কোভিডের হাতছানি পেরিয়ে শেষপর্যন্ত নজরুল মঞ্চে উদ্বোধন হয়েছে এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। প্রত্যেক বারের মতোই এবারও তারকাদের মেলা বসেছিল এই চলচ্চিত্র উৎসবে। উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও জুন মালিয়া। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শত্রুঘ্ন সিনহা, ইন্দ্রনীল সেন, সন্দীপ রায়, গৌতম ঘোষ, হরনাথ চক্রবর্তী, নুসরত জাহান, দেব, পাওলি দাম, রাজ চক্রবর্তী, কৌশানী মুখোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ-সহ আরও অনেকে।
চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত শিল্পী, যাঁরা গত বছরে প্রয়াত হয়েছেন, তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দিলীপ কুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, বাপ্পি লাহিড়ী, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’।
আরও পড়ুন-রায়চৌধুরী পরিবারের এক মুক্তমনা নারী
এ-বছরের চলচ্চিত্র উৎসবে ৪০টি দেশের ১৬৩টি ছবি দেখানো হয়েছে। এবারের উৎসবের কেন্দ্রীয় দেশ হিসেবে ছিল ফিনল্যান্ড। তাদের মোট ৭টি ছবি দেখানো হয়েছে। ৭ দিন ধরে কলকাতার ১০টি প্রেক্ষাগৃহে এই উৎসব চলেছে।
এবারের উৎসব সর্বার্থেই ছিল সত্যজিৎময়! শুরুতেই গুপি-বাঘার সাজে মঞ্চে হাজির হয়ে অনুষ্ঠানের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন সাহেব চট্টোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ বসু। এবারের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সাংসদ তথা অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। উদ্বোধনী মঞ্চে এবার বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। যেমন লালমাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সায়ন্তিকার নাচ। এ-ছাড়া অদিতি মুন্সির সুরেলা কণ্ঠে কৃষ্ণনাম জপ করলেন কৌশানী। নাচের তালে শুভশ্রী বলেন, এই পৃথিবীর একই মাটি, একই আকাশ-বাতাস। ছৌ-নৃত্য থেকে বাউল গান— সবটাই ফুটে উঠল দেবলীনা কুমার, মনামি, দিতিপ্রিয়ার পারফরম্যান্সে। গোটা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও বিধায়ক অভিনেত্রী জুন মালিয়া। ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তথ্যচিত্র বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত শেষ তথ্যচিত্র ‘আমি সৌমিত্র’। ‘সিনেক্স’ এবং ‘মুখোমুখি’ প্রযোজিত এই তথ্যচিত্রে দেখা গেল সব্যসাচী চক্রবর্তী, সন্দীপ রায়, দেবশঙ্কর হালদার, যোগেন চৌধুরি, কৌশিক সেন এবং সৌমিত্রকন্যা পৌলমী বসু-সহ আরও অনেককে। ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর পৌলমী বসু নিজেই। পরিচালক সায়ন্তনের এই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে কিংবদন্তি অভিনেতার সিনেমা, থিয়েটার এবং ছবি আঁকার নানা দিক। আছে তাঁর দরাজকণ্ঠে কবিতাপাঠও।
আরও পড়ুন-বাংলা ভাঙার পুরনো ছক
মঞ্চ, সিনেমা, সিরিয়াল, ওয়েবসিরিজ৷ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সব জায়গায় তাঁর রাজত্ব ছিল অটুট। এহেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া আজও মেনে নিতে নারাজ আপামর বাঙালি। বাঙালির এক চিরন্তন আবেগের নাম উত্তমকুমার হলে আরেক আবেগের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই আবেগকেই ফের উসকে দিল ‘আমি সৌমিত্র’।
কথাতেই বলে, শিল্পীর মৃত্যু হয়, শিল্পের নয়। আর তাই তো আজও বাঙালি তথা বাংলার মনে তিনি রয়ে গিয়েছেন। বাঙালির আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-উচ্চমাধ্যমিক-পরবর্তী পর্যায়ে জীবনের দিক-নির্দেশনা
পরিচালক সায়ন্তন মুখোপাধ্যায় যা বললেন তা তাঁর নিজের মুখ থেকেই বরং শুনুন। বললেন, ‘‘করোনা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফিরেছিলেন শুটিং ফ্লোরে। হাতে থাকা একের পর এক ছবির শুটিং ও ডাবিং শেষ করছিলেন তিনি। যার মধ্যে ছিল এই ডকু-ফিচার। দীর্ঘ এই তথ্যচিত্রের শেষ শুটিং করেছিলেন ৩০ সেপ্টেম্বর। এই তথ্যচিত্রে শুধু অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নন, কবি, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, চিত্রকর সৌমিত্রকেও দর্শক আরও কাছ থেকে জানতে পারবেন।”
এই তথ্যচিত্র একটু আলাদাভাবে তৈরি করেছেন পরিচালক। দীর্ঘক্ষণের আড্ডা ক্যামেরাবন্দি করেছেন তিনি। যে আড্ডায় আছেন পরিচালক সন্দীপ রায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, দেবশংকর হালদার-সহ আরও অনেকেই। অভিনয় জীবনের দীর্ঘ চলার পথে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নানা কাজ নিয়ে আলোচনা, কবিতাপাঠ, নাটক নিয়ে কথা বলতে দেখা গিয়েছে সবাইকে।
আরও পড়ুন-শিক্ষাবিদদের মতামত নিয়ে হবে নয়া সিলেবাস
এই তথ্যচিত্রের সঙ্গে যিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি সৌমিত্রকন্যা পৌলমী বসু। তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছিল বাপির তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, তাই ওঁর চিন্তাভাবনা ও দর্শন আমাদের ধরে রাখা উচিত। এখানে একেবারে আড্ডার মাধ্যমে বাপির সিনেমা, থিয়েটার, ছবি আঁকার দিক উঠে এসেছে। কিন্তু বাপির দুটো সাহিত্য আর ব্যক্তিগতজীবনে হাত দেওয়ার আগেই বাপি করোনায় আক্রান্ত হন। তাই ওই দিকটা তুলে ধরা যায়নি। সহজ কথায়, আড্ডার মাধ্যমে বাপির জীবনদর্শন তুলে ধরা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। বাপি নিজেই বলেছেন নিজেকে নিয়ে অনেক কথা।
দু’ ঘণ্টা ঊনচল্লিশ মিনিটের এই ডকু-ফিচারটিতে মূলত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আপাত-অপরিচিত দিকগুলির ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছে। বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটির ভাবনা, জীবনদর্শন, আদর্শ, রাজনৈতিক চেতনা— যা বলে যেতে তিনি নিজেই উন্মুখ ছিলেন শেষ দিকে। তাঁর লেখালিখি, কবিতা, ছবি আঁকা— এ-সব ছিল নিজস্ব অবসরের একান্ত যাপন। সেগুলোয় আলোকপাত করা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। ‘আমি সৌমিত্র’তে শিল্পীর অনেক না-বলা কথা আমাদের মনে পৌঁছে দিয়েছে।
এরই পাশাপাশি, পরিচালক অভিনেত্রী অপর্ণা সেনের ‘দ্য রেপিস্ট’ সবার মনে বাড়তি জায়গা করে নিয়েছিল। কেন? একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে।
আরও পড়ুন-‘সুস্বাদু’ পাওভাজিতে মজেছেন কামিন্স
পর্দায় একসঙ্গে বরাবরই ম্যাজিক দেখিয়েছেন মা-মেয়ের জুটি অপর্ণা সেন ও কঙ্কণা সেনশর্মা। এবারও তার অন্যথা হয়নি। ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের শেষদিনে নন্দনে প্রদর্শিত হয়েছে পরিচালক অপর্ণা সেনের ছবি ‘দ্য রেপিস্ট’। ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন কঙ্কণা সেনশর্মা, অর্জুন রামপাল, তন্ময় ধানানিয়া। কিম জিসেওক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে ‘দ্য রেপিস্ট’।
‘দ্য রেপিস্ট’ পরিচালকের তৃতীয় হিন্দি ছবি। এর আগে মা-মেয়ে অভিনীত ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’ ছবিটি সম্মানিত হয়েছিল জাতীয় পুরস্কারে। ‘দ্য রেপিস্ট’ ছবির ঘটনা তিন প্রধান চরিত্রকে নিয়ে। এক ভয়ঙ্কর ঘটনার মাধ্যমে তাঁদের একে অপরের জীবন জড়িয়ে যায় ছবিতে। অপরাধ হলে ভিক্টিম যেমন ট্রমার মধ্যে নিয়ে যায়, তেমনই অপরাধীর মনের মধ্যে কী চলে ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন পরিচালক।
ছবির গল্প শুধুমাত্র এক অপরাধী বা ধর্ষিতাকে নিয়ে নয়। বরং সেই অপরাধের ফলে চরিত্রগুলোর আদর্শ যেভাবে আচমকা বদলে যায়, সেই নিয়েই গল্প। ছবিতে অর্জুনের বিপরীতে আছেন কঙ্কণা সেনশর্মা।
২৭তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে আটটি বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সিনেমা দেখানো হয়েছে। ভাষাগুলো হল— বোরো, টুলু, রাজবংশী, সান্তাড়, কোঙ্কণি ও কুড়ুম্বা।
আরও পড়ুন-‘সুস্বাদু’ পাওভাজিতে মজেছেন কামিন্স
চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, দিলীপ কুমার, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও নিকোলাস জাঙ্কসোকে নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ছিল।
এ-বছর শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া হয় সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও হাঙ্গেরিয়ান ফিল্মমেকার মিকলোস ইয়াঞ্চকে। সত্যজিৎ রায়ের তৈরি ছবি ও তাঁকে নিয়ে তৈরি ছবিও প্রদর্শিত হয়েছে চলচ্চিত্র উৎসবে। সেই তালিকায় রয়েছে পথের পাঁচালী, পরশ পাথর, নায়ক, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি, হীরক রাজার দেশে, সোনার কেল্লা, শ্যাম বেনেগালের তৈরি সত্যজিৎ রায় নামে ডকুমেন্টারি-সহ বেশ কয়েকটি ছবি। প্রদর্শিত হয়েছে চিদানন্দ দাশগুপ্তের ছবি পোর্টেট অফ দ্য সিটি ও আমোদিনী। এ-ছাড়াও রয়েছে মিকলোস ইয়াঞ্চর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি ‘ইলেক্ট্রা মাই লাভ’। এ-বছর সত্যজিৎ রায় মেমোরিয়াল লেকচার পরিবেশন করেন পরিচালক সুজিত সরকার।
ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে রবিবার শেষ হয়েছে ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-২০২২। ২৫ এপ্রিল শুরু হয়েছিল এই সিনেপার্বণ। অন্তিম পর্বে রবীন্দ্রসদনে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল সেন, গৌতম ঘোষ প্রমুখ বিশিষ্টরা।
আরও পড়ুন-১৩০ মিটারের ছক্কা মারতে চান পাওয়েল
কোভিডের কথা মাথায় রেখে সমস্ত রকমের সামাজিক বিধি মেনেই হয়েছে এবারের চলচ্চিত্র উৎসব। শুরুতেই দেখানো হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। ১০টি জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে মোট ১৬০টি সিনেমা। দেখানো হয়েছে ৬২টি বাংলা সিনেমা। সিনেমাগুলি দেখানো হয়েছে নন্দন ১, ২, ৩, নজরুলতীর্থ ১, ২, রবীন্দ্রসদন, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবন, কনফারেন্স হল, কলকাতা ইনফর্মেশন সেন্টার ও শিশির মঞ্চে।