পছন্দ হয়নি নিজের কণ্ঠস্বর
বয়স তখন মাত্র ৯। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর বম্বে কেন্দ্রে প্রথমবার পা রাখেন। দাদা বেতার উপস্থাপক হামিদ সায়ানির হাত ধরে। দাঁড়ান মাইক্রোফোনের সামনে। রেকর্ডিং করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, নিজের কণ্ঠস্বর তাঁর নিজেরই পছন্দ হয়নি। সেই তিনি, আমিন সায়ানি, পরবর্তী সময়ে ব্যারিটোন ভয়েস ও অনবদ্য বাচনভঙ্গির জোরে জয় করে নেন শ্রোতাদের হৃদয়। গানের ভক্ত ছিলেন ছোট থেকেই। তবে নিজে গাইতেন না। শুনতেন। তাঁর উপলব্ধি ছিল, চলচ্চিত্রের গান ভারতবর্ষকে একটি তারে বেঁধেছে। এর ফলে কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন হয়েছে সমাজ। শ্রবণ-শিল্পীদের এই পরম বন্ধু আজীবন সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন শিল্পীদের সঙ্গে। তাঁদের কথা, তাঁদের গান অতিযত্নে পৌঁছে দিয়েছেন শ্রোতাদের দরবারে। টেলিভিশন, স্মার্টফোনহীন যুগে তিনিই জোগাতেন বিনোদনের রসদ।
আরও পড়ুন-ভাষা রক্ষায় নারীরা
টাকা পাননি প্রথম কাজে
পাঁচের দশকের শুরুতে রেডিও সিলোন-এ সম্প্রচারিত হত বাণিজ্যিক অনুষ্ঠান ‘ফুলবারি’। একটি হেলথ ড্রিংক প্রস্তুতকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনায়। একদিন উপস্থাপক অনুপস্থিত। নির্মাতারা আমিন সায়ানিকে অনুরোধ করেন উপস্থাপনার জন্য। হঠাৎ পাওয়া সুযোগটি দারুণভাবে কাজে লাগান আমিন। নির্মাতারা খুশি হয়ে বলেন, ‘এখন থেকে আপনিই উপস্থাপক।’ টাকা নয়, প্রত্যেক সপ্তাহে একটি করে হেলথ ড্রিংকের ডিব্বা পেতেন আমিন। তাঁর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি সাফল্য পায়। শোনানো হত মূলত নতুন শিল্পীদের গান।
মেজাজ তৈরি করে দিত
১৯৫২ সালে আমিন সায়ানিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল বেতারের জনপ্রিয় সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘গীতমালা’। অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর মার্জিত কণ্ঠে ‘নমস্তে বেহেনোঁ অউর ভাইয়োঁ…’ আন্তরিক সম্বোধনটি মেজাজ তৈরি করে দিত। নড়েচড়ে বসতেন শ্রোতারা। তিনি ভাসিয়ে দিতেন একটার পর একটা গান। বলিউডের হিট গানের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠস্বরের যুগলবন্দি জয় করেছিল দেশের মানুষের মন। অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রেডিয়োয় নিয়মিত সম্প্রচারিত হত। পরবর্তী সময়ে ২০০০ ও ২০০১ সালে কিছু পরিবর্তন করে পুনরায় অনুষ্ঠানটিকে ফিরিয়ে আনা হয়। কেরিয়ারে প্রায় ৫৪ হাজার রেডিয়ো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। বিজ্ঞাপনের জগতেও তাঁর ভয়েসওভারের সংখ্যা ১৯ হাজারেরও বেশি। অল ইন্ডিয়া রেডিওর জনপ্রিয়তার পিছনে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। চেষ্টা করতেন সহজ-সরল ভাষায় কথা বলতে। যাতে সহজেই শ্রোতারা বুঝতে পারেন। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি মন দিয়ে মনের কথা শ্রোতাদের মনে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
আরও পড়ুন-কুটির শিল্পে বাংলার মহিলারা
খলনায়ক হতে চাননি
সম্পর্ক ছিল মঞ্চের সঙ্গেও। সঞ্চালনা করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান। একটা সময় থিয়েটারে অভিনয় করতেন আমিন। ফিল্মে অভিনয়ের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। তবে রাজি হননি। তাঁর কথায়, ‘আমি হতে চাইতাম নায়ক। অথচ দেওয়া হত খলনায়কের চরিত্র। তাই যাইনি।’ তবে ‘ভূত বাংলা’, ‘তিন দেবিয়াঁ’, ‘বক্সার’, এবং ‘কাত্ল’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে তাঁকে ঘোষকের ভূমিকায় দেখা গেছে।
জব্দ করেছিলেন কিশোরকুমারকে
বহু কিংবদন্তি শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যেমন, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আশা ভোসলে, মোঃ রফি, তালাত মাহমুদ প্রমুখ। একবার কিশোরকুমারের সাক্ষাৎকার নিতে চান আমিন। কিশোরকুমার একটি স্টুডিওয় তাঁকে ডাকেন। রেকর্ডিং সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে আমিন দেখেন, স্টুডিওর দরজা বন্ধ। বাইরে দাঁড়িয়ে প্রযোজক। তিনি বলেন, ‘আপনি না গেলে কিশোরকুমার এখানে আসবেন না বলে জানিয়েছেন।’ অপমানিত বোধ করেন আমিন। সিদ্ধান্ত নেন, আর কোনওদিন কিশোরকুমারের সাক্ষাৎকার নয়। এইভাবে কেটে যায় দীর্ঘ সময়। প্রায় ১৮ বছর পর কিশোরকুমার নিজের প্রয়োজনে আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাক্ষাৎকার দিতে চান। রাজি হন আমিন। স্টুডিওয় মাইক্রোফোনের সামনে মুখোমুখি বসেন দুজন। আমিনের মনে পড়ে ১৮ বছর আগের ঘটনাটি। তিনি কিশোরকুমারকে বলেন, ‘স্টুডিওর গেটের বাইরে দুজন পাহারাদার দাঁড়িয়ে। এই সাক্ষাৎকারের পর আমাকে আরেকটি সাক্ষাৎকার না দিয়ে আপনি এখান থেকে বেরোতে পারবেন না।’ কিশোরকুমার বুঝতে পারেন, কেন আমিন এমন কথা বলছেন। তিনি হাসেন এবং সম্মত হন। সেই দিন কিশোরকুমার আমিনকে পরপর দুটো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। প্রথমটি নিজের প্রয়োজনে, দ্বিতীয়টি আমিনের ইচ্ছায়। বুদ্ধিমান আমিন এইভাবেই জব্দ করেছিলেন কিশোরকুমারকে। আমিন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বহু জনপ্রিয় ফিল্ম স্টারেরও।
আরও পড়ুন-অঞ্জনা নদীতীরে
ছড়িয়ে পড়েছিলেন সারা পৃথিবীতে
১৯৩২ সালের ২১ ডিসেম্বর মুম্বইয়ে জন্ম আমিন সায়ানির। পড়াশোনা মহারাষ্ট্রের নিউ এরা এবং পরে গোয়ালিয়রের আবাসিক সিন্ধিয়া স্কুলে। বোম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতক হন। পরবর্তী ১৪ বছর মা কুলসুম সায়ানিকে নব্য-সাক্ষরদের জন্য পাক্ষিক পত্রিকা ‘রাহবার’ সম্পাদনার কাজে সাহায্য করেন। শুরুর দিকে ছিলেন ইংরেজি উপস্থাপক। পরে হিন্দি উপস্থাপনায় জোর দেন। দূরদর্শনের কয়েকটি অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন। তাঁর রেডিও শো-সহ বাচিক শিল্পকর্ম লং প্লেয়িং রেকর্ড, ক্যাসেট এবং পরবর্তীতে কমপ্যাক্ট ডিস্কে প্রকাশিত হয়েছে। এইভাবেই ছড়িয়ে পড়েন সারা পৃথিবীতে। ২০০৯ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। ৯১ বছর বয়সে।
যেন সামনে বসে কথা বলছেন
আমিন সায়ানির প্রতি অপার মুগ্ধতা বেতার-ব্যক্তিত্ব দেবাশিস বসুর। তিনি জানালেন, ‘ওঁর শব্দচয়ন আমাকে আকৃষ্ট করত। উপস্থাপনা ছিল পরিমিত, পরিশীলিত, আন্তরিক। বলার মধ্যে ছিল মাপ এবং মান। সেটাই স্বতন্ত্র করেছিল। সৌম্য দর্শন, সুভদ্র ব্যক্তি। গীতমালা বলতে ওঁকেই বোঝাত। উপস্থাপনা ছিল সহজ-সরল, কিন্তু চটুল নয়। এটাই ওঁর সৌন্দর্য। রসবোধ ছিল দারুণ। ছিলেন নলেজেবল। সবকিছুকে আপন করে নিতে পারতেন। শ্রোতাদের মনে হত, যেন সামনে বসে কথা বলছেন। এইগুলো আমাকে উদ্বুদ্ধ করত। বিশেষত যখন আমি রেডিয়োয় কাজ শুরু করি। একসঙ্গে একটি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কথা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। ঘুমের দেশে শান্তিতে থাকুন, আমিন।’