আঁকাবাঁকা পথটি চলে গিয়েছে কালিন্দী নদীর ধার পর্যন্ত। নয়ানজুলির ধারে অসংখ্য খেজুর গাছের সারি। তাতে হাঁড়ি বাঁধা। চেঁছে দেওয়া হলুদ-রঙা জায়গা থেকে রস ঝরছে। গাছের পাতায় ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসা দোল খেয়ে চলেছে অবিরত। এ-আমার ছোটবেলার হেমন্তকাল। সকালে উঠেই মাথা ঢাকা দিতে হবে। একটু সন্ধে হলেই খেলার মাঠ ছেড়ে ঘরে ফিরে আসা, নইলে মাথায় হিম লাগবে। চাঁদ যেন কাচের ঘরে বন্দি হয়ে তাকিয়ে আছে মিটিমিটি। ঘরের পাশে ফোটা মল্লিকা ফুলের মিঠে গন্ধ। ছোটবেলার এই স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে উঠলেই মনে হয় হেমন্তের দিন এল।
আরও পড়ুন-কবিতায় হেমন্ত
রাতের আঁধার কাটলেও ভোরের আলো ফোটেনি। শরতের সোনারোদকে বিদায় দিয়ে ঋতুচক্র এসে দাঁড়িয়েছে হেমন্তের সম্মুখে। একটু শীত শীত, একটু ঘাম। সূর্যাস্তের আগেই আকাশ থেকে যেন হালকা মেঘের স্তর নেমে আসে। শরৎ আর শীতের মধ্যিখানে গুটি-শুটি দিয়ে বসে থাকা এই হেমন্ত। আকাশে জ্বলছে আকাশ প্রদীপ। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে আলো জ্বেলে পিতৃলোকবাসীদের পথ উজ্জ্বল করেছে মানুষ। ধীরে ধীরে সেই প্রদীপের আলো কুয়াশায় মায়াময় হয়ে ওঠে। বিস্তীর্ণ মাঠের শেষপ্রান্ত কুয়াশায় ঢাকা। যেন কোন অদৃশ্য জাদুকর আকাশের বুক থেকে নামিয়ে দিয়েছে এক সুন্দর সাদা ওড়না। শীত আসছে। আগাম শীতের হাওয়া গা স্পর্শ করে তার আগমনবার্তা দিয়ে যাচ্ছে। শরতের আলোর সেই তেজ আর নেই। চারিদিকে এক অজানা নিঃস্তব্ধতার মধ্যে জেগে আছে ছাতিমের গন্ধ।
আরও পড়ুন-বহুমাত্রিক লেখনীর স্রষ্টা ছিলেন উপেক্ষিত কথাসাহিত্যিক আবদুল জব্বার
হেমন্তের দিন ক্রমশ ছোট হচ্ছে। দীর্ঘ রাতের শেষে সুন্দর ভোর। ঘাসের ডগায় স্বচ্ছ শিশিরবিন্দু। দেবতাদের আশীর্বাদ যেন। আধোছায়া মাঠ ভেঙে খেজুর গাছের রস আহরণকারী চলেছে রস আনতে। সমস্ত রাত টুপটুপ করে রসের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছে। ওই কাঁটা ভরা গাছের মধ্যে এত সুধা জমে ছিল! সেই সুধা আহরণ করে জ্বাল দিয়ে তৈরি হবে গুড়। সেই অমৃতও হেমন্তের দান। এই আধোবোজা আধোজাগা হেমন্তের প্রকৃতি দেখে কবি লিখেছিলেন—
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো দীপালিকায় জ্বালাও আলো
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোর ধরিত্রীরে।
ঋতুচক্রের চতুর্থ ঋতু হল হেমন্ত। তার ঠিক আগের ঋতু শরৎ আমাদের উৎসবের ঋতু। কিন্তু হেমন্ত সেই শরৎ ঋতু থেকে কিছু উৎসব নিজের করে নিয়েছে। দুর্গাপুজো শেষ হলেই গুটিগুটি পায়ে হেমন্তের প্রবেশ। কালীপুজোর দু’দিন পরেই ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা। স্বর্গে যমরাজ তাঁর বোন যমুনার কাছে ফোঁটা গ্রহণ করেন। সেই ফোঁটাই মর্ত্যের বোন ভাইয়ের কপালে এঁকে দেন, তার দীর্ঘায়ু কামনা করে। সকাল থেকে সেই ফোঁটা দেওয়ার আয়োজন চলতে থাকে। কপালে ফোঁটা দেওয়ার প্রধান উপকরণ চন্দন। আর এইদিন চন্দন বাটতে হবে শিশির দিয়ে। সেদিন গঙ্গা জলের থেকেও পবিত্র হল শিশির। তাই মেয়ের দল ভোর হতেই পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো নিয়ে ঘাসের ডগায় ছড়িয়ে দেয়, তারপর সিক্ত কাপড় থেকে জল চিপে নিলেই হল। আগের দিন রাতে গাছের উপর কাপড় ভিজিয়ে রাখলে সেই শিশিরে সিক্ত কাপড় থেকে অনায়াসে জল বের করে নিয়ে চন্দনবাটা যায়। যে পরিবারে ভাইফোঁটা মহা-উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়, হেমন্তের শিশিরের মূল্য তারা জানে। তবে স্বর্গেও কি শিশির পড়ে স্বচ্ছ্ব হীরকবিন্দুর মতো? ছেয়ে যায় আকাশগঙ্গার চারপাশে, কল্পবৃক্ষের গায়ে? নইলে বোন যমুনা কী দিয়ে চুয়া-চন্দনের ডালি সাজান! সেখানেও কি ঝিমধরানো হেমন্তের বাতাস উৎসবের মরশুম তৈরি করে? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। স্বর্গের একঘেয়ে ভোগের জীবনে ঋতুবৈচিত্র নেই। নেই মর্ত্যের সুবাস। তাই দেবগণ মর্ত্যবাসীর পূজা গ্রহণের প্রত্যাশী।
আরও পড়ুন-জনসমুদ্রে অবরুদ্ধ রামনগর, বিরোধী দলনেতাকে চ্যালেঞ্জ বীরবাহার
হেমন্তকাল এক আশ্চর্য সময়। কৃত্তিকা আর আদ্রা— এই দুই নক্ষত্র থেকে এই দুই মাসের নাম করণ। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ। কার্তিক মাসে শিবপুত্র কার্তিকের পুজো হয়। শ্রীমদ্ভগবত গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, ‘‘এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা-ই আমি। যেমন মাসের মধ্যে মার্গশীর্ষ।’’ অগ্রহায়ণ মাসের আরেক নাম মার্গশীর্ষ। অগ্রহায়ণ হল সূর্যের গতিপথে প্রথম বা অগ্রে যাত্রা। সূর্যের গতিপথে এই সময় আসে পরিবর্তন। পণ্ডিতদের মতে বহুকাল আগে ঋতুচক্রের গমনে এই মাসই ছিল সর্ব অগ্রে। অগ্রহায়ণ মাসেই পালিত হত নববর্ষ। কৃষিভিত্তিক সমাজে ফলন্ত, পরিপুষ্ট ফসলখেত থেকে গৃহে নিয়ে আসা একটি সামাজিক উৎসব। বর্ষাকালে আউশ ও আমন ধান রোপণ করা হত, সেই সবুজ ধান পরিপুষ্ট হয়ে সোনালি রং ধারণ করে হেমন্তের হিমে। দিগন্তবিস্তৃত সোনার খেত দেখে আনন্দিত কৃষক। গৃহে গৃহে উৎসব চলে, গোলা ভরা ধান সমৃদ্ধির লক্ষণ। শস্য ফলাতে যে পরিশ্রমের প্রয়োজন তার থেকে ক্ষণিকের বিরাম। বিশ্বকবি তাঁর নিপুণ কলমে এঁকে দিয়েছেন হেমন্তকালের এই শূন্য মাঠের ছবি, নৈবেদ্য কবিতায় তিনি বলছেন—
আরও পড়ুন-গো ব্যাক? মন্ত্রী সুভাষের লাথি দলীয় কর্মীকেই!
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
হেমন্তকালেও আমরা দেবী আরাধনা করার সুযোগ পাই। দেবী দুর্গার পর আসেন দেবী জগদ্ধাত্রী। পায়ের উপর পা তুলে দেবী জগৎকে ধারণ করেন। এই উৎসব সম্পর্কে এক ছোট্ট কাহিনির কথা মনে পড়ে যায়। বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি গ্রাম। সেখানে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শ্যামাসুন্দরী দেবীর খুব ইচ্ছা গ্রাম্য কালীপুজোয় কিছু চাল নিবেদন করবেন। নতুন ধান থেকে নিজ হাতে চাল তৈরি করলেন তিনি। কিন্তু গ্রাম্যবিবাদ বড় কূটগামী। প্রতিবেশীর চেষ্টায় সেই চাল পুজোর জন্য গ্রহণ করা হল না। শ্যামাসুন্দরী কেঁদে কেঁদে দেবীকে জানালেন, ‘‘তোমার জন্য চাল করলুম, এখন এ চাল কে খাবে?’’ রাতে এক দেবী স্বপ্ন দিয়ে তাঁকে বললেন, ‘‘কালীর চাল আমি খাব।’’ দেবীর চেহারা দেখে দেবীরূপ ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না শ্যামাসুন্দরী, কন্যা সারদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘হ্যাঁ মা, পায়ের উপর পা দেওয়া কোন দেবী?’ কন্যা উত্তরে দেবী জগদ্ধাত্রীর কথা বললেন। সেই থেকে মুখোপাধ্যায় পরিবারে শুরু হল জগদ্ধাত্রীপুজো। এই দেবীপুজো আজও চলছে। কারণ, শ্যামাসুন্দরীর কন্যা সারদা যে বিশ্ববন্দিতা মা সারদা।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
হেমন্তের উৎসব বলতেই যেটির কথা মনে আসে তা হল নবান্ন। নব অন্ন থেকে এই শব্দের সৃষ্টি। নবান্নের সঙ্গে এমন সব আচার জড়িয়ে আছে যাতে বহুকাল আগে এই সময়ে যে নববর্ষ পালিত হত তা বিশেষভাবে বুঝতে পারা যায়। এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালিত হয় ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে। পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় নবান্নের প্রেক্ষাপট অপূর্বভাবে উপস্থাপিত, তাঁর নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের ‘সুখের বাসর’ কবিতায় যেন সেই মাঠের গন্ধই ভেসে আসে—
‘আশ্বিন গেল কার্ত্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কল্মি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’
আরও পড়ুন-কুচিপুড়ি নৃত্যে মাতিয়ে দিল ঋষি-কন্যা অনুষ্কা
হেমন্ত যেন কল্যাণময়ী লক্ষ্মী, যদিও তাঁর প্রকৃতি বিষাদে মাখা। তারই মধ্যে নতুন চালের গন্ধ ভেসে আসে। বিশাল গাঙ্গেয় উপত্যকায় বৈদিক কাল থেকে এই নবান্ন উৎসব পালিত হছে। এই উৎসবের মূল কথা হল, যে নতুন অন্ন খেত থেকে উঠে এল তা দেবতাকে নিবেদন করে সমবেতভাবে গ্রহণ করা। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এই নবান্ন উৎসবের সূচনা করেছিলেন। লাঙলকে ফুল দিয়ে সাজানো হল। তার সম্মুখে বরণডালায় আরতি হল। তারপর একটু খেত-কর্ষণ করা হল, এ হল ক্ষেত্রপুজো। হেমন্ত কেবল এই ফসল সংগ্রহের ক্ষণ নয়, শীতকালীন রবিশস্য রোপণ করার কালও এই হেমন্ত। ঘরে ধান থেকে চাল তৈরির প্রধান উপকরণ ছিল ঢেঁকি, তাই গ্রামবাঙলায় যে-ক’টি ঘরে ঢেঁকি অবশিষ্ট আছে তাকে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করে পুজো করা হয়। গায়ে দেওয়া হয় সিঁদুরের মাঙ্গলিক চিহ্ন। এই ঢেঁকিপুজোকে গ্রামবাংলায় বলে ‘গুঁড়ির হাত’। সেই সদ্য-পুজো-করা ঢেঁকিতে নতুন চাল কোটা হয়। সেই নতুন চাল বেটে তাতে নারকেলের কুরো দিয়ে নতুন চালের তৈরি চিঁড়ে-খই মেখে অনবদ্য এক নবান্ন তৈরি করা হয় এবং তা সমবেতভাবে পরিবেশিত হয়। ঘরে সেদিন গৃহলক্ষ্মীরূপে নতুন ধান ছোট স্তূপাকৃতিতে সাজানো হয়, তার চারদিকে সিঁদুর মাখানো কড়ি রাখা হয়। প্রাচীনকালে কড়িই ছিল আদান-প্রদান ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম। সেই প্রাচীন অর্থকে এখনও লক্ষ্মীর সঙ্গে পুজো করে মানুষ। লক্ষ্মীর হাঁড়িতে এখনও কড়ি রাখার প্রচলন আছে। নবান্নের দিন সেই কড়ি দিয়ে সাজানো নতুন ধানই হয় দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক। সেদিন তাকেই পুজো করা হয়। তারপর আসে পিঠেপুলির দিন। নতুন খই দিয়ে জয়নগরের মোয়ায় বাজার ছেয়ে যায়।
আরও পড়ুন-মা
হেমন্তের আঙিনায় বাংলার নারী আরেকটি ব্রত পালন করে, সেই ব্রত হল ‘তুষ-তুষলী’ ব্রত। এই ব্রতের একটি নিজস্ব আলপনা আছে। সেই আলপনার চারধারে ব্রতপালনের নানা উপকরণ থাকে, সম্মুখে থাকে একটি কলসি তার মধ্যে এক আম্রপল্লব গোঁজা। ব্রত-শেষে সেই আম্রপল্লবের জল সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ সেই জল শান্তিজল— যা গৃহের মঙ্গল করে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় এই সময় একটি জনপ্রিয় পরব আয়োজিত হয়। এটি হল ‘টুসু পরব’। টুসু নামে এক রাজকুমারীর উদ্দেশ্যে লেখা গান ‘টুসু গান’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশে নবান্ন নিয়ে খুব বড় উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই উৎসব পরিচালনার জন্য নবান্ন পরিষদ গঠিত হয়েছে। সব নিয়ে হেমন্ত আমাদের জীবনে এক উৎসবের আবেশ নিয়ে আসে। হেমন্ত যেমন বিষাদ বহন করে, তেমনই আবার আনন্দপূর্ণ সম্মিলনের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। যা একান্ত গৃহকেন্দ্রিক হয়েও মূলে নিহিত থাকে সকলের জন্য শুভকামনা। হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ তাই লিখেছেন—
‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি— বিকেলের এই রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালু-মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি— হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনও কথা।’