নারীত্বের পক্ষে মেয়েলিপনার বিপক্ষে

তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে থাকত নারীর একান্ত সংবেদন। তবে নিজেকে নারী-লেখক মনে করতেন না। আন্তরিক মমত্ববোধ ছিল স্বভাবে। ছিল এক ধরনের সারল্যও। আজীবন লিখে গেছেন নির্জনে বসে। তিনি কবি দেবারতি মিত্র। সম্প্রতি চলে গেলেন। তাঁকে স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

নিভৃত সাধনাতেই বাংলা কবিতায় এক অনন্য জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন দেবারতি মিত্র। মানুষ হিসেবে ছিলেন স্নেহশীলা। নরম প্রকৃতির। প্রথাগত নারীবাদী কখনওই ছিলেন না। তাঁর কবিতার জগৎ জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় এক আশ্চর্য সংবেদনশীল নারীভুবন। ষাটের দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত তিনি।
জন্ম ১৯৪৬ সালের ১২ এপ্রিল। কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কম বয়স থেকেই তাঁর কবিতাচর্চার শুরু। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের লেখনীর পাশাপাশি কিটস ও এলিয়টের কবিতার সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন-দিল্লির বুরারিতে পিটবুলের কা.মড়ে আহত শিশু

প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায়। ১৯৭৪ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজে’ প্রকাশিত হওয়ার পরই খুব আলোচিত ও প্রশংসিত হন। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আমার পুতুল’ (১৯৭৪), ‘যুবকের স্নান’ (১৯৭৮), ‘ভূতেরা ও খুকি’ (১৯৮৮), ‘তুন্নুর কম্পিউটার’ (২০০০), ‘খোঁপা ভরে আছে তারার ধুলোয়’ (২০০৩), ‍‘করুণ ধুনোর গন্ধ’ (২০২১) প্রভৃতি গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ এবং ‘কবিতাসমগ্র’। ‘কবিতাসমগ্র’র ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘অনেকভাবে বিফলতায় বিসর্জনে ডুবে অনুভব করেছি নদীতে জগদ্ধাত্রী প্রতিমার গয়নার মতো আমার অস্তিত্ব কবিতা হয়ে ভেসে উঠতে চায়।’

আরও পড়ুন-ভিসটেক্স এশিয়ার সিইও সঞ্জয় শাহ ২৫তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে ক্রেন থেকে পড়ে প্রয়াত

কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন গদ্য। অনূদিত হয়েছে বেশকিছু রচনা। তাঁর কবিতায় বিপুলভাবে ছড়িয়ে থাকত নারীর একান্ত সংবেদন। তবে তিনি নিজেকে একেবারেই নারী-লেখক বলে মনে করতেন না। বলতেন, ‍‘‘আমি নারীত্বের পক্ষে, কিন্তু মেয়েলিপনার বিপক্ষে’’। তিনি তাঁর কবিতায় ক্ষেত্র বিশেষে প্রাণবন্ত রূপকের ব্যবহার করেছেন, যা প্রশংসিত হয়েছে পাঠক মহলে। তাঁকে সচরাচর সভাসমিতিতে দেখা যেত না। নিভৃতিই তাঁকে স্বস্তি দিত। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা জানেন, কী আন্তরিক মমত্ববোধ ছিল তাঁর স্বভাবে। ছিল একধরনের সারল্যও।
তাঁর পরম সাহচর্য লাভ করেছেন কবি কৃষ্ণা বসু। তিনি জানিয়েছেন, ‍‘‘বাংলা কবিতায় দেবারতি মিত্র একটি নিজস্ব চিহ্নিত নাম। একদম অন্যরকমের তাঁর কবিতার যাত্রা। তাঁর কবিতায় যে একটা পরাবাস্তব জগৎ আছে, অলৌকিক জগৎ আছে, তা আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়। তিনি সভা-সমিতিতে যেতেন না, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন না। শুধু নির্জনে বসে লিখে যেতেন। তাঁর জীবনসঙ্গী কবি মণীন্দ্র গুপ্ত চলে গেছেন কয়েক বছর আগে। একা হয়ে পড়েছিলেন।’’

আরও পড়ুন-পুলিশের অনুমতি ছাড়া কোনও মিছিল নয়, নির্দেশিকা নবান্নের

দেবারতি মিত্র তথাকথিত জনপ্রিয়তা পাননি। আবৃত্তি শিল্পীরা তাঁর কবিতা খুব একটা বলেন না। কিন্তু কবিদের মনকে তাঁর কবিতা স্পর্শ করে যেত, আজও যায়। মনে করেন কৃষ্ণা বসু। তিনি আরও বলেন, ‍‘‘তাঁর নিজস্ব পদযাত্রাকে আমরা অনুভূতিশীল মানুষেরা ছুঁতে পারি। সেই জন্য তিনি আমার প্রিয় কবি।’’ প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ পত্রিকায় সম্পাদকের অনুরোধে বাংলা কবিতার উপর একটি বড় প্রবন্ধ লিখেছিলেন কৃষ্ণা বসু। সেখানে দেবারতি মিত্রকে নিয়ে ছিল একটি বড় অংশ।
দেবারতি মিত্রর সঙ্গে কখনও চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি এই সময়ের কবি শ্যামশ্রী রায় কর্মকারের। তবে তাঁর কবিতার সঙ্গে রচিত হয়েছে গভীর সখ্য। কথায় কথায় জানালেন, তাঁর কবিতা ‘মাতলা নদীর চুপ টলটলে বালি’, যার উপর দাঁড়াতেই পাঠকের পায়ের তলায় পাড় ধসে পড়ে। ‘সাদা হাসির শব্দ’, স্থলপদ্ম রঙের ঠোঁট নিয়ে কী ভীষণ জীবন্ত তাঁর কবিতা! টুসুগান গাইতে গাইতে জল থেকে উঠে আসা কোজাগরী গড়িয়ে পড়া নিরালা শরীরময়ী ভেনাসের মতো সেই কবিতা সম্মোহিত করে; তার অবসাদ, একাকীত্ব, প্রেম, যৌনতা, বাৎসল্য ও বন্ধুত্বের অলৌকিক স্পৃশ্যতা এমন বিহ্বল করে রাখে, যেন সে মাদক। তিনি আরও বলেন, ‍‘‘তাঁর কবিতা দূর থেকে পড়া যায় না ঠিক। পড়তে পড়তে নিবিড় পাঠকের মনে হয়, আমিই দেবারতি। তাঁর শব্দপ্রবণতা ও চিত্রধ্বনির ঝংকারের ভেতর আমি বারবার ভালবাসার ঝাঁপি নিয়ে বসে থাকা একলা নারীর ছায়া দেখতে পেয়েছি।’’
দেবারতি মিত্র ছিলেন কবিদের কবি, দীক্ষিত পাঠকের কবি। আজীবন ছিলেন সাধারণের নাগালের বাইরে। পৌঁছতে চেয়েছিলেন সেই সমুদ্রের কিনারায়, যার একদিকে জীবন এবং শিল্প, অন্যদিকে গভীর শূন্যতা। যেখানে কল্পনা কেবলই নিজেকে সৃষ্টি করে চলে। তাঁর নিজস্ব এক কল্পনার ভুবন ছিল, যেখান থেকে উঠে এসেছে তাঁর কবিতা, যা সম্ভব-অসম্ভব, বাস্তব-অবাস্তব, উচিত-অনুচিতের ঊর্ধ্বে উঠে পৌঁছতে চেয়েছে চির সত্যের কাছে। সংসারের স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়মিতই করতেন। ব্যাঙ্কে, পোস্ট-অফিসে যেতেন। তার মধ্যেই পেয়ে যেতেন কবিতার স্পন্দন, তার আবছা বিচ্ছুরণ। বাজার করতে গিয়ে কিংবা ডাক্তার দেখাতে গিয়েও পেয়ে গেছেন কবিতার বীজ। কাব্যকৃতির জন্য পেয়েছেন ‘কৃত্তিবাস’ পুরস্কার। এ ছাড়াও পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার।

আরও পড়ুন-ডার্বি জিতে শেষ চারে ইস্টবেঙ্গল

গত ১১ জানুয়ারি চলে গেলেন। নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানান সমস্যায় ভুগছিলেন। কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কবিতার ভুবনে আমার পূর্বনারীরা সকলেই চলে গেছেন প্রায়। শেষ, হাত ধরে ছিলেন দেবারতিদি, দেবারতি মিত্র। তিনি সেই মায়াতন্তু ছিঁড়ে চলে গেলেন। ওঁর কাছে গেলে, ওঁর সান্নিধ্যে মনে হত, শীতলপাটি বিছানো। এখনই চলে আসবে গন্ধরাজ লেবুর শরবত। কী শান্তি! কী শান্তি! কবিতায় কুহক বিছানো পথ ছিল দেবারতিদির। অলৌকিকতা ছিল। রহস্যের জল ভেঙে ভেঙে এগিয়েছি আমরা।

Latest article