কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃষ্ণকলি কবিতাটি আর যাই হোক, কসমেটিক্স (Cosmetics) কোম্পানিগুলোর মোটেও পছন্দ হওয়ার কথা নয়। তারা কালো রাখতেই নারাজ। সকলকে ফর্সা বানানোর ঠেকা নিয়েছে বহুজাতিক কসমেটিক্স (Cosmetics) কোম্পানিগুলি। যদিও একান্তই ফর্সা বানানো না যায় তাতেই বা অসুবিধা কী, রং তো আছে। যাকে বলে মেকআপ। সেই রং দিয়ে সব ‘কৃষ্ণকলি’ই হয়ে যাবেন ধবধবে ফর্সা। কেবল কালো মেয়েরাই যে ফর্সা হওয়ার জন্য এমন মেকআপের আশ্রয় নিচ্ছেন তা নয়। পশ্চিমা দুনিয়ার সাদা চামড়ার মহিলারাও নানা মনোহরা রঙে সেজে উঠছেন।
মূলত তাঁদের রূপসজ্জার জন্যেই রঙের এমন বাহারি আয়োজন। তাদের জন্যেই কেমিক্যাল নির্ভর মেকআপের সামগ্রিক বাজার তৈরি হয় ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে। পশ্চিমি ব্যবসায়ীরা অচিরেই বুঝতে পারেন এই ব্যবসাকে কেবল পশ্চিমে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। তা ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্ব জুড়ে। তারা এগিয়েছে ধাপে ধাপে। আজ বিশ্ব জুড়ে চলছে রঙের মারণ খেলা। এই কসমেটিকসগুলির (Cosmetics) অধিকাংশই বিষে ভরা। কেবল মেয়ে কেন, আজকাল বহু ছেলেও ফর্সা হওয়ার ক্রিম মেখে হ্যান্ডসাম হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। আজকাল বাজারে তাই পুরুষদের ফেয়ারনেস ক্রিমেরও কমতি নেই।
সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেন, এগুলি এত মারাত্মক হবে কোন যুক্তিতে? ধুলেই তো সব উঠে যায়। তেমনটা হলে ভালই হত। কিন্তু তা হয় না। বিষ চলে যায় শরীরের ভিতরে। তারপর এমন সব কাণ্ড করে যা সাধারণের কল্পনার অতীত। তাতে হরমোনের ভারসাম্য পর্যন্ত নষ্ট হতে পারে৷ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ধীরে ধীরে শরীরে বাসা বেঁধে ক্যানসারের মতো অসুখের কারণ পর্যন্ত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’তে গবেষকরা জানিয়েছেন, সেই ভয়ঙ্কর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলি যৌগিক পদার্থের যে শ্রেণিতে থাকে, তার নাম ‘পলিফ্লুরো অ্যালকাইল সাবস্ট্যান্সেস’ (পিএফএএস)। এগুলি ফ্লোরিনঘটিত যৌগ। প্রসাধনসামগ্রীর মাধ্যমে একবার তা ত্বকে এলে বা মানবশরীরে ঢুকে পড়লে দেহের ভিতরে থেকে যায় দীর্ঘদিন। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তারা রয়ে গিয়েছে শরীরে। যদি কোনওভাবে সেগুলি মানবদেহ থেকে বেরিয়েও আসে, তা হলেও তা প্রকৃতি ও পরিবেশে থেকে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। ওই বিষাক্ত পদার্থগুলির কোনও ক্ষয় নেই। তার কাজ কেবল প্রকৃতির ক্ষতি করা। ।
গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, লিপস্টিক, গ্লসেস-সহ ঠোঁটে মাখার যাবতীয় প্রসাধন সামগ্রীতে পিএফএএস গোত্রের পদার্থ থাকে কম করে ৫৫ শতাংশ। তরল লিপস্টিকে ৬২ শতাংশ। ফাউন্ডেশনগুলিতে ৬৩ শতাংশ। সব ধরনের মাস্কারায় ৪৭ শতাংশ আর ওয়াটারপ্রুফ মাস্কারায় ৮২ শতাংশ।
দেখা গিয়েছে, দৈনিক ভিত্তিতে পুরুষ সাধারণত ছ’ধরনের ব্যক্তিগত প্রসাধনী (Cosmetics) ব্যবহার করলেও মহিলারা গড়ে ১২টি ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন তরুণীরা। রূপচর্চার জন্য নানা প্রসাধনীসামগ্রী ব্যবহার করেন এমন আঠারো থেকে চুয়াল্লিশ বছর বয়সিদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করা হয়৷ কোনও ক্রনিক রোগ নেই, এমন ১৪৩ জন মহিলার মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করা হয়৷ তাঁরা কী কী প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার করেন তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়৷ তাদের সংগৃহীত মূত্রের পরীক্ষা করে দেখা যায়, ক্রমাগত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনী যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের মধ্যে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা মিলেছে। যা তাঁদের শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, ক্ষতিকর প্রসাধনী (Cosmetics) সামগ্রী নারীদের শুধু হরমোনজনিত সমস্যাই সৃষ্টি করে না, এটি আরও নানাভাবে ক্ষতি করে। তা মস্তিষ্কের সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি ও ক্যানসার কোষের বৃদ্ধির মতো সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
কথাতেই আছে ‘পহলে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারি’। মানুষের এই ভাবনাকেই কাজে লাগিয়ে নেমে পড়ছে বহুজাতিক প্রসাধন কোম্পানিগুলি। তারা বলছে আপনি সুন্দর নন তো কী হয়েছে! আমরা আপনাকে সাজিয়ে এমন বানিয়ে দেব যে বহু সুন্দরীও আপনাকে দেখে ঈর্ষা করবে। তার চক্করে পড়ে মারাত্মক সব রাসায়নিক ব্যবহার বাড়ছে। দেখে নেওয়া যাক ক্ষতিকারক রাসায়নিকগুলির একটি অতি সংক্ষিপ্ত তালিকা।
সালফেট : কসমেটিক্সে (Cosmetics) যেসব কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে প্রথমেই নাম আসে সালফেটের। সালফেট হল সার্ফ্যাক্ট্যান্ট, এটি তেল এবং জল উভয়কেই আকর্ষণ করে। এটি ত্বক এবং চুল থেকে সহজেই ময়লা ধুয়ে ফেলতে সাহায্য করে। সালফেট মূলত ডিটারজেন্ট। তাই তা ত্বককে এবং চুলকে যেমন রুক্ষ করতে পারে তেমনি তা জলকেও দূষিত করে।
আরও পড়ুন-ভোলবদলের রূপটান
প্যারাবেন : এটি হল জেনোস্ট্রোজেন। অর্থাৎ মানবদেহে বিদ্যমান হরমোনের মতোই এর রাসায়নিক গঠন। মূলত শ্যাম্পুতে জল থাকার কারণে এগুলোতে সহজে ব্যাকটিরিয়া বা ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। তাই শ্যাম্পু লং লাস্টিং করার জন্য প্রিজারভেটিভ হিসেবে শ্যাম্পুতে প্যারাবেন ব্যবহার করা হয়। প্যারাবেন মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদনে সমস্যা তৈরি করতে পারে। যার ফলে এটি তাদের প্রজননজনিত ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ট্যালক : সবচেয়ে নরম খনিজ হল ট্যালক যা সাধারণত ট্যালকম পাউডার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মূলত পাউডার বিশেষ করে বেবি পাউডার তৈরিতে এটি ব্যাবহৃত হয়। ট্যালক-যুক্ত পণ্যের ক্রমাগত ব্যবহার মহিলাদের জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
পিএইচ ফ্যালেট : এই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ প্লাস্টিক উৎপাদনেও ব্যবহৃত হয়। মানবদেহে এই রাসায়নিকের প্রভাব অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। ফ্যালেট মানবদেহের বিভিন্ন গ্রন্থির ক্ষরণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যাতে বিগড়ে যেতে পারে হরমোনের ভারসাম্য। পাশাপাশি এই ধরনের পদার্থ ডেকে আনতে পারে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিও। মূলত নেলপালিশ, চুলের স্প্রে ও মুখে মাখার ক্রিমে এই পদার্থটি ব্যবহৃত হয়।
টলুইন : এটি একটি পেট্রোকেমিক্যাল জাতীয় পদার্থ। সাধারণত নেলপালিশ তোলার জন্য যে থিনার ব্যবহার করা হয়, তাতেই থাকে এই রাসায়নিক পদার্থটি। লিভারের জন্য এই পদার্থটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই রাসায়নিক পদার্থটি ডেকে আনতে পারে মস্তিষ্কের সমস্যাও।
কার্বন ব্ল্যাক : সাধারণত কাজল ও অন্যান্য কালো রঙের প্রসাধনীতে যে কালচে রং থাকে, তা উৎপন্ন হয় কার্বন ব্ল্যাক বা সমতুল্য কোনও পদার্থ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কার্বন ব্ল্যাক উপেক্ষা করে চলাই ভাল। বিশেষত চোখের ক্ষেত্রে কার্বন ব্ল্যাক যুক্ত পদার্থের ব্যবহার একেবারেই উচিত নয়। । কারণ এতে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পলিইথিলিন : যে সকল চুলের রং ও রূপটানের সামগ্রী আর্দ্র ঘন ক্রিমের মতো হয়, সেই সব প্রসাধনীতে সাধারণত এই উপাদানটি থাকে। এই সব প্রসাধনীতে (Cosmetics) থাকা উপাদানগুলি যাতে খুব সহজেই ত্বকের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে তাই তার সঙ্গে পলিইথিলিন জাতীয় পদার্থ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই রাসায়নিকের প্রভাবে ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া এই ধরনের পদার্থ ক্যানসার ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। কাজেই দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
ভারী ধাতু : দস্তা, পারদ, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি, জিঙ্ক কিংবা ক্রোমিয়ামের মতো ধাতুগুলি বহু প্রসাধন সামগ্রীতেই দেখা যায়। বিশেষত লিপস্টিক, দাঁত সাদা করার পদার্থ, আইলাইনার, নেলপলিশ ও ডিওডেরান্টে এমন ধরনের ধাতু ব্যবহার করা হয়।
এই ধাতুগুলি শরীরে তীব্র বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। লিভারের অসুখের পাশাপাশি এই ধাতুগুলি অবাঞ্ছিত গর্ভপাত ও বন্ধ্যত্ব ডেকে আনতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিতে ঘটতে পারে বিলম্ব। এমনকী এই ধাতুগুলি কাজ করতে পারে নিউরোটক্সিন হিসেবেও।
প্যারাফিন : ক্রিম, লোশন বা সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয় পেট্রোলিয়াম থেকে জাত এক ধরনের উপাদান, যার নাম প্যারাফিন। এটি ত্বককে মসৃণ করতে সাহায্য করে। প্যারাফিনের বেশি ব্যবহার ত্বকের কোষ ধ্বংস করে।
অ্যালকোহল : বডি লোশন, ক্রিম, আফটার শেভ লোশন, চুলে দেওয়ার রং, মাউথওয়াশ-সহ বহু কসমেটিক্সেই অ্যালকোহল ব্যবহৃত হয়। অ্যালকোহল ব্যবহারের ফলে চামড়া বা চুল শুকিয়ে যায়। রূপজীবীদের পেলব ত্বক, বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ঝাঁ-চকচকে প্রচার এড়িয়ে সব জেনেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বহু মহিলা। এমনকী যাঁরা মিডিয়াতেও বসে এর বিপজ্জনক দিকের কথা শোনাচ্ছেন, তাঁর মুখও মেকআপে চকচক করে। তরুণী ও যুবতীরা সবথেকে বেশি মেকআপ ব্যবহার করেন। প্রেমে পড়লে তো কথাই নেই। রূপ দিয়ে অন্যকে মুগ্ধ করার তাগিদ দুই পক্ষের ভিতরেই প্রবল হয়ে ওঠে। বাড়ে প্রসাধনের ব্যবহার। যাঁরা এমন অবস্থায় পড়েছেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন, মনে মনে গেয়ে উঠতে পারেন—
আরও পড়ুন-কেয়ার অব শীত
‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।
আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব॥
ভরাব না ভূষণভারে, সাজাব না ফুলের হারে—
প্রেমকে আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাব॥