এই গরমে কী খাবেন

তীব্র গরম, এই সময় শরীর থেকে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়ার ফলে শরীরের সোডিয়াম, পটাশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেখা দেয় নানা শারীরিক সমস্যা। এইসব থেকে বাঁচতে জরুরি সঠিক খাওয়া-দাওয়া এবং ব্যায়াম। লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

আজ সকালে মুঠোফোনটা খুলতেই দেখলাম একজন লিখেছে ‘চাঁদকে এত ভালবাসলে সূর্যের জ্বলন তো হবেই’… লেখাটা পড়ে না হেসে পারলাম না। সত্যিই যে হারে পারদ চড়চড়িয়ে বেড়ে চলছে, সেটা দেখে মনে হচ্ছে সূর্য সত্যিই আমাদের উপর রেগে গেছে। চারিদিকে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ শুরু হয়েছে। আর এই গরমে শরীর খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আসলে ঘরের মধ্যে ফ্যান এসি বা কুলারের হাওয়া সাময়িক আরাম দিলেও কাজের জন্য সবাইকে বাইরে বেরোতেই হয়। রোদ থেকে ফিরে এসে অনেকেই ফ্রিজের ঠান্ডা জল ঢক-ঢক করে খেয়ে ফেলে অথবা সঙ্গে সঙ্গে স্নান করে নেয়। আর এতেই শরীরে নানা ধরনের সমস্যা হতে শুরু করে। এছাড়াও এই গরমে সবার আগে যে অসুখটাতে মানুষ ভোগে সেটা হচ্ছে ডিহাইড্রেশন।
গরমকালে প্রথমেই যে বিষয়টার দিকে নজর দিতে হবে সেটা হচ্ছে খাওয়াদাওয়া। এই সময় হালকা তেল-ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। খাদ্য তালিকায় এমন সমস্ত সবজি বা ফল রাখতে হবে যেগুলো শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ করে। আসলে গরম পড়লেই ঘাম এবং প্রস্রাবের সঙ্গে শরীর থেকে সোডিয়াম-পটাশিয়াম বের হয়ে যায়। ফলে শরীরে জলশূন্যতার মতো বড় সমস্যা দেখতে পাওয়া যায়।
গরমে উপযোগী আহার

আরও পড়ুন-নীরজ দ্বিতীয় তবু লক্ষ্যভেদ

গরমকালে কম মশলা দিয়ে রান্না করা খাবার খেতে হবে কারণ কম মশলাযুক্ত খাবার সহজে হজম হয়। এই সময় বাজারে ঝিঙে, লাউ, চিচিঙ্গা, চালকুমড়া, প্রভৃতি বহু ধরনের গ্রীষ্মকালীন সবজি পাওয়া যায় যেগুলোর মধ্যে জলের পরিমাণ বেশি থাকে। গরমকালে এই সমস্ত সবজি বেশি পরিমাণে খাওয়া দরকার কারণ এই সমস্ত সবজি শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও লাউ পেটের সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে। এই সবজিগুলো দিয়ে পাতলা কম মশলাযুক্ত ঝোল রান্না করে খেলে সেটা যেমন পুষ্টির চাহিদা জোগাবে অন্যদিকে শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করবে।
এই সময়ে ডাবের জল, তরমুজ, শসা প্রভৃতি ফল শরীরের জলের ঘাটতি পূরণ করে। সেই কারণে এই সমস্ত ফল গরমকালে খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখা দরকার। শরীরের জলের ঘাটতি পূরণ করতে এবং ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে ডাবের জল এই সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার আপেলের মধ্যে ৮৬ শতাংশই জল থাকে, সেই কারণে গরমকালে সুস্থ থাকার জন্য রোজ একটা করে আপেল খাওয়া খুবই ভাল। তরমুজ হচ্ছে এমন একটি ফল যাতে জল থাকে ভরপুর। আর সেই কারণে গরমকালের খাদ্য তালিকায় তরমুজ রাখা দরকার। তরমুজ যেমন শরীরে জলের জোগান দিতে সাহায্য করে, শরীরকে ঠান্ডা রাখে, ঠিক তেমনি এর মধ্যে উপস্থিত লাইকোপেন ত্বককে সূর্যের ক্ষতির হাত থেকেও রক্ষা করে থাকে। আবার শসা জাতীয় ফলে ক্যালোরি কম, ফাইবার বেশি। তাই গ্রীষ্মকালের খাদ্য তালিকায় যদি শসা রাখা যায় তাহলে জল ও পুষ্টিতে ভরপুর এই ফলটি পেটকে যেমন ঠান্ডা রাখবে ঠিক তেমনি হিটস্ট্রোকের ঝুঁকিও কমাবে। গরমকালের আরও একটি ফল হচ্ছে কাঁঠাল— এই কাঁঠাল শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে ভিটামিন ও মিনারেল থাকে যেটা গরমে শরীরকে সুস্থ রাখে। এছাড়াও এই সময় বাঙ্গি পাওয়া যায়। এটি হচ্ছে একটি সহজলভ্য ফল যেটি শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
গরমকালের খাদ্যতালিকায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে টক দই। এই সময় অবশ্যই পাশে টক দই রাখতে হবে। সেই দই ঘরে পাতা হলে খুবই ভাল, অন্যথায় বাজার থেকে কিনেও খাওয়া যেতে পারে। এই সময় টক দই শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। তাই এই সময় খাদ্য তালিকায় দইয়ের শরবত থেকে শুরু করে দই ভাত, দইয়ের রাইতা, দই চিঁড়ে, দই খই-এর মতো খাবার রাখা যেতেই পারে। এছাড়াও এইসময় খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন ধরনের শরবত রাখতে হবে। গরমকালে রোদ থেকে ঘরে ফিরে আমপোড়ার শরবত খেলে সেটা শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও এসময় বেলের শরবত পাকস্থলী ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। পুদিনার শরবত খেলে শরীরের ভেতর ঠান্ডা এবং সতেজ অনুভূতি দেয়। এছাড়াও গরমকালে সহজলভ্য হচ্ছে লেবু জল। লেবুর জল শরীরের ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে।
গরমে যেগুলো কম খাওয়া উচিত

আরও পড়ুন-ধনিয়াখালিতে রাম-বাম ছেড়ে ৩২ পরিবার তৃণমূলে

এই সময় অতিরিক্ত মশলা দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়া এড়িয়ে যাওয়া ভাল। পিৎজা, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফ্রায়েড চিকেন ইত্যাদি ফাস্টফুডগুলোকে এই সময় এড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। প্রসেস ফুড এই সময় না খাওয়াই ভাল। এ সময় অতিরিক্ত তেলেভাজা বা পোড়া জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলাই ভাল। কারণ এই সমস্ত খাবার শরীরে জলের ঘাটতি তৈরি করে। গরমকালে অতিরিক্ত পরিমাণে চা খাওয়া উচিত নয় কারণ চা বা কফির মধ্যে যে ক্যাফেইন থাকে সেগুলো শরীরকে জলশূন্য করতে এবং শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। এছাড়াও এই সময় অতিরিক্ত তেল-চর্বি জাতীয় খাবার, পোলাও-বিরিয়ানি প্রভৃতি তেল-যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলাই ভাল। চিনি এবং লবণ দুটোই আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর গরমকালে এর ক্ষতির মাত্রাটা বেড়ে যায়। তাই গরমকালে লবণ ও চিনি খাওয়ার মাত্রা কমিয়ে দেওয়া দরকার। এ সময় প্যাকেট জাতীয় খাবার বা প্রসেসড ফুড খাওয়া অনুচিত। এ সময় কোল্ড ড্রিঙ্কস জাতীয় পানীয় অথবা ফ্রিজের ঠান্ডা জল এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সুস্থ থাকতে শরীরচর্চা
গরমে শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, যোগব্যায়াম, সাঁতারকাটা প্রভৃতি। এগুলো শরীরের তাপমাত্রা কমাতে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এই সময় নিয়মিত হাঁটা অত্যন্ত উপকারী। এছাড়াও তাড়াসন, শবাসন আর বালাসন— এই তিনটি আসন শরীরকে ভেতর থেকে ঠান্ডা করতে সাহায্য করে।
শবাসন : চিত হয়ে শুয়ে পা দুটো লম্বা করে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর দুটি হাত শরীরের দুই দিকে রেখে হাতের তালু দুটো শিথিল করতে হবে। এরপরে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থাকার পরে আস্তে আস্তে উঠে বসতে হবে। এই যোগাসনটি মন, মাথা এবং শরীরকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
বালাসন : প্রথমে হাঁটু মুড়ে এমনভাবে বসতে হবে যাতে নিতম্ব গোড়ালির ওপরে থাকে। এরপর শ্বাস নিতে নিতে হাত দুটো মাথার ওপরে রাখতে হবে। এরপর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে শরীরের উপরের অংশ সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে মাটিতে কপাল ঠেকাতে হবে।
তাড়াসন : প্রথমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে, এরপরে দু’পায়ের পাতার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রাখতে হবে। এরপর হাত দুটো উপরে তুলে কাঁধের সমান সমান নিয়ে যেতে হবে এবং হাতের তালু বাইরের দিকে রাখতে হবে। শ্বাস নিতে নিতে মাথার উপর হাত দুটো নিয়ে যেতে হবে ও একটি হাতের তালুর ওপর অন্যটি রাখতে হবে। শরীরের ভারসাম্য পায়ের পাতার উপর রেখে গোড়ালিটাকে মাটি থেকে উপরে তুলতে হবে। এই অবস্থায় তিন থেকে ১০ বার শ্বাস নিতে হবে, এরপর গোড়ালিটা মাটি স্পর্শ করিয়ে শ্বাস ছেড়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে হবে।
নিয়মিত এই আসনগুলি করলে অতিরিক্ত গরমেও শরীর ঠান্ডা থাকবে।
গরমকালে সকাল থেকে রাত— যদি আমরা আমাদের খাদ্য তালিকা আর শরীরচর্চায় নিয়ম বেঁধে দিতে পারি তাহলে এই গরমেও আমাদের শরীর থাকবে তাজা এবং ঝরঝরে।

Latest article