২০২৩ সালে প্রতীচী ট্রাস্ট নামক এক গবেষণা সংস্থা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রভাব নিয়ে সারা বাংলা জুড়ে ১৫০০ জন মহিলার উপর সমীক্ষা চালায়। সেই সমীক্ষা থেকে উঠে আসে যে ৫৬.২১ শতাংশ মহিলা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের জন্য আবেদন করেছিল তাদের পারিবারিক প্রয়োজনীয়তার জন্য সেখানে সাংসারিক দারিদ্র্য যেরকম আছে, ঠিক একই ভাবে রয়েছে পরিবারের প্রয়োজনীয় ওষুধ জোগানোর ও ঋণ শোধ করার তাগিদ। এখান থেকে সহজেই অনুমেয় যে পরিবারের মধ্যে নারীর যে গুরুত্ব তা অতি আবশ্যিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পরিবারের তার প্রতি নির্ভরতা থেকে।
আরও পড়ুন-সাত দফার চক্রান্ত জবাব দেবে বাংলা
গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হল ৮৫.৫৫ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা কীভাবে খরচ করেন তা সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করে ১০.৭৬ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁরা এই খরচের সিদ্ধান্ত তাঁদের স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে গ্রহণ করেন এবং মাত্র ২.৬৯ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন এই সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণই তাঁদের স্বামীর হাতে ন্যস্ত থাকে। সহজেই আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে এই প্রকল্প প্রত্যক্ষভাবে নারীর স্বাধিকারকে বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করে দিচ্ছে। ৬১.০৭ শতাংশ মহিলা সরাসরি জানিয়েছেন এই প্রকল্পের ফলে পরিবারে তাঁদের মর্যাদা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। মহিলারা জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক তাদের মাসিক এই অর্থ প্রদান তাদের মধ্যে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা বোধকে অনেক অংশে কমিয়েছে এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বোধকে জাগ্রত করেছে। এই আত্মবিশ্বাস কর্মরত মহিলাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অধিক পরিমাণে জাগ্রত হয়েছে গৃহিণী মহিলাদের মধ্যে। শত শত উদাহরণ মেলে যেখানে দেখা যাচ্ছে অনেক মহিলা তাদের এই প্রাপ্ত টাকা ছোটখাটো ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। যে মহিলা পঞ্চায়েত অফিসে ছোট একটা ক্যান্টিন চালান তিনি প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত এই টাকা জমিয়ে একটা রেফ্রিজারেটর ও মিক্সার গ্রাইন্ডার কিনেছেন। নারী প্রগতির এর থেকে সুন্দর উদাহরণ আর কিবা হতে পারে।
আরও পড়ুন-ভাল থাক পোষ্য
সমীক্ষার রিপোর্টে আমরা কেবল পরিমাণ বাচক কিছু তথ্য পাই কিন্তু আমাদের মনের কথা, আশা, উদ্দীপনা এগুলোকে তথ্যের মধ্যে ধরা যায় না। তাই প্রতীচী ট্রাস্টের করা ২০০ জন মহিলার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জায়গাটিকে অবলোকন করা দরকার। পুরুলিয়ার জবা সরেনের কথায় উঠে আসে, “১০০ দিনের কাজের টাকা কেন্দ্র দেয়নি, সংসারের হাল খারাপ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকায় আমি আমার থাইরয়েডের ওষুধ কিনি বাকি টাকা আমার ছেলের পড়াশোনার জন্য জমাচ্ছি”। কেন্দ্র সরকারের বঞ্চনার এক প্রত্যক্ষ চিত্র। উত্তর দিনাজপুরের ৩৫ বছর বয়সি সফেনা খাতুন বলেন, ‘‘গ্রাম দেশে এখনও এরকম হয় নাই যে চাইলে মহিলারা খেটে খেতে পারবে, সময় সময় হাতে টাকাই থাকে না তবু সংসার চালাইতেই হবে তখন এই টাকা খুব কাজে লাগে।” ২৭ বছর বয়সি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার উত্তর দমদম পৌরসভা নিবাসী ঝুম্পা ঘোষ জানিয়েছেন, ‘‘মূলত যারা বাইরের কোনও কাজের সঙ্গেই যুক্ত নয় বাড়ির কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এই প্রকল্পটি বিশেষত সেই সব মহিলাদের খুব প্রয়োজনীয়।” জলপাইগুড়ি জেলার চা-বাগানের শ্রমিক সুমরি এক্কা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা সেলফ হেল্প গ্রুপে সঞ্চয় করেন।
আরও পড়ুন-যোগী পুলিশকে ডোন্ট কেয়ার! রাজার হালে জেলে দিন কাটাচ্ছে দাগি অপরাধী
নোবেল প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, যদি মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দেওয়া যায়, যদি ঠিক প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায় তাহলে অল্প পরিসর হলেও বদল আনা যেতে পারে। দুয়ারে সরকারের সূচনা করে, সরাসরি টাকা মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নারী উন্নয়নের সেই পরিবর্তনেরই সূচনা করেছেন। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের মতো অন্যান্য বিরোধী কুৎসাকারী দলগুলো ভর্তুকিকে ‘দান’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু যে ভর্তুকিকে গ্রহণ করল সে তা নিয়ে কী করল সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। ঐতিহাসিক কাল ধরে নারীরা যেভাবে বঞ্চিত হয়েছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প সেই বঞ্চনার নিরসন করছে। অসংরক্ষিত জাতির মহিলাদের ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০০০ টাকা এবং তফসিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২০০ টাকা নারীর উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার সুরেই বলতে হয়— “জাগো বাংলা মা/ জাগো মাগো জাগো/ ঘুমন্ত নয় জীবন্ত হও/ তোমার রূপ ধরো মাগো।।”