বছর পঞ্চাশের পারমিতা। সচ্ছল পরিবারের গৃহবধূ। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। ঘরকন্নার সমস্ত কাজ প্রায় একা হাতেই সামলান। ভোরের পাখি ডাকার আগেই খোলেন চোখ। ছেলে-মেয়ের মর্নিং স্কুল। তাদের রেডি করা। ব্রেকফাস্ট। বরের অফিস। রান্না। সবকিছু সামলাতে সামলাতে বেলা গড়িয়ে যায়। নিজের পেটে দানাপানি দেওয়ার সময় পান না। বর অফিস বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই স্কুল থেকে ফিরে আসে ছেলে-মেয়ে। তাদের সামলাতে সামলাতে গড়িয়ে যায় দুপুর। তারপর সারেন নিজের স্নান খাওয়া। খাওয়া মানে কোনওরকমে নাকে-মুখে গোঁজা। শরীর বয় না আর। বিছানায় টানটান হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বেজে ওঠে অ্যালার্ম। ছেলে-মেয়ের কোচিং। মেয়ের সঙ্গে যেতে হয় তাঁকে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে। মোবাইল ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক কাপ চা। তারপর আবার রান্নাঘরে। বর অফিস থেকে ফেরেন। ডিনার। শুতে শুতে রাত।
আরও পড়ুন-নতুন বছরের নতুন প্রতিশ্রুতি
দশভুজা বলতে যা বোঝায়, পারমিতা মোটামুটি তাই। একা হাতে সবদিক সামলান। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। পারমিতার শুনতে বেশ ভালই লাগে। অথচ তিনি জানেন না অন্যদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কীভাবে নিজেকে অবহেলা করে চলেছেন তিনি। দিনের পর দিন। অথচ একটা সময় পরিপাটি থাকতেন। মেপে এবং মেনে চলতেন অনেক কিছুই। যাতে নিজেকে ভাল রাখা যায়। অন্যের চোখে এবং নিজের চোখে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার পর থেকেই আশ্চর্য একধরনের অলসতা এসে গেছে তাঁর মধ্যে। সেটা শুধুমাত্র নিজের জন্য।
শুধুমাত্র পারমিতাই নন, এই সমস্যা অনেকেরই। ঘরে ঘরে তাঁর মতো বহু মহিলা আছেন, যাঁরা মুখ বুজে সংসারের সব দায়-দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। নিজের প্রতি চরম অবহেলা করে। উদাসীন থেকে। না তাঁরা সময়মতো খাওয়াদাওয়া করেন, না ভাবেন নিজের শরীরের কথা। এটা মনে রাখেন না, নিজের প্রতি চরম উপেক্ষার ফলে তিনি যে-কোনও সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তাতে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাঁর নিজের সংসার। ফলে নিজের পুরনো অভ্যাসকে বিদায় জানাতে হবে। পুরনো বছরের সঙ্গে সঙ্গে। নতুন বছর শুরু করতে হবে নতুনভাবে। দাঁড়াতে হবে আয়নার সামনে। দেখতে হবে নিজেকে। অন্যদের পাশাপাশি ভাবতে হবে নিজের কথা। মনে রাখতে হবে— নিজেকে ভাল রাখা মানেই কিন্তু বিলাসিতা নয়। এটা অপরিহার্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেকে উপেক্ষা করা মানে সংসারের ভারসাম্য নষ্ট করা। শরীর, মন এবং আবেগের যত্ন নেওয়া হল জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখার চাবিকাঠি। তাই নিজের জন্য সময় দিতে হবে। ভাবতে হবে নিজের কথা। সময়মতো খাওয়াদাওয়া, ব্যায়াম, ধ্যান, পড়াশোনা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই ছোট্ট পরিবর্তন একদিন সত্যিই জীবনে বড় পার্থক্য গড়ে দেবে।
আরও পড়ুন-সাংসদের উদ্যোগে বেলুড়ের হাসপাতালে ইউএসজি মেশিন
রাগ পুষে রাখবেন না
ঘরে বাইরে আঘাত-অপমান-উপেক্ষায় জর্জরিত পরিমল। নিরীহ মানুষ তিনি। চুপচাপ থাকেন। দুঃখ-কষ্ট চেপে রাখেন মনে। প্রথম প্রথম আমল দিতেন না। কিন্তু পরে ভারী হয়ে আসতে থাকে বুক। গ্রাস করতে থাকে হতাশা। একটা সময়ের পর অন্যদের সঙ্গে কমিয়ে দেন কথাবার্তা, মেলামেশা। একাকিত্বের ঘেরাটোপে আবদ্ধ রাখেন নিজেকে। মনে মনে ভাবেন— এই বেশ ভাল আছি। কিন্তু সত্যিই কি এটা ভাল থাকা? আঘাত অপমানের পরিমাণ কিন্তু দিনে দিনে বেড়েই চলে। সবকিছু সহ্য করেন পরিমল। মুখ বুজে। রাগের প্রকাশ ঘটাতে পারেন না। ক্ষোভ চাপতে চাপতে তাঁর বুকে জমাট বাঁধে পাথর। হঠাৎ একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধরা পড়ে হৃদরোগ। এই অসুস্থতার পিছনে কিন্তু পরিমল নিজেই দায়ী। মুখ বুজে চুপ থেকে আঘাত-অপমান সহ্য করাই এর মূল কারণ। পরিমল যদি মুখ খুলতেন— তাহলে শারীরিক সমস্যায় পড়তে হত না। অর্থাৎ, নিজেকে ভাল রাখতে হলে মুখ বুজে না থেকে উগরে দিতে হবে মনের কথা। কষ্ট, মান অভিমান, রাগ। রাগ প্রকাশ মানেই কিন্তু কাউকে অপমান করা নয়। নিজের খারাপলাগাটুকু জানানো। বুকের ভিতর আগুন আছে— বুঝিয়ে দেওয়া। এতে কিন্তু সমস্যা মিটে যায়। আপাত খারাপ লাগা থাকলেও, একটা সময় দূর হয়ে যায় ভুল-বোঝাবুঝি। ক্ষোভ পুষে রাখা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। এতে মন অশান্ত থাকে। ক্ষোভ প্রকাশ করলে বুক হাল্কা হয়। জীবন হয় শান্তিপূর্ণ। যাঁরা ক্ষোভ পুষে রাখেন, তাঁদের পরামর্শ— পুরনো বছরের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় জানান এই অভ্যাসটি।
প্যাশনকে উপেক্ষা নয়
স্কুল-কলেজজীবনে মনোরঞ্জন দারুণ ছবি আঁকত। সুমিত্রা গাইত গান। প্রতাপ বোল তুলত তবলায়। উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করত বিমল। সুলেখা ছিল নৃত্যপটীয়সী। তারা স্বপ্ন দেখত ভবিষ্যতে নিজেদের শিল্পী সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার। কিন্তু পারেনি কেউই। পুরুষেরা কর্মজীবনে এবং মহিলারা সংসার জীবনে প্রবেশের পর গলা টিপে মেরেছে স্বপ্নকে। যদিও তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত। আর্থিক সচ্ছলতা আছে। তবু আজও কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যেই উঁকি দিয়ে যায় পুরনো দিনগুলো। আলমারিতে তুলে রাখা রং-তুলিতে হাত বোলাতে বোলাতে চোখ ভিজে যায় মনোরঞ্জনের। ধুলো পড়ে গেছে তবলায়— দেখে প্রতাপ হা-হুতাশ করে। বাপের বাড়ি গিয়ে বুকে ঘুঙুর জড়িয়ে চোখ বুজে বসে থাকে সুলেখা। হারমোনিয়ামের রিড ছুঁয়ে স্মৃতিমেদুর হয় সুমিত্রা। ছুটির দিনে সঞ্চয়িতা পড়তে ইচ্ছে হয় বিমলের। কিন্তু পারে না। বেরতে হয় বাজারের থলি থাকে। এটা ঘটনা— বদলে গেছে সময়, পরিস্থিতি। সবই ঠিক আছে। তবে নিজের প্যাশনকে উপেক্ষা করা উচিত হয়নি এদের। এরা প্রত্যেকেই কিন্তু প্যাশনকে উপেক্ষা করে নিজের প্রতি অন্যায় করেছে। এতে হারিয়েছে জীবন ভারসাম্য। আপনারও নিশ্চয়ই কোনও প্যাশন আছে। বাধ্য হয়েছেন সেটা ভুলে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ভুল করেছেন। ব্যস্ততা থাকুক। টাকাপয়সা উপার্জন করুন। সেইসঙ্গে নিজের প্যাশনকে বাঁচিয়ে রাখুন। পুরনো বছরের সঙ্গে সঙ্গে বিসর্জন দিন উপেক্ষা অবহেলাকে। নতুন বছর নতুন ভাবে শুরু করুন।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নে বদলে গিয়েছে জঙ্গলমহল
বাঁচতে হবে বর্তমানে
পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবন পর্ণা এবং সুবীরের। সুবীর একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চপদে আসীন। পর্ণা গৃহবধূ। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আছে। তবে সন্তানহীনতার কারণে তাদের জীবনে নেমেছে অশান্তির কালো ছায়া। মাঝেমধ্যেই রাগারাগি, ভুল বোঝাবুঝি হয়। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল পর্ণা। সুবীরের সঙ্গে ভালবাসার বিয়ে। তার আগে রজতের সঙ্গে ছিল অ্যাফেয়ার। রজতের জীবনে উচ্চাশা ছিল না। প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও, একটা সময়ের পর পর্ণা বুঝতে পারে রজতের সঙ্গে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। রজত আউট হতেই সুবীর ইন। অল্পদিনের মধ্যেই ছাঁদনাতলায়। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর। এখন পর্ণার মনে হয়— রজত ছিল তার জন্য পারফেক্ট। ছোটখাটো চাকরি করত সে। হয়তো তার সঙ্গে থাকলেই জীবনটা সুখের হত। সন্তান আসত কোলে। নির্জন দুপুরে একা একা এইসব ভাবতে থাকে পর্ণা। মনে মনে অনেক দূরে চলে যায় সুবীরের থেকে। ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে রজতকে খুঁজে পায়। বন্ধুত্ব পাতায়। অজানা স্রোতে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে। এমন স্রোত, যা কোনওদিন কোনও মোহনায় পৌঁছবে না।
বর্তমানে এ এক বড় সমস্যা। বিশেষত ছোট সংসারে। পর্ণার মতো অনেকেই এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। কেউ জেনে, কেউ না জেনে না বুঝে। এই ধরনের মানুষেরা অতীত এবং ভবিষ্যতে ডুব দিয়ে বাঁচে। তার জন্য বর্তমান মুহূর্ত থেকে দূরে সরে যায়। মনের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করে। নিজের জীবনকে ফেলে দেয় ভারসাম্যের বাইরে। ফলে নানারকম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তখন জন্ম নেয় অনুশোচনা, হতাশা। যাঁদের মধ্যে এই সমস্যা আছে, তাঁদের পরামর্শ— পুরনো বছরেই এই অভ্যাস ত্যাগ করুন। অতীত এবং ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমানে বাঁচুন। নতুন বছরে। দেখবেন জীবন কত সুন্দর। ফিরে আসবে স্বাভাবিক ভারসাম্য ও শান্তি।
হ্যাঁ এবং না
ঘরে এবং বাইরে সবকিছুতে ‘হ্যাঁ’ বলে রঞ্জন। ফলে মাঝেমধ্যেই ঘাড়ে এসে পড়ে অতিরিক্ত কাজের চাপ। বেশিরভাগ সময় সবকিছু সামলে নেয়। তবে কোনও কোনও সময় পেরে ওঠে না। তখন সমস্যায় পড়ে। শুনতে হয় কথা। মনখারাপ লাগে তার। ভাবে— এত কাজ করেও নাম নেই!
এই সমস্যা অনেকেরই। ঘটনা হল— সময় বড় প্র্যাকটিক্যাল। কী কী কাজ করলে কেউ দেখবে না। কতটুকু পারলে না সেটাই আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তাই নিজের সময় এবং সীমা বুঝে কমিট করতে হবে। অকারণ চাপ কমাতে প্রয়োজনে ‘না’ বলা অভ্যাস করতে হবে। মনে রাখতে হবে— কাউকে মুখের উপর না বলা মানেই কিন্তু অসম্মান করা নয় বা নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করা নয়। নিজের সীমা বুঝিয়ে দেওয়া। এতে উভয় পক্ষের লাভ। অতএব কথায় কথায় ‘হ্যাঁ’ বলার অভ্যাস বিদায় জানান পুরনো বছরের সঙ্গে সঙ্গে।
আরও পড়ুন-ইডির অফিস থেকে ঘুষের টাকা উদ্ধার করল সিবিআই
আবেগকে গুরুত্ব দিন
আবেগ নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আবেগ আছে। যাঁকে আপাত-কাঠখোট্টা মনে হয়, আবেগ আছে তারও। আসলে কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই আবেগের প্রকাশ ঘটায় না। দমন করে রাখে। এটা কিন্তু অনুচিত। এই অভ্যাস অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে আবেগকে। কারণ আবেগ নিজেকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে। তাই বলি অনুভূতিগুলিকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে, নিজেকে অনুভব করুন। মনে রাখতে হবে— আবেগ ভারসাম্য বজায় রাখে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও ভালভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করে।
স্বাস্থ্যকে অবহেলা নয়
সারাদিনের ব্যস্ততায় বহু মানুষ নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হতে পারে না। কাজ আর কাজ। সময়মতো খাওয়াদাওয়াও করতে পারে না অনেকেই। শুধু তো খাওয়াদাওয়া নয়, সুস্থ থাকার জন্য একটু শারীরিক কসরত প্রয়োজন। তার সুযোগ পায় না অনেকেই। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ। ঘুম হয় না পর্যাপ্ত। এইসব অভ্যাস সামগ্রিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং পর্যাপ্ত ঘুম উজ্জীবিত এবং স্থিতিশীল থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে পুরনো বছরের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যকে অবহেলা করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। নতুন বছরে বাঁচতে হবে নতুনভাবে। যত্ন নিতে হবে শরীরের।