করা হয়।
১২. অপরাধ ও শাস্তির বিষয়ে মাত্রাহীন আগ্রহ— ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় পুলিশকে আইন প্রয়োগের নামে প্রায় সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়। দেশপ্রেমের নামে চলে পুলিশি নির্যাতন।
আরও পড়ুন-রাজ্য পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই যৌথ তদন্তের নির্দেশ কোর্টের
১৩. অবাধ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি
১৪. নির্বাচনে কারচুপি— ফ্যাসিবাদী দেশে নির্বাচন মানেই সম্পূর্ণ ধোঁকাবাজি।
এবার তাকান আজকের ভারতের দিকে।
যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অ্যাকটিভিস্ট কার্তিক রামানাথানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাওম চমস্কি বলেছেন, ‘ভারতে আমরা যা দেখছি, তা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ছাড়াই ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। ফ্যাসিবাদের অর্থ হচ্ছে, একটি সর্বাত্মকবাদী সরকারের রাষ্ট্রের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, নাৎসি বা কোনও ফ্যাসিবাদী দলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র, যা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। নাৎসিরা কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। অবশ্য ভারতে তা দেখা যাচ্ছে না। সেখানে রাষ্ট্র বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে না। কিন্তু ভারতে ফ্যাসিবাদের অন্যান্য লক্ষণ সুস্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশটির গণমাধ্যমও সেভাবে সরকারের সমালোচকের স্থান নিতে পারছে না।’ পাশাপাশি ভারতের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বলির পাঁঠা মুসলিম-দলিত-আদিবাসী। এবং অবশ্যই উদারমনস্করা। এঁরা সবাই ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’। চিন বা পাকিস্তানকে জব্দ করার মিথের উপর ভিত্তি করেই নির্বাচন জেতার প্রয়াস এদেশে মোটেই দুর্লক্ষ্য নয়। হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনাও নিঃসন্দেহে ফ্যাসিবাদী লক্ষণ।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, বদলে গেল দমদম রোডের নাম
যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক সাত লক্ষণসমূহের এক তালিকা রয়েছে। এটির কথা আমরা মহুয়া মৈত্রর ভাষণেও শুনেছি। তার সঙ্গেও বর্তমান ভারতের হুবহু মিল।
১। দেশে শক্তিশালী অংশের জাতীয়তাবাদ ক্রমে দেশের জাতীয় পরিচয়ে পরিণত হয়। সংখ্যালঘুদের তা অস্বীকার করে। মুসলমান নাগরিকদের বারংবার পিটিয়ে মারার পর ভারতে এই লক্ষণের উপস্থতি নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না।
২। মানবাধিকারের প্রতি একটি ব্যাপক অবজ্ঞা দেখা দেয় ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে এই প্রবণতা অন্তত ১০ গুণ বেড়েছে।
৩। গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ। ভারতের প্রিন্ট মিডিয়া ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর একাংশ নিজেদের প্রাইমটাইমের বড় অংশ ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় ব্যয় করে চলেছে।
৪। জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি অতিরিক্ত সচেতনতার জন্য, পাকিস্তান ও চিন নিয়েই সারাক্ষণ মাথাব্যথা। অথচ দেশের মানুষের অসন্তোষ নিয়ে আলোচনা নেই।
আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আরও উন্নত প্রশিক্ষণ পুরসভার
৫। সরকার ও ধর্ম পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া। এ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার দরকার পড়ে না।
৬। বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের প্রতি চরম শুধু অবজ্ঞা নয়, এ-দেশে বিরাশি বছরের কবি ভারভারা রাও-এর উপর রীতিমতো নির্যাতন চলে।
৭। নির্বাচন ব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। নেতা, মন্ত্রী, এমপি কেনাবেচার ঘটনা স্মরণ করা যায় এ-প্রসঙ্গে।
এই অবস্থা রুখতে দিকে দিকে জনমত গড়ে তুলতে হবে। আর দেরি করলে চলবে না। শিয়রে সংক্রান্তি।