রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগপত্র প্রত্যাখ্যান করে বহু প্রশ্ন তুলে দিলেন রাজ্যপাল (Governor- Election Commission)। প্রথম প্রশ্ন হল সেটা কি তিনি পারেন? যেহেতু এর আগে কোনওদিন এই ঘটনা ঘটেনি তাই প্রশ্নটা নতুন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদটি হল রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি এবং ক্রম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের পদের মতোই একটি সাংবিধানিক পদ। সাংবিধানিক এই পদাধিকারীদের অপসারণের ক্ষেত্রে ‘ইমপিচমেন্ট’ পদ্ধতি অবলম্বন করার বিধান সংবিধানে উল্লেখ করা রয়েছে। এই পদ্ধতি অনুসারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে অপসারণ করার বিধি হল রাজ্যপাল অভিযোগের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির কাছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের অপসারণের আবেদন জানাবেন, রাষ্ট্রপতি সেই আবেদন অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিযোগটি বিবেচনা করার নির্দেশ দিবেন, সুপ্রিম কোর্ট বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতিকে রিপোর্ট দিবে, সেই রিপোর্টে অভিযোগ যথার্থ প্রমাণ হলে রাষ্ট্রপতি লোকসভা এবং রাজ্যসভায় অপসারণের প্রস্তাব বিবেচনার জন্যে পাঠাবেন, সংসদের উভয় কক্ষে সেই প্রস্তাব দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অনুমোদিত হলে সংসদ তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন, রাষ্ট্রপতি তা রাজ্যপালকে জানাবেন এবং রাজ্যপাল অপসারণের সেই নির্দেশ রাজ্য সরকারকে জানাবেন। অর্থাৎ এটা বোঝা গেল যে এটি একটা দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে জটিল এবং দীর্ঘ করার একটাই কারণ যাতে সাংবিধানিক কোনও পদাধিকারীর উপর কোনওরূপ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা সম্ভব না হয় এবং ইচ্ছা অনুসারে তাঁদের অপসারিত করে কোনও পক্ষ তার সুফল লাভ না করতে পারে। রাজ্যপালের পদ সাংবিধানিক হলেও তাঁর অপসারণের ক্ষেত্রে এই বিধি প্রযোজ্য নয়। রাজীব সিনহার অপসারণের ক্ষেত্রে সংবিধানের নির্দেশকে মাননীয় রাজ্যপাল অনুসরণ করেছেন কি? যদি না করে থাকেন তা হলে তা কতটা বিধিসম্মত?
আরও পড়ুন- ডোমকলে সিপিএম মিছিল থেকে হামলা, শঙ্কাজনক অবস্থা চার তৃণমূলকর্মীর
এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, নিয়োগ প্রত্যাহার করে কি নিয়োগ বাতিল করা যায়? একবার নিয়োগ সম্পূর্ণ হলে সেটা প্রত্যাহার করাটা অপসারণের শামিল আর অপসারণ যেহেতু ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করে করা যায় না, তাই এই নিয়োগ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াটাই সম্পূর্ণ বেআইনি।
তৃতীয় প্রশ্ন হল, রাজীব সিনহার নিয়োগ কি সম্পূর্ণ হয়েছিল? যদি সেটা না হয়ে থাকে তাহলে রাজ্যপাল নির্বাচন কমিশনার হিসেবে রাজীব সিনহাকে সাক্ষাৎ করার জন্যে ডেকেছিলেন কী করে? যাকে রাজ্যপাল নিয়োগই করেননি তাঁকে কমিশনার হিসাবে কাজ করতে দিচ্ছিলেন কী করে? জ্ঞাতসারে এই অবৈধ কার্যকলাপকে চলতে দেওয়ার দায় নিয়ে সেক্ষেত্রে রাজ্যপালকেই তো তাহলে সবার আগে পদত্যাগ করতে হবে। নইলে তাঁকেই তো সবার আগে অপসারণ করা দরকার।
চতুর্থত, যদি আজ পঞ্চায়েত ভোটকে ঘিরে কোনও আইনগত বা সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয় তার দায় কার? নিজের নিযুক্ত করা ব্যক্তির নিয়োগ প্রত্যাহার করে যিনি এই সংকট সৃষ্টি করলেন তাঁকেই তো তার দায় নিতে হবে।
এবার আসল প্রশ্ন হল মাননীয় রাজ্যপাল এই অসাংবিধানিক চেষ্টাটা করছেন কেন? এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে তিনি সব বুঝে-শুনে এই অস্বাভাবিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন স্রেফ নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে বাধাপ্রাপ্ত করার জন্যই। কিন্তু কেন? উত্তরটি খুব সহজ, যাঁদের আঙ্গুলিহেলনে তিনি পদ খোয়াতে পারেন তাঁদের স্বার্থসিদ্ধি করতে তাঁদের নির্দেশে এই অসাংবিধানিক পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন। এই নির্বাচনে ব্যাপক হারে ত্র্যস্ত বিজেপি যেকোনও মূল্যে এই নির্বাচনকে ভণ্ডুল করতে চাইছে। কর্নাটকে ব্যাপক হারের পর এই রাজ্যের বিচ্ছিরি ফল কয়েকটি রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করবে। আগামী লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই জনমানসে প্রশ্ন ওঠে যাবে এবং দেশ জুড়ে তা সংক্রমিত হবে। তাদের পরাজয়ে উজ্জীবিত বিরোধীদের মোকাবিলা করাটা কঠিন হবে সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। এই রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট যে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে। এর সুদূর প্রসারী ফল জানা আছে বলেই রাজ্যপালকে (Governor- Election Commission) দিয়ে নির্বাচন পণ্ড করার চেষ্টা চলছে। প্রথম থেকেই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়াটিকেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। এরপর রাজীব সিনহার নাম প্রস্তাবিত হলে তিনি আরও নাম চাইলেন এবং তা পাওয়ার পরে সেই রাজীব সিনহাকেই মনোনীত করলেন। তিনি যদি রাজীব সিনহাকে অপছন্দই করে থাকেন প্রথমে তা হলে তাঁকেই পরে বেছে নিলেন কেন? আসলে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই বিলম্বিত এবং বাধাপ্রাপ্ত করতে চেয়েছেন এই নির্বাচনকে। নিয়োগ প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্তও একই উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। সংবিধানিক পদে বসে কেউ যদি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করার অনর্গল চেষ্টা চালায় তিনি আর যা-ই হোক পদে থাকার যোগ্য নন। সংবিধানের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংবিধানকে খুন করা যায় না।