চাহিদা আছে অথচ জোগান নেই। জোগান আছে কিন্তু চাহিদা নেই। এমন ব্যাপারস্যাপার তো হামেশাই দেখা যায়। কিন্তু কে না জানেন চাহিদা ও জোগানের সম্পর্কের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্ব-অর্থনীতি। তাই এ-দুইয়ের ভারসাম্য সর্বদাই কাঙ্ক্ষিত। এই বস্তুবিশ্বে জীবনধারণের জন্য খাদ্য, জল, আলো-বাতাস ও বাসস্থানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু আছে, যেগুলো না হলে মানবসভ্যতার ভিত টলমল করতে থাকে। যদিও আজকের তথাকথিত এই আধুনিক পৃথিবীতে একদিকে যেমন দায়-দায়িত্বহীন নিঃশর্ত ও নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের দিকে ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে মানুষের একাংশ, অন্যদিকে বিরাটসংখ্যক নারী ও পুরুষ বংশবৃদ্ধি তথা নবজাতকের চাহিদা মেটাতে তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত কিছু বাজি ধরতে প্রস্তুত। এই পরিস্থিতিতে সন্তানহীন দম্পতিদের হাতে নবজাতক তুলে দেওয়ার জন্য সন্তান তৈরির কৃত্রিম উপায় নিয়ে বহুকাল আগেই গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে।
আরও পড়ুন-বাসের রেষারেষি, ধর্মতলায় ভেঙে পড়ল আলোর তোরণ
আজ তা সাফল্যের মুখ দেখেছে। তাই বর্তমানে চড়া দামে বাচ্চা কেনাবেচা চলছে। এমনকী ইউরোপের একটি দেশ সন্তান তৈরির কারখানাও খুলেছে!
পূর্ব ইউরোপের ওই দেশটিতে গর্ভ ভাড়া বা সারোগেসি পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম দম্পতিরা বাবা-মা হতে পারেন। দেশটির নাম ইউক্রেন। এই দেশে সন্তান কিনতে হলে খরচ করতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায়, বিদেশি দম্পতিদের জন্য ফি-বছর আড়াই থেকে তিন হাজার বাচ্চার জন্ম হয় ইউক্রেনে। এই দম্পতিদের অধিকাংশই চিনের বাসিন্দা। ভারত ও থাইল্যান্ড বিদেশিদের জন্য সন্তান ধারণের বাণিজ্যিক সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। এই সুযোগে ভাগ্য খুলেছে ইউরোপের এই দেশটির। এখানে সারোগেসির মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ন্যূনতম খরচ ২৫ হাজার ইউরো। গর্ভ ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে সন্তানের জন্মদান বিষয়টিকে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ও শিল্প-পর্যায়ে নিয়ে গেছে দেশটি। এই খরচ বেড়ে ৭০ হাজার ইউরো পর্যন্ত হতে পারে, অর্থাৎ ২৫ লাখ থেকে ৭০ লাখ পর্যন্ত খরচ হতে পারে। যদিও অর্ধেকের ক্ষেত্রে ৪০ লাখ টাকার মধ্যেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘন মামলায় ঘটনার পুনর্নির্মাণ বিশেষ দলের
ক্লিনিকটির ওয়েবসাইটে প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, দম্পতিরা চাইলে পুত্র অথবা কন্যাসন্তান তাঁদের চাহিদামতো পেতে পারেন। প্রক্রিয়ার শুরুতেই প্রতিটি দম্পতিকে মানতে হয় কিছু আবশ্যিক শর্ত। পুত্র বা কন্যা বেছে নিতে দু’বার চেষ্টা করতে পারবেন তাঁরা। আবার পছন্দমতো না-হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারবেন তাঁরা। প্রথমটির মূল্য ৪৯ হাজার ৯০০ ইউরো এবং দ্বিতীয় পদ্ধতির মূল্য ৬৪ হাজার ৯০০ ইউরো। কোনও সমকামী দম্পতি এই প্রক্রিয়ায় সন্তান নিতে পারবেন না। কেবলমাত্র বিবাহিত নারী-পুরুষেরা এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তবে তাঁরাও যে সন্তানের জন্মদানে অক্ষম, সেই সংক্রান্ত মেডিক্যাল সার্টিফিকেট অবশ্যই দেখাতে হবে।
আরও পড়ুন-চলন্ত বাসে দ.লিত কন্যাকে গণ.ধর্ষণ, পলাতক এক অভি.যুক্ত
তা হলে কি মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির টান চিরতরে ঘুচে যাবে? নিজের গর্ভে রক্তেমাংসে তিল তিল করে শিশুকে গড়ে তোলার দিন শেষ হয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে? মাতৃত্বের অপার্থিব আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন ‘মায়ের জাত’ নারীকুল? ধাত্রী-মা অর্থাৎ ধাইমায়েরা তো হারিয়ে গেছেন সেই কবে! এবার কি স্থায়ীভাবে বিদায় নেবে আঁতুড়ঘর? থাকবে না প্রসবযন্ত্রণা ও প্রসূতিসদন? গর্ভধারিণী শব্দটা একেবারেই কি মূল্যহীন হয়ে পড়বে? কে জানে! সেদিকেই হয়তো এগোচ্ছে পৃথিবী। সন্তানের জন্মদানের জন্য আর হয়তো মায়ের গর্ভের দরকার হবে না ভবিষ্যতে। কৃত্রিম গর্ভেই বড় হতে থাকবে শিশু। মায়ের শরীরের গন্ধ ছাড়াই বাচ্চা জন্ম নেবে গবেষণাগারে। সে বাচ্চা হবে নিখুঁত ও নীরোগ। তার রং-রূপ ইচ্ছেমতো বদলে দিতে পারবেন মা-বাবা। কোনও অসুখ থাকবে না। সে-বাচ্চাকে লড়াই করে জন্ম নিতে হবে না, থাকবে না জন্মদানের সময় মা ও বাচ্চার মৃত্যুভয়। সে বাচ্চা কৃত্রিম গর্ভ থেকে সরাসরি দেখবে পৃথিবীর আলো। তার বুদ্ধিমত্তাকে প্রখর করে তোলা হবে শান দিয়ে। সে হয়ে উঠবে তথাকথিত ‘সুপার বেবি’।
আরও পড়ুন-সাধভক্ষণ চিরকালীন হয়েও সমকালীন
কৃত্রিম উপায়ে একসঙ্গে ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হবে ল্যাবরেটরিতে। এমনই এক বাচ্চা তৈরির কারখানা গড়ার স্বপ্ন দেখছেন ইয়েমেনের এক বিজ্ঞানী তথা মলিকিউলার বায়োটেকনোলজিস্ট হাশেম আল ঘাইলি। সায়েন্স ফিকশনের গল্প নয়, আদতেই এমনটা সম্ভবত ঘটতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে। আল ঘাইলির গবেষণাকেন্দ্র ‘এক্টোলাইফ’ এমনই কৃত্রিম গর্ভের ল্যাবরেটরি তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এই গবেষণাগারের সম্ভাব্য গঠন, তার প্রযুক্তি, কৃত্রিম গর্ভে বাচ্চাদের বড় করে তোলার কৌশল, গবেষণাগারেই প্রসবের পদ্ধতি ইত্যাদির ভিডিও ইতিমধ্যেই সামনে এনেছেন বিজ্ঞানী।
আরও পড়ুন-বি.শৃঙ্খলা তুঙ্গে, যোগীরাজ্যে ৫৫ বছর বয়সী মহিলার শ্লী.লতাহানি, যুবককে বেঁ.ধে মা.রধর গ্রামবাসীর
৭৫টির বেশি ল্যাবরেটরিতে ৪০০-র বেশি কৃত্রিম গর্ভ বা বেবি পড বা গ্রোথ পড থাকবে। গোল গোল কাচের বাক্সের মতো যন্ত্রই হল সেই গর্ভ যেখানে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হবে। ওই বাক্সগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অপ্রচলিত শক্তি বা সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি থেকে তৈরি বিদ্যুতের দ্বারা পাওয়ার সাপ্লাই হবে বাক্সে। কাজেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আইভিএফ পদ্ধতিতে মায়ের ডিম্বাণু ও বাবার শুক্রাণু মিলিয়ে তৈরি হবে ভ্রূণ। সেই ভ্রূণ মায়ের গর্ভে প্রতিস্থাপন না করে রাখা হবে সেই কৃত্রিম গর্ভে। তারপর সেখানে বড় হতে থাকবে শিশু। বিজ্ঞানী হাশেম বলেছেন, বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দেওয়ার জন্য দু’রকম বায়োরিয়েক্টর থাকবে। একটি থেকে দরকারি পুষ্টিকর উপাদান বাচ্চার শরীরে ঢুকবে। অন্যটিতে বর্জ্য জমা হবে। বায়োরিয়েক্টর দুটি থেকে দুটি কেবলের মতো তার জোড়া থাকবে প্রতিটি বেবি পডে। এক্ষেত্রে যদিও মায়ের শরীরের স্পর্শ পাবে না শিশু, কিন্তু বেবি পডে এমন ব্যবস্থা থাকবে যাতে মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পাবে শিশু।
বাচ্চা তার মাকে যাতে অনুভব করতে পারে গর্ভাবস্থায় তার ব্যবস্থাও থাকবে। বেবি পডে ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা থাকবে যার সাহায্যে বাড়িতে বসেই মা প্রতি মুহূর্তে তার বাচ্চার নড়াচড়া দেখতে পারবেন, তার শ্বাস নেওয়া অনুভব করবেন। কৃত্রিম কর্ড থাকবে বেবি পডে, অ্যাম্বিলিক্যাল কর্ড। প্রসবের সময় কৃত্রিম গর্ভ থেকে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বেরিয়ে যাবে। তখন সন্তানের জন্ম হবে। পুরো প্রক্রিয়াটাই গবেষণাগারে বসে দেখতে পাবেন মা-বাবা। প্রসবযন্ত্রণা ছাড়াই জন্ম হবে সুস্থ সন্তানের। বাচ্চার গায়ের রং, চুল, চোখের রং মা-বাবার ইচ্ছেমতো গড়ে দেবেন বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন-সময় এসেছে জোট বাঁধার, হাতে হাত ধরে স্বৈরশাসন রোখার
ক্লিসপার ক্যাশ-৯ জিন এডিটিং পদ্ধতিতে জিনের বিন্যাসের অদলবদল করে এই সমস্ত রংবদল করবেন বিজ্ঞানীরা। এমনকী চোখের মণির রং পর্যন্ত পাল্টানো যাবে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা বসে থাকবেন হুকুমের অপেক্ষায়। বাচ্চার ওজন, উচ্চতা মনের মতো করে গড়ে নিতে পারবেন মা-বাবা। বিজ্ঞানী হাশেমের দাবি, এই ল্যাবে কোনও অসুস্থ বা প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চা জন্মাবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঠিক প্রয়োগে জিনের সাজসজ্জাই বদলে দেবেন বিজ্ঞানীরা। সুস্থ ও নীরোগ শিশু জন্ম নেবে। জেনেটিক রোগের সম্ভাবনা থাকলে তা আগে থেকেই সারিয়ে দেওয়া যাবে। বাচ্চা হবে ‘সুপার ইন্টেলিজেন্ট’। ঠিক যতটা মেধা চান মা-বাবা, ততটা মেধা ভরে দেওয়া হবে বাচ্চার মগজে। শরীরে, মনে ও বাচ্চার বুদ্ধিমত্তায় সামান্যতম খুঁত থাকবে না। বাচ্চা হবে সুস্থ, সতেজ ও শক্তিশালী।
আরও পড়ুন-অভিষেকের ট্যুইট ‘বুম’
চিন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়েরা এখন নিজের গর্ভে সন্তান চাইছেন না। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ঝক্কিও অনেক। বিশ্ব জুড়েই মেয়েদের ব্যস্ততা এখন বেড়েছে নানা কারণে। বেড়েছে কর্মরতা মহিলাদের সংখ্যাও। সন্তান জন্ম দেওয়ার কষ্ট সহ্য করতে রাজি নন অনেক নারী। সময় নেই তাঁদের। তাই সহজ উপায়ে ও গ্যারান্টি সহকারে বাচ্চা তৈরি করে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন ইয়েমেনের বিজ্ঞানীরা। হয়তো সবই হবে। খোদার ওপর খোদকারি করে সন্তানের জন্মও হয়তো হবে। কিন্তু সম্পূর্ণ নিখুঁত সুপার হিউম্যান মায়া-মমতা ও ভালবাসায় ভরা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে কি না সেটা জানার জন্য অধীর আগ্রহে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। মনুষ্যত্বের জয় হোক।