সনাতন সমাজ যখনই আপন সংস্কার ভুলে বিভিন্ন কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে সেই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধর্ম সংস্কারক আবির্ভূত হয়েছেন এবং স্মরণ করিয়েছেন একাত্মতার, আধ্যাত্মিকতার মূল সূত্রগুলিকে। দক্ষিণ ভারতে ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে আবির্ভূত হয়েছিলেন আদি শঙ্করাচার্য।
আরও পড়ুন-মানুষের মন জয় করেই তৃণমূল ক্ষমতায় থাকতে চায় : ফিরহাদ
সেইসময় থেকেই ঈশ্বরের একটি রূপের প্রতি সমর্পণের মাধ্যমে যে ভক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা অন্তঃসলিলা রূপে কখনও সগুণ, কখনও নির্গুণ ঈশ্বরোপাসনার মাধ্যমে ভারতবর্ষকে আপন সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে শক্তি সরবরাহ করেছে। দক্ষিণ ভারতে ভগবান বিষ্ণু, শিবের প্রতি ভক্তি দিয়ে শুরু হয়ে, উত্তর ভারতে শ্রীরামচন্দ্র, পূর্ব ভারতে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তির মাধ্যমে ভক্তি আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। মহারাষ্ট্রে নামদেব, উত্তর ভারতে রামানন্দ, কবির, পূর্ব ভারতে শ্রীচৈতন্য ভক্তির মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য, কুপ্রথার বিনাশের চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন-গদ্দারের টিকিট কেলেঙ্কারি
উত্তর ভারতের সিন্ধ প্রদেশ আক্রমণকারীদের দখলে চলে যাওয়ার ফলে ভক্তি আন্দোলনকে আপন সংস্কৃতি থেকে কুপ্রথা দূর করার সাথেই প্রতিকূল পরিবেশে আপন সংস্কৃতি, দর্শন, জীবন পদ্ধতিকে টিকিয়ে রাখার ভার নিতে হল। কিন্তু বিধর্মীদের নৃশংসতা, ব্যক্তিগত উপাসনার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া বাড়তে থাকে এবং স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তকে আরব আক্রমণের নৃশংসতার সম্মুখীন হতে হয়। তাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ঈশ্বরোপাসনার অধিকার এই দুই শর্ত পূরণ হল ভক্তি আন্দোলন নির্গুণ ব্রহ্মের পথে চালিত হওয়ায়। আর সেই আবহেই গুরু নানকের আবির্ভাব।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে নয়াদিল্লিতে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী, তাজপুর প্রসঙ্গে স্পষ্ট করলেন অবস্থান
৩০ বছর বয়স থেকে গুরু নানক আধ্যাত্মিক শিক্ষাদান করতে শুরু করেন। আরবীয় সাম্রাজ্যবাদের আবহে পাঞ্জাব প্রদেশে ভক্তি আন্দোলনের নিরাকার ব্রহ্মোপাসনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও সমাজ সংস্কারের জন্য তিনি শিখ ধর্মের প্রবর্তন করেন এবং শিখ ধর্মের প্রধান তিনটি স্তম্ভ গঠন করেন— নাম জপ অর্থাৎ ঈশ্বরের নাম স্মরণ করা, কিরাত করা অর্থাৎ সৎ জীবন যাপন করা এবং ভান্ড চাকনা অর্থাৎ নিজের অর্থের কিছু অংশ সমাজের উদ্দেশ্যে দান করা এবং যাদের প্রয়োজন তাদের সাহায্য করা। তিনি শিখ সমাজে সামাজিক ভোজনপ্রথা অর্থাৎ ‘লঙ্গর’ ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন যা এখনও সমান উৎসাহে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রতিদিন সমাজের সর্বস্তরের লক্ষাধিক মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একসঙ্গে ভোজন করেন ও ভোজনের জন্য স্বেচ্ছায় সেবাদান করেন। নানকের মতে, ঈশ্বর এক এবং ঈশ্বরের কোনও আকার, বর্ণ, লিঙ্গ নেই অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনাই শিখ ধর্মের মূল মন্ত্র। গুরু নানক বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান যা ছান্দোগ্য উপনিষদের বাণী ‘‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”কে স্মরণ করিয়ে দেয়। সনাতনী পরম্পরার মতোই শিখ ধর্ম পুনর্জন্মবাদ, কর্মসংস্কারে বিশ্বাস করে। পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভকেই চরম লক্ষ্য মনে করতেন গুরু নানক এবং মোক্ষলাভের উপায় হল পুণ্যকর্ম ও আধ্যাত্মিক জাগরণ। সনাতন ধর্মে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও মাৎসর্যকে মানুষের ছয়টি শত্রু বা ষড়রিপু বলা হয়েছে। সেইরকমই শিখ উপাসনা পদ্ধতিতে লোভ, লালসা, ক্রোধ, অহং, আসক্তিকে ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
শিখ উপাসনা পদ্ধতির দার্শনিক ভিত্তি উপনিষদেই পাওয়া যায়। মান্ডুক্য উপনিষদের দুটি পাখির গল্প পাওয়া যায় যাদের মধ্যে একটি সাংসারিক সুখ ভোগ করে কিন্তু অন্য পাখিটি সাংসারিক সুখ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখে নির্বাণ লাভ করে— সেই একই উদাহরণ গুরু গ্রন্থ সাহিবেও পাওয়া যায়। গুরু গ্রন্থ সাহিবে মানবদেহেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের বাসের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ মান্ডুক্য উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি ব্রহ্ম’ মন্ত্রটিই যেন উচ্চারিত হয়েছে।
আরও পড়ুন-ভারত সেবাশ্রম সংঘের অতিথি নিবাসের ঘরের মেঝেতে মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার
ষোড়শ শতাব্দীর একদম গোড়ার দিকের কথা। তখনও নবদ্বীপ ছেড়ে পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেননি চৈতন্য। কৃষ্ণের আরাধনায় বিভোর হয়ে কাটাচ্ছেন দিন। সঙ্গে বৈষ্ণব আন্দোলন তো রয়েইছে। কথিত আছে, এই সময় নবদ্বীপে আসেন গুরু নানক। পূর্ব ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে নবদ্বীপে যখন উপস্থিত হলেন, চৈতন্যের সঙ্গে কি দেখা হয়েছিল তাঁর? স্পষ্ট কোনও প্রমাণ না থাকলেও, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি ঐতিহাসিকরা। কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তাঁদের? ধর্ম? না সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে? তা আজ আর জানার উপায় নেই। শুধু স্পষ্ট করে এটুকুই বলা যায়, যে-সময় নবদ্বীপে প্রবলভাবে বিরাজ করছেন চৈতন্য, ঠিক তখনই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক। শুধু নবদ্বীপেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ— সে-আমলের অখণ্ড বাংলার অনেক স্থানেই গিয়েছিলেন গুরু নানক, যা শুনলে অবাক লাগতে পারে আজ। হয়তো সে-আমলে কোনও কোনও জায়গার নাম আলাদা ছিল, পরবর্তীকালে এখনকার নাম পেয়েছে। কিন্তু তখনও যে জনপদগুলি বর্তমান ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুরু নানকের ভ্রমণপথ খেয়াল করলেই। বিহার হয়ে, ১৫০৪ সালে গুরু নানক প্রবেশ করেন বাংলায়। প্রথমেই যান রাজমহলে। সেখান থেকে, তাঁর পরবর্তী গন্তব্য মালদা। জনৈক ‘রামবাবু’র বাগানে তিনি কয়েকদিন কাটান।
আরও পড়ুন-পরিবেশবান্ধব সবুজ বাজির নতুন নীতি ঘোষণা, ক্লাস্টার গড়তে আর্থিক সাহায্য রাজ্যের
সেই বাগান আজ ‘গুরু কি বাগ’ নামে পরিচিত। মালদা থেকে, গঙ্গা পেরিয়ে মুর্শিদাবাদে এলেন নানক। তারপর নদিয়ায় প্রবেশ করেন তিনি। যান নবদ্বীপে। চৈতন্যের সঙ্গেও সাক্ষাৎও সম্ভবত তখনই। নবদ্বীপ থেকে কৃষ্ণনগর এবং সেখান থেকে বর্তমান বাংলাদেশে প্রবেশ করেন নানক। ফরিদপুর হয়ে পৌঁছন ঢাকায়। ঢাকা থেকে ধানপুর হয়ে ব্রহ্মপুত্রের তীর ধরে উত্তরদিকে এগোন নানক। মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ হয়ে অসমে প্রবেশ করেন তিনি। সিলেট ও করিমগঞ্জেও তাঁর উপস্থিতির কথা জানা যায়। অসমের পর, মণিপুর ও ত্রিপুরা হয়ে, চট্টগ্রামের পথ ধরে আবার বাংলায় প্রবেশ করেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, বাড়ব কুণ্ড ভ্রমণ করে, চাঁদপুর ও কেশবপুর হয়ে কলকাতায় হাজির হন তিনি। কলকাতা থেকে নানক হুগলি, ২৪ পরগনা, বর্ধমান, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় যান। বেশ কিছু অঞ্চল চিহ্নিত করা গিয়েছে, যেখানে নানক উপস্থিত হয়েছিলেন। সেগুলির মধ্যে দমদম, বারাসত, হাওড়া, শ্রীরামপুর, চন্দননগর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেদিনীপুরে, চন্দ্রকোনাতেও হাজির হয়েছিলেন তিনি। তারপর, মেদিনীপুরের পথে প্রবেশ করেন ওড়িশাতে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
কোনও নির্দিষ্ট একটা ধর্মের পরম সত্য বা এক ঈশ্বরের উপর একচেটিয়া অধিকার রয়েছে—শিখ ধর্ম এই দাবির ধারণাকে স্বীকার করে না। মূল বিশ্বাসের মধ্যে আছে এক স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস এবং সমস্ত মানবজাতির সমতা, সবার সুবিধা ও সমৃদ্ধির জন্য ন্যায়বিচারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং সৎ আচার ও জীবিকা। আর প্রতিটি ধর্ম এবং বিশ্বাসের মানুষের জন্য দরজা খোলা।
বর্তমান ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক অখণ্ডতা রক্ষায় গুরু নানকের মত ও তার দার্শনিক ভিত্তির পুনঃস্মরণ একান্ত জরুরি।