অংশুমান চক্রবর্তী: বাংলা কবিতা নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কাছে পরিচিত নাম সুশীল মণ্ডল। দীর্ঘদিন লিখছেন। পাশাপাশি সম্পাদনাও। এইবছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘বসন্ত দিনের বৃষ্টি’। ৭২ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ৬৪টি কবিতা। প্রত্যেকটা ছোট, এক পৃষ্টার। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হল, অকারণ দুর্বোধ্যতায় বিশ্বাসী নন কবি। নিজেকে প্রকাশ করেন সহজ-সরলভাবে। কয়েকটা কবিতার উপর আলোকপাত করা যাক।
‘জোনাকি আলো’ কবিতার প্রথম দুই পংক্তিতে কবি লিখেছেন :
‘আলোর খোঁজ পেলে সব দেশই আমার দেশ/ রাত্রির গন্ধ মোহনায় ভাসিয়ে দিতে আমি রাজি।’
এমন সৎ উচ্চারণ একজন প্রকৃত কবিই করতে পারেন। কোনও সীমারেখা তাঁকে আটকে রাখতে পারে না। তিনি পৃথিবীর সন্তান। তবে সেই সমস্ত দেশের সঙ্গে তাঁর আত্মীক সম্পর্ক, যেখানে অশুভ কালোর উপস্থিতি নেই। হিংসা নেই। আছে পবিত্র আলো। প্রয়োজনে রাত্রির সুগন্ধকেও হেলায় উপেক্ষা করতে পারেন।
আরও পড়ুন-বিরিয়ানি আজ সর্বজনীন
আট পংক্তির কবিতার শেষ পংক্তিটি চমকপ্রদ। কবি লিখেছেন : ‘সেদিন পৃথিবীকে পথ দেখাবে জোনাকির আলো।’
কেন এই উচ্চারণ? কবির দৃষ্টি পেরিয়ে গেছে কালের সীমানা। সুদূর ভবিষ্যতের দিকে। জোনাকির মতো যাদের ক্ষুদ্র, গুরুত্বহীন মনে হয়, তারাই হয়তো পথ দেখাবে আগামীতে। কবি চরম আশাবাদী। ভালো লাগে কবিতাটি।
যাওয়া যাক ‘তরঙ্গিত দিন’ কবিতায়। কবি লেখেন :
‘মাঝে মাঝে/ অভিসার ডাকে পলাশের রং মাখতে/ যৌবন ফুরানো বাড়ির ছাদ/ স্বপ্ন দেখায় বাণী বন্দনার সকালের/ একটি শব্দময় প্রহরের গা বেয়ে/ ব্যকুল গন্ধে নিজেকে চুবিয়ে ধরার ইচ্ছে/ কানে কানে বলে যায়/ তবু মনে রেখো।’
নস্টালজিয়ায় ডুব দেন কবি। বারবার তাঁর সামনে দাঁড়ায় অতীত। টুকরো টুকরো কিছু মুহূর্ত। উজ্জ্বল মুহূর্ত। যেগুলো ভোলা যায় না। ভুলতে দেয় না। আছে আরও কিছু অংশ। ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে গুঁড়ো গুঁড়ো মনকেমন। কবিতাটি নাড়া দিয়ে যায়।
পাশাপাশি ‘ফেরা’, ‘এভাবে ভেজার জন্য’, ‘প্রতীক্ষা’, ‘শোক’ প্রভৃতি কবিতাগুলো পড়তে ভাল লাগে। প্রচ্ছদশিল্পী সুব্রত চৌধুরী।
আরও পড়ুন-আধ্যাত্মিকতা সামাজিকতা ও অর্থনীতির সুষম মেলবন্ধন এই কোরবানি
সুনেন্দু পাত্র-র কবিতার বই ‘জলের বাড়ি’। প্রকাশিত হয়েছে গতবছর। এটা একটি সিরিজ। ১৬ পৃষ্ঠায় আছে মোট ১৬টি কবিতা।
১ সংখ্যক কবিতায় কবি লেখেন :
‘জল দিয়ে সাজানো আমার একটি আশ্রম ছিল।/ শহর থেকে কিছুটা দূরে।/ তীব্র সব জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আমরা বাঁচতুম খুব।/ তখন জলের নাভি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতো আমাদের/ নুনচি হাওয়া ও নির্ভার প্রজ্ঞাবোধ।/ শহর থেকে আবছা দূরে আজও আমাদের বাস/ সেই জন্মকালীন যন্ত্রণা।’
উচ্চারণে নতুনত্ব লক্ষ্য করা যায়। কবিতায় উঠে এসেছে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার জনজীবনের কথা। নোনা মাটির কথা। কবির উঠে আসা এমন অঞ্চল থেকেই। তাই ভাবনা একেবারেই আরোপিত নয়, নিজস্ব। সেই কারণেই সার্থকভাবে জল দিয়ে সাজানো আশ্চর্য আশ্রমের বর্ণনা করতে পারেন।
এবার ১৬ সংখ্যক কবিতায় চোখ রাখা যাক :
‘জলের আবরণ খসে পড়েছে আজ/ দূরায়ত বিকেল ভিজে উঠছে রুদ্র বাতাসে/ ধার্মিক পিতা বসে আছেন। বসে আছেন মৎস্যগন্ধা নারী/ তবে এ আকাশ কার!/ কার দখলে আজ বৃষ্টিফোঁটায় ভিজে যাওয়া গন্ধ/ ভাঙ্গা মাটির দেয়াল, তুলসীতলার অনুরাগ…।’
চেনা ছক ভাঙার চেষ্টা করেছেন কবি। অনেকটাই সফল। সূক্ষ্ম দৃষ্টি আছে তাঁর। তাই দেখতে পান ‘জলের আবরণ’। ভাবনার বৈচিত্র্য প্রকাশ পেয়েছে জলজ কবিতাগুলোয়। আশাকরি পাঠক সিক্ত এবং স্নাত হতে চাইবেন। প্রচ্ছদশিল্পী শ্যামল জানা।
আরও পড়ুন-মুঘলদের রান্নাঘর
দিশা চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘নিছক বৃষ্টিকথা’। প্রকাশিত হয়েছে দুই বছর আগে। ৩২ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ছোট-বড় ২৫টি কবিতা। যাওয়া যাক কয়েকটি কবিতায়।
‘অনুচ্চার’ কবিতায় কবি লিখেছেন :
‘চারপাশে বড্ড আওয়াজ/ কতবার আরজি জানিয়েছি/ শব্দ, কোরো না/ কেউ শোনেনি, কেউ শোনে না।/ কতবার বলেছি–/ নিঃশব্দে কথা বলতে শেখো।/ গাছেরা বাতাসে দুলতে দুলতে/ নিঃশব্দে ঢলে পড়ছে মাটিতে।’
শঙ্খ ঘোষ মনে পড়ে যায়। তিনিই তো বলেছেন শব্দহীন হতে, নিঃশব্দে নিঃশব্দ কবিতা লিখতে। অনুকরণ নয়, অগ্রজকে হয়তো অনুসরণ করেছেন আলোচ্য কবি। তারপর ফিরেছেন নিজস্ব উচ্চারণে। লিখেছেন :
‘দেখেছো কী?/ জলের স্রোতে নীরবে মিশে যাচ্ছে/ জীবনের ছায়া!/ মৌন ধ্রুবপদে গান গাইছে পাহাড়ও…/ এতকাল নিজেকে গোপন রেখেছিলাম অন্য ব্রহ্মাণ্ডে।’
কবিতার ‘মৌন ধ্রুবপদে গান গাইছে পাহাড়ও’ এই অংশটি কবি দিশা চট্টোপাধ্যায়ের জাত চিনিয়ে দেয়। গভীর উচ্চারণ। অন্তর্ভেদী মনন। ফলে সহজেই আগ্রহী করে তোলে কবির লেখা অন্য কবিতাগুলিতে যেতে।
আরও পড়ুন-উত্তরবঙ্গের ৯ তীর্থযাত্রী নিরাপদে ফিরছেন
এবার পাঠ করা যাক ‘বয়ে যাক নদী’ কবিতার কিছু অংশ :
‘স্তব্ধতা ঘিরে থাক/ বয়ে যাক ভালোবাসা নদী/ ছত্রাকের মতো ছড়িয়ে থাকে/ স্মৃতি দুঃখ বিপদ ও বৃক্ষছায়া।/ বলতে পারো এই অসময় কোথায় রাখবো তোমায়।’
অনুভব করা যাচ্ছে স্বগতোক্তির মতো সব উচ্চারণ। একটু নিচু স্বরে। কখনও কখনও বেশ আটপৌরে। যেন মায়া লেগে আছে অক্ষরে অক্ষরে। মুহূর্তেই পাওয়া যায় কবির ব্যাকুল মনের সন্ধান। কবিতাটির বাকি অংশের কোথাও ঔজ্জ্বল্য নেই। বয়ে গেছে নীরব স্রোত। এমন কবিতার পাঠ সত্যিই মনের মধ্যে তুমুল আনন্দের সঞ্চার করে।
‘কস্তুরী’, ‘অদৃশ্য’, ‘রেণু’, ‘ঠিকানাবিহীন’, ‘প্রত্যয়’-এর মতো কবিতাগুলি তো বটেই দিশা চট্টোপাধ্যায়ের ‘নিছক বৃষ্টিকথা’র অন্য কবিতাগুলিও মন ছুঁয়ে যায়। প্রচ্ছদশিল্পী গোবিন্দ বেহেরা।