মার্কসবাদী নেতা লক্ষ্মী সেন বহুদিন আগে একান্ত আলাপচারিতায় একটা মূল্যবান কথা বলেছিলেন। নিজের পার্টি সিপিএম সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন। লক্ষ্মীবাবুর কথায়, ‘এই যে আজ সিপিএমকে দেখছেন, এটা আসলে একটা নরকঙ্কাল। রক্ত-মাংসহীন। কঙ্কাল যদি পড়ে যায়, নিজের শক্তিতে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। আমাদের পার্টিও ক্ষমতাচ্যুত হলে, তাদের দশা কঙ্কালের মতোই হবে। আর কোনওদিন সিপিএম ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’
আরও পড়ুন-বৈঠক শেষে এক নজরে তৃণমূলের সংসদীয় কমিটি
এসব কথা যখন হয়েছিল, সেই নব্বই দশকের মধ্যভাগে লক্ষ্মীবাবু দলের মধ্যে যথেষ্ট কোণঠাসা। এক সময়ে সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক এবং পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন প্রয়াত লক্ষ্মী সেন। লালবাজারে রশিদ খানের ডেরায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সিপিএমের মধ্যে যে কাঁপন ধরে, তারই পরিণতি ছিল লক্ষ্মীবাবুর একঘরে হওয়া।
বিটি রোডের নিজের ছিমছাম ফ্ল্যাটে বসে লক্ষ্মীবাবু ওইসব বিস্ফোরক কথাবার্তা বলেছিলেন। রাজ্যবাসী দেখছেন, ২০১১ সালে পরিবর্তনের পর থেকে সিপিএমের দশা লক্ষ্মীবাবুর কল্পিত কঙ্কালের মতোই হয়েছে। রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে তারা। বিধানসভায় এখন তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই। যে কংগ্রেসের বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে সিপিএমের জন্ম ঘুরে দাঁড়াতে এখন তারাই দোসর। আর তাদের পাল্লায় পড়ে রাজ্য কংগ্রেসও ক্রমশ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। কংগ্রেস কি ভুলে গিয়েছে, ৩৪ বছরের বাম শাসনে ৩৪ হাজারেরও বেশি তাদের দলের নেতা-কর্মী সিপিএমের হাতে খুন হয়েছে? বারবার নির্বাচনী ইস্তাহারে কংগ্রেস এই সন্ত্রাসের দায়ে সিপিএমকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আর এখন তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্ধ-বিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই করে না তারা। তাই তাদের অবস্থাও সিপিএমের মতোই হয়েছে। বাংলায় অস্তিত্বের সংকট চলছে। পাঁচ-পাঁচবারের সাংসদ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী নিজের কেন্দ্র বহরমপুরে হেরে গিয়েছেন। দলে তাঁর বিরোধীরা প্রাণভরে বলছে, ‘দেখ কেমন লাগে!’
আরও পড়ুন-বৈঠক শেষে এক নজরে তৃণমূলের সংসদীয় কমিটি
বঙ্গ কমরেডরা দীর্ঘদিন ধরে কেরলে পার্টির প্রভাব এবং ক্ষমতা নিয়ে নাচায়। এবারের লোকসভা নির্বাচনে কেরলে মাত্র একটি আসনে জিতে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। কেরলে বিজেপির সঙ্গে সেটিংয়ের রাজনীতিই মার্কসবাদীদের মাটি ধরেয়ে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন মেয়ে-জামাইকে দিয়ে দুর্নীতির পাহাড়ে বসে আছেন। বিজেপি-বিরোধী বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীদের বাড়িতে, অফিসে কয়েকবছর ধরে চলছে মোদি-শাহের এজেন্সিগুলির তত্ত্বতল্লাশ। অথচ বিজয়ন বসে আছেন বহাল তবিয়েতে। তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করেনি সিবিআই-ইডি।
তার বিনিময়মূল্য হিসাবে কেরলে ওয়ানাড কেন্দ্রে কংগ্রেসকর্তা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে জাঁদরেল প্রার্থীও খাড়া করেছিল মার্কসবাদীরা। সিপিআইয়ের সর্বোচ্চ নেতা ডি রাজার স্ত্রী প্রার্থী হয়েছিলেন রাহুলের বিরুদ্ধে। আর কেরলে বিজেপিকে খাতা খোলার রাস্তাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন বিজয়নরা। তবে, বিজেপিকে একটি আসন উপহার দিলেও, কেরলে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে সিপিএম এবং তার সঙ্গীরা। লালপার্টি পেয়েছে মাত্র ১টি আসন। আর রাহুল নিজেই শুধু রেকর্ড মার্জিনে জেতেননি কংগ্রেস কেরলে ২০টির মধ্যে ১৪টি আসন দখল করেছে।
রাজস্থানে আর একটি আসনের জোরে লোকসভায় এবার সিপিএমের এমপি মাত্র ২ জন। বাংলার মতোই জাতীয় রাজনীতিতেও সিপিএম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে। সীতারাম ইয়েচুরি আর দিল্লিতে কথার কেরামতি দেখাতে পারবেন না। কোনও ছোট বা দল জাতীয়স্তরে তাদের গুরুত্বই দেবে না। বাংলার পর ত্রিপুরা, এবার তাদের খেল খতম হতে চলেছে কেরলেও।
আরও পড়ুন-নিশীথ হেরে যেতেই তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ ৯ বিজেপি নেতার
বিভিন্ন সময় কেন্দ্রে ‘দুর্বল’ সরকারকে ব্ল্যাকমেল করে বাংলা এবং কেরলে সিপিএমের ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব আখের গুছিয়েছে। এ-রাজ্যে অবশ্য মমতাকে রুখতে কেন্দ্রীয় সরকারকে বহু বছর ঢাল করতে দেখা গিয়েছে সিপিএমকে। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে দিল্লির কংগ্রেসকে নানাভাবে প্রভাবিত করতেন। যাতে অগ্নিকন্যা বিশেষ এগোতে না পারেন, হাইকমান্ড যে অভিভক্ত কংগ্রেস থাকার সময় মমতাকে সিপিএম বিরোধী আন্দোলনের পথ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি, সেটা বঙ্গবাসী জানে। আর জানে বলেই তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজ্যের সিংহভাগ বাম-বিরোধী মানুষ মমতাকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তৃণমূল নেত্রীকে বহুবার আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। এমনকী সিপিএমের হার্মাদরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একাধিকবার হত্যার চেষ্টাও করেছে। কলকাতার হাজরা মোড়ে তাঁকে রাস্তায় ফেলে মারার ঘটনা রাজ্যবাসী আজও ভেলেনি। কোনওদিন ভুলবেও না।
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো জনপ্রিয়তার জোয়ারে বাংলায় মমতা সিপিএম-বিরোধী রাজনীতিকে কার্যত একাই টেনে নিয়ে গিয়েছেন। ২০০৪ সালে লোকসভার ভােটে লাল সন্ত্রাস আর বল্গাহীন রিগিংয়ের জেরে তৃণমূল কংগ্রেস এ-রাজ্যে মাত্র একটি আসন জেতে। মমতা একাই এমপি হন। রণাঙ্গনে একা হয়েও তিনি লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার সেই সময় বলেছিলেন কিংবা লিখেছিলেন— ‘মমতা ফিনিশ! আর কিছু করতে পারবে না তৃণমূল কংগ্রেস।’
আরও পড়ুন-ছত্তিশগড়ে ফের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে খতম ৭ মাওবাদী
জোড়াফুলের সেই দুঃসময়ে দুই ব্যক্তির বিশ্লেষণ আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না। একজন কিংবদন্তি সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত, অন্যজন বিদগ্ধ বামপন্থী নেতা এবং ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্ণধার অশোক ঘোষ। দু’জনেই প্রয়াত। বরুণবাবু লিখতেন, ‘অত সহজে মমতাকে শেষ করা যাবে না। কালীঘাটের মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াবেই। সিপিএমকে মমতা স্বস্তিতে থাকতে দেবে না।’
একই কথা একান্ত আলোচনায় বলতেন অশোকবাবুও। তিনি বহুবার আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলার ভবিষ্যৎ রাজনীতির একজন পথিকৃৎ মমতা। ওকে আমরাই আপোসহীন নেত্রী বানিয়ে দিচ্ছি। যত আক্রমণ হবে, ততই ওর জেহাদ বাড়বে এবং বাম-সরকার বিরোধী শক্তি মমতাকে ঘিরে জোট বাঁধবে।’
বর্তমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, সেদিনের এইসব ভবিষ্যদ্বাণী কতটা বাস্তবসম্মত ছিল। মমতার ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে প্রভাব খর্ব করতে সিপিএম এবার তাদের প্রার্থী তালিকাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল পার্টির কমবয়সি ছেলে-মেয়েদের। টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্রের বড় অংশ সিপিএমের এইসব তরুণ প্রজন্মের প্রার্থীদের বিরাটভাবে তুলে ধরেছিল। এমনকী কেউ কেউ তো এমনও বলছিল, এরা নাকি জিতেও যেতে পারে। কিন্তু বাংলার মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে, লক্ষ্মী সেনের কথামতো পার্টির এইসব প্রার্থীরাও সেই নরঙ্কালেরই অংশ। কথায় বাজিমাত করলেও, কাজের ক্ষেত্রে তাদেরও উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আসলে বঙ্গবাসীর কাছে সিপিএম আর কোনওদিন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না।