কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর (Artificial Intelligence) প্রয়োগ নিয়ে গোটা পৃথিবীতে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। ক্রমশ এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। সমীক্ষা জানাচ্ছে, আগামী ৫ বছরে বিশ্ব জুড়ে কাজ হারাতে পারেন ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ। এমনই জানাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বা ডব্লিউইএফের রিপোর্ট। যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উন্নয়ন ঘটছে, তাতে কর্মক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলছে। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মী সঙ্কোচন হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারের ভাল দিক যেমন আছে, তেমনই রয়েছে নেতিবাচক কিছু বিষয়। তার মধ্যে অন্যতম হল কর্মী-সঙ্কোচন। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের জন্য সংস্থাগুলি যেমন কিছু কর্মী নিয়োগ করবে, তেমনই এর ব্যবহারের ফলে পুরনো অনেক কর্মীর আর প্রয়োজন বোধ করবে না সংস্থাগুলো। সেখান থেকেই আসতে পারে কর্মী-সঙ্কোচন।
আগামী ৫ বছরে কোন কোন পেশায় ‘এআই’ হানা দিতে পারে সম্প্রতি তার একটি তালিকা প্রকাশ্যে এসেছে। ব্যাঙ্কের চাকরির ক্ষেত্রে এআই-এর একটি বড় প্রভাব পড়তে পারে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, ‘অনলাইন ব্যাঙ্কিং’-এর সুবিধা থাকায় এমনিতেই এখন ব্যাঙ্ককর্মীদের কাজ অনেকটাই কমেছে। তবে কয়েক বছরে এআই-এর কৃপায় সশরীরে ব্যাঙ্কে গিয়ে প্রয়োজন মেটানোর আর দরকার হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। এর ফলে গোটা বিশ্ব জুড়ে কাজ হারাতে পারেন অসংখ্য ব্যাঙ্ককর্মী। একই ভাবে পোস্টাল সার্ভিস ক্লার্ক, ডেটা এন্ট্রি কর্মী, ক্যাশিয়ার, হিসাব রক্ষক— এআই-এর কারণে আগামী ৫ বছরে এই ধরনের ভূমিকাগুলি প্রায় এক তৃতীয়াংশেরও বেশি হ্রাস পেতে পারে। ২০২৭ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৩ লক্ষ মানুষ কর্মহীনও হয়ে পড়বেন। আগামী ৬ বছর শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের কাজ চলে যাবে। যা বর্তমান কর্মসংস্থানের প্রায় ২ শতাংশ।
সারাজীবন কাজ করেছেন কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই) নিয়ে। ঝুলিতে রয়েছে একাধিক স্বীকৃতি এবং পুরস্কার। কিন্তু এখন নিজেই নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা করছেন বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী তথা কৃত্রিম মেধা (Artificial Intelligence) তৈরির ‘গডফাদার’ জিওফ্রে হিন্টন। ভয় পাচ্ছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ভবিষ্যতে তৈরি হতে চলা এরকম পরিস্থিতি নিয়ে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপকারিতা এবং ঝুঁকি নিয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলার জন্য গুগল থেকে পদত্যাগ করেছেন হিন্টন। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে হিন্টন জানিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার করে চলেছে সমাজের একাংশ। ভুয়ো ছবি এবং খবর তৈরিতে যে ভাবে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হিন্টন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এআই শিল্পে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার কারণে সকলেই নতুন নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন। ফলে এর অপব্যবহারকে ঠেকানো অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাঁর দাবি, কৃত্রিম মেধা বিশ্বকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কোনটা ‘সত্য’ আর কোনটা ‘মিথ্যা’ তা খুঁজে বার করা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি স্বীকার করেছেন, এআই-এর নিজস্ব ভাবে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে। এমনকী মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। ফলে বিশ্বব্যাপী ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মীছাঁটাই বাড়তে পারে। চাকরির অভাব দেখা দিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা জেনে ভয় পেয়েছেন— জানালেন আরও এক ধনকুবের। এলন মাস্কের পর ওয়ারেন বাফে। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)-এর তুলনা টেনেছেন পরমাণু বোমার সঙ্গে। ওয়ারেন জানিয়েছেন, চ্যাটজিপিটি এত কিছু করতে পারে, তা জেনে যেমন তিনি অভিভূত, তেমনই তাঁর মধ্যে একটি আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বলেছেন, ‘আমরা তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু বোমাও তৈরি করেছিলাম। কিন্তু সেটা কি কোনও ভাল কাজ করেছে? পরের ২০০ বছরে ওই আবিষ্কার কী ভাল কোনও প্রভাব ফেলতে পেরেছে? আমার বিশ্বাস, মানুষের ভাবনা-চিন্তার প্রক্রিয়া ছাড়া এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আগামী দিনে সব কিছু বদলে দেবে।’
কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) কি সত্যিই আমাদের সবার কাজে থাবা বসাবে? এটা আসলে একটা ধারণা। আমরা যতই বিজ্ঞান পড়ি না কেন, হৃদয়কে কী করে অস্বীকার করি। তাই এআই-এর কারণে বেকারত্বের বৃদ্ধি, এখনও পর্যন্ত এই মতামত ভয়সঞ্জাত। তথ্যপ্রসূত নয়।
আরও পড়ুন-এখনই মৃত্যুদণ্ড নয় ৮ প্রাক্তন নৌসেনার, ভারতের আর্জিতে সাড়া কাতারের
তার মানে এই নয় যে নতুন এই প্রযুক্তি কাজের বাজারে নতুন চ্যালেঞ্জ আনবে না। কিন্তু তার চরিত্রটা কী হবে প্রশ্ন সেটাই। ম্যাকিনসে এটা নিয়ে সমীক্ষা করেছে। তাদের সমীক্ষা বলছে আগামী দিনে কাজের বাজারে একটা বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। আমরা ভাবছি এর ফলে বাজারে কাজের বাজার সঙ্কুচিত হবে। কিন্তু সব সমীক্ষাই বলছে এই ধারণাটা বোধহয় ঠিক নয়। ঠিক কী হবে তা নিয়ে কিন্তু এখনও কোনও নিশ্চিত তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তে কেউ আসতে পারছেন না।
তাই আলোচনাটা আসলে বদলের দিশা নিয়ে। কাজের ধরনের পরিবর্তনের দিশা নিয়ে। আমরা জানি ব্যাঙ্কে কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদের কথা। কিন্তু কম্পিউটার চালু হওয়ার পরে ব্যাঙ্কে কাজ সহজ হয়েছে এবং নতুন কাজের জায়গা তৈরি হয়েছে। কাজটা আরও সহজ হয়েছে। এ-ব্যাপারে সবাই সহমত যে এই প্রযুক্তি কখনওই মানবিকতাকে আত্মস্থ করতে পারবে না। আর তা পারবে না বলেই চ্যাটজিপিটি যতই লিখুক সে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে পারবে না। তাই শিক্ষকের জায়গা নিতে পারবে না, লেখক হয়ে উঠতে পারবে না, উকিলও না, ডাক্তারও না। ডাল-ই কোনওদিনই সালভাদর ডালি হয়ে উঠতে পারবে না। শুধু তাকে নকল করতে পারবে।
আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) কাজ করে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। নির্দিষ্ট যৌক্তিক পরিসরে। আমরা কিন্তু অজানা পরিসরেও উদ্ভাবনী হতে পারি। কৌশলী হতে পারি। হতে পারি অযৌক্তিক। আর পারি হৃদয়ের ডাক শুনতে, যার একটা বড় অংশই হল মানবিকতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর কোনওটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দক্ষতার পরিসরে নেই। আমরা আসলে যা বলছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে, বা যা ভাবছি নতুন প্রযুক্তির আগ্রাসী প্রসার নিয়ে তা হল অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার ভয়। আর এখানেই আমাদের জিত। কম্পিউটার ভালবাসতে পারবে না। আর তাই সে মানুষের মতো সৃজনশীল হতে পারবে না। কম্পিউটার ভয় পেতে পারে না। তাই সে মানুষের মতো কৌশলী হতে পারবে না। কিন্তু যে কাজে পৌনঃপুনিকতা আছে সেখানে এর প্রসার হবে।