ফোর টোয়েন্টির গ্যারান্টি কাদের জন্য?

মোদি কি গ্যারান্টি। কথাটা যে কত ভাবে, কত কায়দায় মোদি আর বিজেপি আওড়ে বেড়াচ্ছে, সেটা আর কহতব্য নয়। কিন্তু এই 'গ্যারান্টি ' যে দিচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কী? আর, এটা দিচ্ছেই বা কাদের জন্য? গরিব খেটে-খাওয়া মানুষ নাকি ধনকুবের কোটিপতি? খতিয়ে দেখলেন অধ্যাপক সৌরভমধুর দে ও অধ্যাপক প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

২৬ জানুয়ারি ২০১৫, প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লির রাজপথে কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠানে আসীন হয়েছেন, পাশে রয়েছেন সেদিনের আমন্ত্রিত মুখ্য অতিথি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, প্রধানমন্ত্রীর পরনে দশ লক্ষ টাকার সুট, তাতে নকশার কারুকার্য করে লেখা আছে নরেন্দ্র মোদির নাম। এই সুট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন প্রবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী রমেশকুমার ভিকাভাই ভিরানি। এই দশ লক্ষের সুট নিয়ে সরব হয়েছিল রাজনৈতিক বিরোধী মহল-সহ সমগ্র দেশের সচেতন নাগরিকরা, তাঁদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভকে নিরসন করতে মোদি বাধ্য হন তাঁর ১০ লক্ষের সুটকে নিলামে বিক্রি করতে। দাম ধার্য করা হয় ১১ লক্ষ টাকা, কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে তা বিক্রি হয় ৪ কোটি ৩১ লক্ষ ৩১ হাজার ৩১১ টাকায়।

আরও পড়ুন-তছরুপ : ধৃত গদ্দার ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা

ক্রয়কারী সুরাট নিবাসী ব্যবসায়ী লালজি ভাই প্যাটেল, ব্যবসায়ী লালজি ভাই প্যাটেল বিনিময়ে সরকারি জমি পান তাঁর ব্যক্তিগত, বেসরকারি খেলাধুলার ক্লাব তৈরির জন্য। রাজনীতির সাথে পুঁজিপতিদের এই গভীর আঁতাতের ফলে ভারতবাসীর কাছে হাজির হয় প্যারিস স্কুল অফ ইকনমিক্স পরিচালিত ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের এক ভয়ানক রিপোর্ট, যেখানে আমরা দেখতে পাই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের রাজত্বের থেকেও অধিক অসাম্য এই মোদি রাজত্বে। এই রিপোর্ট দাবি করে ২০২২-’২৩ সালে ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই ১ শতাংশ ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত ছিল, দেশের মোট আয়ে তাদের ভাগ ২২ শতাংশের বেশি। আয়ের দিক থেকে শেষ সারির ৫০ শতাংশ বা দেশের অর্ধেক মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ, অথচ বিত্তের বিচারে একেবারে উপরের ১ শতাংশ মানুষের গড় আয় বছরে ৫৩ লক্ষ টাকা, সেখানে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের গড় আয় মাত্র ৭১ হাজার টাকা আর মাঝের সারির ৪০ শতাংশ মানুষের গড় আয় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা আবার সব থেকে ধনী ১০ হাজার ব্যক্তির গড় আয় ৪৮ কোটি টাকা, গড়পড়তা মানুষের আয়ের দু হাজার গুণেরও বেশি।

আরও পড়ুন-আবেগে ভাসলেন শাহরুখ, নাইট পরিবারে থেকে যাও, বার্তা নারিনকে

নরেন্দ্র মোদির জমানায় কোটিপতিরা রাজত্ব চালাচ্ছেন, তাঁরা বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে অর্থ খরচ করছেন। কোম্পানি আইনের ১৮২ নম্বর ধারায় নিয়ম ছিল কোনও সংস্থার রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া মোট বার্ষিক চাঁদা সেই সংস্থার বিগত তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না, ২০১৭ সালে আইন সংশোধনীর মাধ্যমে মোদি সরকার এই নিয়ম তুলে দেয়। গত ২ বছরে অর্থাৎ ২০২২-’২৩ এবং ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে অন্তত ৫৫টি কোম্পানি এই ৭.৫ শতাংশের সীমা উল্লঙ্ঘন করে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি দলকে চাঁদা দিয়েছে এবং এই চাঁদার পরিমাণ ১৪১৪ কোটি টাকা। রাজনৈতিক দলের চাঁদা খাতে তিন বছরের মুনাফার ৭.৫ শতাংশ সীমা তুলে দেওয়ার পরিণতি আরও দেখা যায় ছটি সংস্থার ক্ষেত্রে যারা ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৬৪৬ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে। কিন্তু তাদের গত সাত অর্থ বর্ষের নিট মুনাফার যোগফল দাঁড়ায় মাত্র ১৮৪ কোটি টাকা, এই ছটি সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪১০ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে একটি সংস্থা যার মধ্যে ৪০০ কোটি টাকা চাঁদাই গিয়েছে বিজেপির কাছে, অথচ বিগত ৭ বছরে এই সংস্থাটির মোট মুনাফা মাত্র ১৪৪ কোটি টাকা। কেবল মুনাফার অতিরিক্ত চাঁদাই নয় এমন ৩৩টি সংস্থার হদিশ পাওয়া গিয়েছে, যারা গত ৭ অর্থবর্ষে বড় অঙ্কের নিট লোকসান করেছে, এরা ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ইলেক্টোরাল বন্ডে সব মিলিয়ে ৫৮২ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে যার মধ্যে ৪৩৪ কোটি টাকা বিজেপির কাছে গিয়েছে। ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের কালো টাকা বিজেপির তহবিলে দিয়ে সাদা করা হয়েছে। ইডি, সিবিআই বা আয়কর  দপ্তরের তদন্ত চলছে বা তারা হানা দিয়েছে এইরকম ২২টি কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ১৯১৯ কোটি টাকা দিয়েছে বিজেপিকে। আসলে চাঁদা নয় কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্ত থেকে বাঁচানোর বিনিময়ে ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলেই বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ঘুষ দিয়ে বিদ্যুৎ, সড়ক বা আবাসন নির্মাণ ইত্যাদি পরিকাঠামো প্রকল্পে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার বরাত বা অন্যান্য সরকারি সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ-সহ অভিযোগ উঠেছে অনেক বড় সংস্থার বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন-ইতালিয়ান ওপেনে হার, চোট নিয়ে চিন্তায় জকো

মোদি সরকারের আর্থিক নীতি প্রথম থেকেই শুধু তার ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের জন্য তৈরি হয়েছে। আদানি গোষ্ঠী-সহ পাঁচটি বড় সংস্থা মিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যায় মানুষকে জর্জরিত করে তুলেছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে বেকারত্ব। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ভারতের কর্মসংস্থান নিয়ে ‘ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে দেশে বেকারদের মধ্যে এখন ৮৩ শতাংশই যুবক-যুবতী তাদের বেশিরভাগই শিক্ষিত। রিপোর্ট অনুযায়ী বেকার তরুণদের মধ্যে শিক্ষিতদের ভাগ ২০০০ সালে ছিল ৩৫ শতাংশ কিন্তু ২০২২ সালে তা ৬৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রিপোর্ট আরও জানিয়েছে, গ্রামে তরুণদের মধ্যে মাত্র ১৭.৫ শতাংশ নিয়মিত চাকরির সঙ্গে যুক্ত, যারা কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ শিল্প বা কারখানায় কর্মরত, ২০১২ থেকে এই হার একই জায়গায় থমকে রয়েছে। আর্থিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত তরুণদের হার ২০১২ সালে ছিল ৪২ শতাংশ তা ২০২২ সালে ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। বেকারত্বের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

আরও পড়ুন-মহাকরণ সংস্কারে গতি আনতে তৎপর হল রাজ্য

দেশের প্রতিরক্ষা খাতেও আজ বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবেশ হয়েছে, তাতে জায়গা করে নিয়েছে সেই আদানি গোষ্ঠী যে আদানি গোষ্ঠীর হেলিকপ্টারে চড়ে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে  নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। আজ তাই মনে হয় মোদির গ্যারান্টি শুধুমাত্র সেই স্তাবক হেলিকপ্টার প্রদানকারীদের জন্যে, মাটি থেকে হাত নাড়তে থাকা সাধারণ ভারতবাসীর জন্য নয়।

Latest article