শীতের সঙ্গে শহর কলকাতার নেহাতই খুনসুটির সম্পর্ক। আসছি আসছি করে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে ফের গায়েব। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে হাপিত্যেশ আর শীত-কামনায় বিরহ-মধুর দীর্ঘশ্বাস, হাতে থাকে এই দুই। কিন্তু প্রেম যদি সত্যি টানে তবে কিছু কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া কী এমন আর। ঘুরে আসুন ঘুম। শীতের আবেশ, উৎসবের আমেজ, এক্কেবারে প্যাকেজ ট্রিপ। জানাচ্ছেন প্রীতিকণা পালরায়
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় কি নয়া ভোর আসন্ন?
অবাক হচ্ছেন তো? বাঙালির ঘর-গেরস্থালির সম্পর্ক যার সঙ্গে সেই দার্জিলিং-এর কথা না বলে বলছি ‘ঘুম’-এর কথা! ‘ঘুম’ তো আমরা পার হয়ে যাই। কিংবা দার্জিলিং থেকে কোনও একদিন এক ফাঁকে ছোট করে ঘুরে যাই। সেই ঘোরাটাই এবার হতে পারে বড় করে। ‘ঘুম’-এ থাকতেই পারেন পাহাড় ভ্রমণ ও শীত উদযাপন একটু অন্যভাবে করার জন্য। কারণ উদযাপনকে উৎসবের আকার দেওয়া হয়েছে। ১৫০ বছরের পুরনো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এই দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। ১৯৯৯ সালে যাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। আর এই রেলওয়েকে ঘিরেই এই উৎসব। ১৩ নভেম্বরে শুরু হয়ে ৫ ডিসেম্বর, ২৩ দিন যাবৎ চলবে ‘ঘুম’ উৎসব।
আরও পড়ুন-ভোট শুরুর আগেই উত্তপ্ত আগরতলা
স্থানীয় সংস্কৃতি অর্থাৎ লোকগান, নৃত্য, অ্যাডভেঞ্চার এবং ট্যুরিজমকে তুলে ধরা হবে যা পর্যটকরা উপভোগ করবেন দুর্দান্তভাবে। পাশাপাশি থাকছে প্রতিদিন সকালে হেরিটেজ ওয়াক ও ট্র্যাকাথন। এছাড়া স্থানীয় হস্তশিল্পকে তুলে ধরতে শিল্পীদের তৈরি সামগ্রী, শিল্পকর্মও ‘ঘুম’ স্টেশন চত্বরে রাখা হবে বিক্রি-বাটার জন্য। থাকবে স্থানীয় খাবার-দাবারের আয়োজনও। এছাড়া চালু করা হয়েছে টয়ট্রেনের নতুন এক পরিষেবা ‘হিম কন্যা’। দার্জিলিং থেকে কার্শিয়াং পর্যন্ত এই ট্রেন সপ্তাহান্তে অর্থাৎ শনি ও রবিবার চলবে।
আরও পড়ুন-দাবি, প্রতিবাদ, আমন্ত্রণে আদর্শ প্রশাসক জননেত্রী
‘ঘুম’ হল পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম আর হিমালয় তথা ভারতের উচ্চতম রেলওয়ে স্টেশন। ২,২৫৮ মিটার অর্থাৎ ৭,৪০৭ ফুট উচ্চতায় এর অবস্থান। একদিকে পাইন-ফার্নে ঢাকা রহস্যে মোড়া হিমালয় পর্বত, অন্যদিকে গভীর খাদ, টয়ট্রেনে চড়ে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করা চিরকালের আকর্ষণ। সিনেমা, গান, সাহিত্য কোথায় উল্লেখ নেই এর! তাই শুধু উৎসব-এর কারণেই নয়, যদি আপনি দার্জিলিং একাধিকবার গিয়ে থাকেন কিংবা দার্জিলিংয়ের পরিচিত ভিড় এড়িয়ে হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তাহলেও কিন্তু ‘ঘুম’ দারুণ একটা বিকল্প।
আরও পড়ুন-ওঁদের জমিতেই বিমানবন্দর অথচ ওঁরাই এখন বাস্তুচ্যুত!
অসংখ্য হোম স্টে আছে, স্থানীয়রা যেগুলিতে ভীষণ যত্নে আপনার দেখভাল করবে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করবে। পাশাপাশি প্রধান ও ছোট শহরগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভাল যে দার্জিলিং সহ অন্যান্য পাহাড়ি শহরগুলি ভ্রমণেও কোনও অসুবিধা হয় না। মূল শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘ঘুম’ দার্জিলিংয়ের ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক এবং আধ্যাত্মিক ইতিহাসকে এক সঙ্গে ধরে রেখেছে। ১৮৮১ তে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ট্র্যাক ‘ঘুম’-এ পৌঁছেছিল। তাই শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং থেকে টয়ট্রেনে ‘ঘুম’ যাত্রা পর্যটকদের অভূতপূর্ব এক অনুভূতি দেয়।
আর এই ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারেন শহর ঘুরলেও। এর অন্যতম হল ‘বাতাসিয়া লুপ’।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে নয়াচরে শুরু হল কাজ
এটি হল একটি সর্পিল খাড়া ট্র্যাক এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়েরও উজ্জ্বল নিদর্শন। টয়ট্রেনের রুট বরাবর তৈরি হয়েছিল এটি, চালু হয়েছিল ১৯১৯-এ। স্বাধীনতা আন্দোলনে শহিদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা সৈন্যদের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে এখানে। আছে ঘুম স্টেশন থেকে ৭০০ মিটার উচ্চতায় ‘ইগা চিলিং গোম্পা’ যা সুপরিচিত ‘ঘুম মনাস্ট্রি’ নামে। সুবৃহৎ ও অসাধারণ স্থাপত্যের এক বৌদ্ধ মৈত্রী মূর্তি আছে এখানে যা মুগ্ধ করবেই আপনাকে। ১৮৭৫-এ লামা শেরাব গ্যাটস এটি তৈরি করেন। আরও তিনটি মনাস্ট্রি আছে ঘুম-এ, কিন্তু এটি সবচেয়ে বড়। বাকিগুলি আছে সাক্যা চিলিং, চিলিং ও ফিন-এ। ‘দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে মিউজিয়াম’টিও ঘুরে দেখার মতো।
আরও পড়ুন-Subal Bhowmick: বিজেপির সন্ত্রাসের জবাব কাল ইভিএমে দেবেন ভোটাররা আত্মবিশ্বাসী সুবল ভৌমিক
প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস এখানে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া আছে ‘সোনচাল লেক’ যা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি একটি জলাশয়। ঘুম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দার্জিলিংয়ের প্রাচীনতম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে অবস্থিত এটি। বর্ষাকালে বন্ধ থাকলেও সেপ্টেম্বরের মাঝ থেকে খোলা থাকে। এখানে জঙ্গলের মধ্যে রেস্ট হাউসও আছে। থাকার জন্য দার্জিলিংয়ের ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশন-এ অগ্রিম যোগাযোগ করতে হয়। সবশেষে বাঙালির চিরদিনের নস্টালজিয়া ‘টাইগার হিল’-এর কথা বলতে হয় যা ঘুম থেকে ১১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
আরও পড়ুন-Soumen Roy: অসুস্থ হয়ে পড়লেন কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক সৌমেন রায়, ভর্তি হাসপাতালে
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা তো যায়ই আকাশ পরিষ্কার থাকলে, কোনও কোনওদিন এখান থেকে এভারেস্টও দেখা যায়। তবে এটি অনেকটাই লটারি মেলার মতো। কারণ ‘ঘুম’ মূলত মেঘের বন্ধু, সর্বদাই মেঘ পরিবৃত হয়ে থাকে কিংবা থাকে কুয়াশাচ্ছন্ন। তবু ‘ঘুম’ নিরিবিলি বেড়ানোর জন্য দারুণ।
করোনা-কালে মুখ থুবড়ে পড়েছিল পর্যটন শিল্প। দার্জিলিংও তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। দেড় বছর পরিষেবা বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি পুজোর মরশুমে আনাগোনা বাড়লেও তা আগের মানে নয়। ‘ঘুম’ উৎসবের আয়োজন পর্যটক আকর্ষণই। যাতে ক্ষতিপূরণ খানিক হলেও পুষিয়ে নেওয়া যায় এবং পর্যটকরাও একটা ব্যতিক্রমী ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা পান। সামনে ক্রিসমাস আর নতুন বছরের হাতছানি। এই উৎসবের হাত ধরে সেই সময় আরও পর্যটক সমাগম আশা করছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন নিগম।
আরও পড়ুন-ওঁদের জমিতেই বিমানবন্দর অথচ ওঁরাই এখন বাস্তুচ্যুত!
কীভাবে যাবেন?
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখান থেকে গাড়িতে ঘুম, সবচেয়ে পরিচিত রুট।
কোথায় থাকবেন?
‘ঘুম’-এ আছে অসংখ্য হোম স্টে। এছাড়া ‘ঘুম’ মনাস্ট্রিতেও থাকতে পারেন। তবে এর জন্য আগে যোগাযোগ করে রাখতে হবে।