শিবের মহিমা
অমর নামকরা গবেষক। অমরের গবেষণার বিষয় সাপের বিষ নিয়ে। সেটা কঠিন কাজ। সেই কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের সাধারণ মেয়ে সুধার সঙ্গে তাঁর প্রেমের সূত্রপাত। অমরের মায়ের স্বীকৃতি থাকায় এদের বিয়ে হয় ধুমধাম সহকারে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই অমরের বাড়িতে গুরুদেব নববধূকে আশীর্বাদ করতে এসে সুধার কপালে সিঁদুরের মধ্যে এক অশনি সংকেত যেন দেখতে পেলেন। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা গুরুদেব অমরের মাকে জানালেন যে সুধার অকালবৈধব্যযোগ আছে। এ-কথা দরজার আড়াল থেকে সুধা শুনতে পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। যে শিবার্চনা না করে সুধা কোনও কাজ করেন না, সেই শিবের পুজারি হয়ে তার জীবনে কেন নেমে আসবে অন্ধকার। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন সুধা। এদিকে সাপ দংশন করেছে অমরকে। বাঁচার কোনও সম্ভাবনা নেই। এ খবর পেয়ে সুধা বাঁক কাঁধে ছুটলেন শিবের মাথায় জল ঢালতে। আজ যে শিবেরও পরীক্ষা— ‘আজ তোমার পরীক্ষা ভগবান তুমি পাথর নাকি প্রাণ’। স্বর্গে শিবের আসন টলে উঠল। পার্বতীর অনুরোধে শিবের নির্দেশমতো সাপ নিজেই বিষ তুলে নিল অমরের দংশনের জায়গা থেকে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এমন বিষয় নিয়ে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেল ‘বাবা তারকনাথ’ ছবিটি। বাম্পারহিট ছবি। পরিচালক অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তিনি বাংলা ছবির অত্যন্ত জনপ্রিয় সম্পাদকও বটে। সন্ধ্যা রায় সুধা, বিশ্বজিৎ অমর। গল্পের জন্য তো বটেই এমনকী ছবির প্রত্যেকটি গানের টানে দর্শকেরা বারে বারে ছুটেছেন প্রেক্ষাগৃহে। ছবির সুরকার নীতা সেন। এই ছবিটি তাঁকে পৌঁছে দিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গানগুলি হল যথাক্রমে : ‘তুমি সূর্য তুমি চন্দ্র’ (আশা, চিত্তপ্রিয়), ‘বাঁক কাঁধে চল রে’ (দ্বিজেন), ‘তোমার চন্দ্র সূর্য ওই দুটি চোখ’ (আরতি), ‘তিনি একটি বেলপাতাতেই তুষ্ট’ (মান্না দে), ‘শিবশম্ভু ত্রিপুরারী’ (মান্না দে), ‘পঞ্চ প্রদীপে ধূপে’ (আরতি, বনশ্রী), ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো’ (আরতি), ‘বোবা বলে দুঃখ কেন’ (আশা) প্রভৃতি। রেকর্ডগুলির রেকর্ড বিক্রি, সেই সময় থেকে শ্রাবণ মাসে বাঁক কাঁধে তারকেশ্বরে যাওয়ার ধুম পড়ে যায়।
নীতা সেনের ব্যাপ্তি
শুধু ‘বাবা তারকনাথ’ ছবি নয়, নীতা সেনের সুরারোপিত ছবির তালিকায় রয়েছে কৃষ্ণ সুদামা, নন্দন, গোলাপ বউ, সীতা, পাহাড়ি ফুল, সতী সাবিত্রী সত্যবান, সোনার বাংলা, সীমান্তরাগ, অভিষেক, কলঙ্ক, জঙ্গল পাহাড়ী, বাবা লোকনাথ প্রভৃতি ছবি। তাঁর সুরে বিভিন্ন ছবিতে গান গেয়েছেন মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আশা ভোসলে, মহেন্দ্র কাপুর, ভূপেন্দ্র সিং, সুমন কল্যাণপুর, আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, সুবীর সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, অরুন্ধতী হোমচৌধুরী, সুধীন সরকার।
নীতা সেন ‘কৃষ্ণসুদামা’ ছবিতে সুমন কল্যাণপুরকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘তোরা হাত ধর প্রতিজ্ঞা কর’, ভূপিন্দর সিংকে দিয়ে ‘কৃষ্ণ মেঘ দাও বৃষ্টি দাও’ মহেন্দ্র কাপুরকে দিয়ে ‘সবকিছু ফেলে’, আশা ভোসলেকে দিয়ে ‘আয় তুই ফিরে আয়’। আরতি মুখোপাধ্যায় ও ঊষা মঙ্গেশকার দ্বৈত কন্ঠে গাইলেন ‘ফাগুয়ায় কে কুমারী’ ইত্যাদি মিঠুন চক্রবর্তী ও সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘পাহাড়ি ফুল’ ছবিতে মান্না দে-র গানগুলি মিঠুন চক্রবর্তী লিপ দিয়েছিলেন। সেই গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ছুম ছুম ছুম’, ‘যদি কেউ দুহাত দিয়ে’, ‘গানের স্বরলিপি লেখা’ প্রভৃতি। এছাড়া মান্না দে ও অরুন্ধতী হোম চৌধুরী দ্বৈত কণ্ঠে গাইলেন ‘আমাকে ভালবাসো’, আরতি মুখোপাধ্যায় গাইলেন ‘কী ভুল আমি করলাম’ অথবা ‘ঝরনা আছে পাহাড় আছে’। ‘সোনার বাংলা’ ছবির গানগুলি আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। এই ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈত কন্ঠের গান ‘এই যে বাংলা’। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও সুধীন সরকার দ্বৈত কণ্ঠে গাইলেন ‘একদিন ছিল যে ভারতে’ এমন নানান বৈচিত্র্যে ভরা এই গানগুলির সুরকার ছিলেন নীতা সেন।
অরুন্ধতী দেবী
বহু গুণে গুণান্বিতা শিল্পী অরুন্ধতী দেবী। তিনি স্বনামধন্য নায়িকা। বেশ কয়েকটি ছবি পরিচালনা করেছেন। যে ছবিগুলির চিত্রনাট্য তিনিই রচনা করেছেন। পাশাপাশি নিজের ছবিগুলির (ছুটি, মেঘ ও রৌদ্র, পদীপিসীর বর্মীবাক্স, দীপার প্রেম) সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব সামলেছেন। সুরকার হিসেবে তাঁর শুরু পীযূষ বসু পরিচালিত ‘শিউলিবাড়ি’ ছবিতে। সুরকার হিসেবে তাঁর বৈশিষ্ট্য হল তিনি গানের মধ্য দিয়ে নানান বৈচিত্র এনেছেন। যেমন ‘ছুটি’ ছবিতে তিনি একসময়ের ব্যতিক্রমী দুটি গানকে ব্যবহার করেছেন। কণ্ঠ দিয়েছেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। গান দুটি হল ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’, ‘জীবন নদীর ওপারে’। রবীন্দ্র সংগীত ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ ব্যবহার করলেন ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ছবিতে। গাইলেন মান্না দে।
বাঁশরী লাহিড়ী
বাঁশরী লাহিড়ীর পুত্র বাপি লাহিড়ী। স্বামী অপরেশ লাহিড়ী। এঁদের মাঝে পড়ে বাঁশরী লাহিড়ী প্রায় হারিয়ে গেছেন। তবু তিনি একটি বাংলা ছবিতে সুর দিয়েছেন ‘দিল্লি থেকে কলকাতা’ (১৯৬১)। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় স্বামী-স্ত্রী মিলেই এই ছবিতে গানগুলি গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- প্রায় ৭২% ভোট, হারের ভয়ে মেজাজ হারালেন ট্রেনি সভাপতি
ঊষা খান্না
বোম্বের জনপ্রিয় সুরকার ঊষা খান্না বাংলা ছবিতে সুর সংযোজনা করেছেন। তাঁর সুর করা ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে বিশ্বজিৎ পরিচালিত অবিচার (১৯৮১), অনুরাগ (১৯৯০), বেপরোয়া (১৯৯৫)। ‘অনুরাগ’ ছবিতে বোম্বের সব শিল্পীরা গেয়েছেন। তার মধ্যে একটি গান ঊষা খান্না নিজেও গেয়েছেন।
অসীমা ভট্টাচার্য
অসীমা ভট্টাচার্য নামকরা গায়িকা তো বটেই পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছবিতে সুর দিয়েছেন। এছাড়াও যেহেতু তিনি আকাশবাণী কলকাতার বড় পদে আসীন ছিলেন, তাই বেশ কিছু অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল তাঁর তত্ত্বাবধানে। তেমনই এক বিতর্কিত অনুষ্ঠান হল মহালয়াকে কেন্দ্র করে ‘দুর্গা দুর্গতিহারিনিম’। ছবিতে তিনি প্রথম সুর দিলেন ‘চৌরঙ্গী’তে (১৯৬৮)। সেখানে তাঁর সুরে দুটি স্মরণীয় গান ‘বড় একা লাগে এই আঁধারে’ (মান্না দে), ‘কাছে রবে কাছে রবে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)। এছাড়াও তিনি সুর দিয়েছেন আজকের নায়ক, মেমসাহেব, ফুলশয্যা, শুভ রজনী, তনয়া প্রভৃতি ছবিতে।
বিজন ঘোষ দস্তিদার
নাম শুনলে মনে হবে পুরুষ। কিন্তু এই নামের সুরকার মহিলা। টাইটেল কার্ডে যার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে শ্রীমতী বিজন ঘোষদস্তিদার। তিনি প্রথম সুর দিলেন ‘কৃত্তিবাস’ ছবিতে (১৯৭০)। প্রচুর বাঙালি শিল্পীদের নিয়ে তিনি গানের ডালি সাজিয়েছিলেন। তাঁর শেষ ছবি ‘যুগমান কবীর’ (১৯৭৬)।
গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
বেসিক রেকর্ডে (ননফিল্ম) সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব সুরে বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন। যার প্রতিটির গীতিকার তাঁর স্বামী শ্যামল গুপ্ত। এই তালিকায় আছে ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে’, ‘ঝরা পাতা ঝড়কে ডাকে’ প্রভৃতি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অগ্রদূত গোষ্ঠীর প্রধান বিভূতি লাহার সম্পর্ক সেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির সময় থেকে। সুচিত্রা-সন্ধ্যার যুগলবন্দির শুরু ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ থেকে। সেই সুবাদে বিভূতি লাহা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ছবিতেও সুর সংযোজনা করার জন্য। সন্ধ্যা অবশ্য তাতে সম্মত হননি। এ-কথা ঠিকই তিনি পুজোর সময় যেসব বেসিক গানের রেকর্ড বের করেছেন, তাতে তিনি নিজের গান নিজের সুরে গেয়েছেন। সেখানেই পেয়েছেন পরিতৃপ্তি।