ঋতুপর্ণা রুদ্র
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল তিথি। ছোট ছোট কালো বুটি দেওয়া সাদা টাঙাইল শাড়ি পরেছে আজ, সঙ্গে সাদা লম্বা হাতা ব্লাউজ। গলায় সোনার চেনে ছোট্ট লকেট আছে একটা আর দুই কানে ছোট দুটো মুক্তো দানা। তিথি চুলে রং করা পছন্দ করে না, চুল কমেও এসেছে অনেক। কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে রুপোলি রেখা ঝিলিক দিচ্ছে তাই। মুখের চামড়ায় সময় নিজস্ব ছাপ ফেলে গেছে, তবুও ব্যক্তিত্বের সৌরভ তো থাকেই।
আরও পড়ুন-আজ যোগদান-সহ তৃণমূলের প্রতিবাদসভায় মন্ত্রী, সাংসদ
অনেক বছর বাদে আজ জেলা কোর্টে সওয়াল করতে যাচ্ছে সে। অনভ্যাসের ফলে আত্মবিশ্বাসে সামান্য চিড় ধরেছে যেন। অথচ ল পাশ করার পরে তিথি যখন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট বিশ্বজিৎ বসুর টিমে কাজ করত, সবার চেয়ে বেশি স্যার তাকেই ভরসা করতেন। তিথি পড়াশোনা করত প্রচুর, স্যারের প্রত্যেকটা মামলার ব্রিফ হাতের কাছে গুছিয়ে দিত। নোটস তৈরি করে দিত। তারপর স্যার তাকে দু’একটা মামলায় সওয়াল করতে দিতেন। তিথির শানিত যুক্তির সামনে, বিপক্ষের বাঘা উকিলরাও কথা খুঁজে পেত না। স্যার পাশে থেকে সমানে উৎসাহ দিতেন।
আরও পড়ুন-বিপন্ন আমার দেশ, স্বদেশের সংবিধান
ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিতে নিতে আপনমনেই হাসে তিথি। আদালতের বাইরে কবে আর তিথির কথা কেউ মন দিয়ে শুনল। বাপের বাড়ি হোক বা শ্বশুরবাড়ি, কখনওই সে মুখ খুলতে পারেনি, বলতে পারেনি নিজের কথা, নিজের যুক্তি। বাবা মারা যাবার পরে তিথির টাকাতেই তখন সংসার চলছে, অথচ মা তিথির বিয়ের চিন্তায় সদা উচাটন। তিথির পরে আরও এক ভাই আর এক বোন ছিল। বোনের হঠাৎ করেই ভাল বিয়ের সম্বন্ধ আসে একটা। মা রাজি হয়নি, বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে।
আরও পড়ুন-দুটি অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ
ভাই একটা চাকরি পেতেই মা তিথির বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগল, বিশ্বজিৎ স্যারকেও গিয়ে ভাল পাত্র দেখে দিতে অনুরোধ করেছিল। স্যারই উৎপলের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করে দিয়েছিলেন। তিথিকে ডেকে বলেছিলেন,‘‘উৎপল আমারই এক বন্ধুর ছেলে। আইন পাশ করে চাকরি করছে, পরে নিজে প্র্যাকটিসও করতে পারে। ভাল পরিবার, তুমি সুখী হবে।’’ সম্মতি জানানো ছাড়া তিথির উপায় কিছু ছিল না। পুরনো স্মৃতি নিয়ে আর কতদিন বসে থাকা যায়। দু’মাসের মধ্যেই তিথি আর উৎপলের বিয়ে হয়ে যায়।
উত্তর কলকাতা ছেড়ে তিথি চলে আসে যাদবপুরে, উৎপলদের ভাড়া বাড়িতে। সেই বাড়িতে দু’টি ঘর আর থাকার লোক পাঁচজন। বসার জায়গার একপাশে সোফা সরিয়ে বিছানা করে রাতে তিথির দেওর শোয়। তিথির ঘরটিতে খাট, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি রাখার পরে আর একটুও জায়গা ছিল না। আইনের বইগুলো কোনওমতে একধারে পড়ে রইল।
আরও পড়ুন-ফের বিজেপির নোংরা চক্রান্ত, তোপ মহুয়ার
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিথির আবার নিজের দুর্ভাগ্যের কথা মনে হয়েছিল।
বাবা বেঁচে থাকতে তিথির বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। গুরুজনেরা দেখে পছন্দ করার পরে, পাত্র নিজে এক বন্ধু সহ তিথিকে দেখতে এসেছিল। তিথি তখন কলেজের প্রথম বর্ষ, পরম রূপবান পাত্রকে দেখে, সে মুহূর্তে হৃদয় হারায়।
নিরিবিলিতে কয়েক মিনিট কথাও বলেছিল তারা। তারপর বিয়ের দিনক্ষণ ফাইনাল হয়ে গেছিল। কার্ড ছাপা, বেনারসি কেনা থেকে গয়না গড়ানো সবই যখন হয়ে গেছে, তখন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।
বাবা সন্ধেবেলা বাড়িতে ফিরে বলেন, ‘‘এ বিয়ে হবে না। আমি সব ক্যানসেল করে এসেছি।’’ কথাটা শুনে তিথির মা বজ্রাহত, তিথির হৃদয় মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। তার কিছুক্ষণ আগেই, তিথি বইয়ের ভাঁজে রাখা একখানি ছবির উপরে ঝুঁকে পড়ে মনে মনে আদর করছিল, গল্প করছিল, অকস্মাৎ সমস্ত স্বপ্ন যেন কেউ হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে দিল। মা বলেছিলেন,‘‘তুমি কি পাগল হয়েছ? আর দু’সপ্তাহ বাদে মেয়ের বিয়ে, আর তুমি কি না…।’’
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বাবা বলেছিলেন, ‘‘যা বোঝ না, তাই নিয়ে তর্ক কোরো না। বিয়ের কার্ড ছাপা হয়ে যাওয়ার পরে, আজ ওরা আমাকে ডেকে বলছেন, মেয়ে যখন গান জানে তখন একটা নতুন হারমোনিয়াম দেবেন।’’
মা থতমত খেয়ে বলেছিলেন, ‘‘একটা হারমোনিয়াম শুধু? সেটা তো আমরা দিতেই পারি। তার জন্য সম্বন্ধ ভাঙতে হবে কেন?’’
‘‘না পারি না’’, গর্জে উঠেছিলেন বাবা। ‘‘অত বড়লোক পরিবার, আমাদের কাছে চাইছে কেন? তুমি জানো না, এইভাবে শুরু হয়। বিয়ের পরে আরও জিনিস চাইবে ওরা। বলবে এটা দিন, সেটা দিন। এখানে আমি মেয়ের বিয়ে দেব না। অন্য সম্বন্ধ খুঁজছি।’’
আরও পড়ুন-কাশ্মীরে ধৃত ২ জঙ্গিই মোদির দলের সদস্য!
মা, তিথি কারওর কোনও কথা শোনেননি বাবা, বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন। ছেলেটিকে যদিও ভুলতে পারেনি তিথি। বাবাও অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে উঠতে পারেননি, দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। এর এক বছর বাদে বাবা মারা যান। তারও তিন বছর বাদে উৎপলের ঘরণী হল তিথি।
বিয়ের কিছুদিন বাদেই শুরু হল অশান্তি। উৎপলের মা কোনওদিনই তিথিকে পছন্দ করতে পারেননি, তিথির বাইরে কাজ করায় তাঁর তীব্র আপত্তি। অশান্তি চরমে উঠলে উৎপল স্ত্রীকে বোঝায়, বাইরের কাজ ছেড়ে সংসারে মনোনিবেশ করতে। আদালতে যার শানিত যুক্তি প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করত, সেই তিথি, স্বামী বা শাশুড়ি কাউকেই কিছু বোঝাতে পারেনি। অগত্যা, বাইরের কাজ ছেড়ে সংসারে মন দিল তিথি, মেয়ে হল তার। পরবর্তীকালে উৎপল যখন স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস শুরু করে, তখন তিথি অবশ্য ঘরে বসে মামলার কাজে প্রচুর সাহায্য করে দিত স্বামীকে।
দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। শাশুড়ি মারা গেলেন, মেয়ে অনন্যার ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে অনন্যা এখন চাকরি করছে বেঙ্গালুরুতে। মাস দুয়েক আগে প্রায় ছ’মাস লিভারের সমস্যায় ভুগে মারা গেছে উৎপল।
বাধ্য হয়ে এত বছর বাদে উৎপলের হাতে যে কেসগুলো ছিল সেগুলো দেখভাল করছে তিথি। কেসগুলো ছেড়ে দিলে মক্কেলরাও বিপদে পড়বে, টাকাপয়সাও আর পাওয়া যাবে না। তিথিরও বার কাউন্সিলে রেজিস্ট্রেশন করানো আছে, মামলা সে লড়তেই পারে। মামলাটা হচ্ছে কৃষ্ণনগর জেলা আদালতে। ভোর ভোর বেরিয়ে এগারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেল তিথি। মামলা এজলাসে উঠবে বেলা বারোটায়। তিথি বাদীপক্ষের উকিল, পণের দাবিতে অত্যাচারের মামলা।
আদালতে কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল তিথি, জজসাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
আরও পড়ুন-নয়ডায় গাড়িতে আগুন, ঝলসে মৃত ২ আরোহী
মনপ্রাণ ঢেলে সওয়াল করল তিথি। এই কুপ্রথা কত সম্পর্ক যে ভেঙে দেয়, কত মেয়ের জীবন নষ্ট করে দেয়, সেকথা বলতে বলতে আবেগে ভেসে গেল। তাঁর কথায় সমগ্র আদালত কক্ষ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। বিপক্ষের উকিলের যুক্তিগুলো খুবই পলকা শোনাচ্ছিল। জজসাহেবের মুখ দেখে মনে হল, তিথির কথায় খুবই ইমপ্রেসড হয়েছেন। উনি জানালেন, সমাজের এই কলুষ, এই পণপ্রথা বহু মেয়ের জীবন নষ্ট করে। সাতদিন পরে এই মামলার রায় ঘোষণা হবে।
মেয়েটির বাবা এবং কাকা অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানালেন তিথিকে। বললেন, ‘‘ম্যাডাম কী সুন্দর কথা বলেন আপনি, উৎপল স্যারের থেকেও অনেক ভাল।’’ তিথি হেসে, নমস্কার করে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। একটা গাড়ি নিয়ে এসেছে, ওই গাড়িতেই ফিরে যাবে। খেয়াল করল পাশ থেকে আর একটা সাদা গাড়ি এসেছে, তাতে উঠে যাচ্ছেন জজসাহেব। তিথিকে দেখে এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক, ঈষৎ হেসে নমস্কার করে বললেন, ‘‘আপনাকে কি আগে কোথাও দেখেছি? খুব চেনা চেনা লাগছিল আজ।’’
আরও পড়ুন-কৌশাম্বীতে নাবালিকা ধর্ষিতাকে কুঠার দিয়ে খুন, পুলিশের গুলিতে আহত অভিযুক্ত
তিথি প্রতিনমস্কার করে জানায়, ‘‘না তো, আমি এই আদালতে প্রথম এলাম।’’ জজসাহেবের গাড়ি বেরিয়ে যাবার পরে চোখের কোণে দু’ফোঁটা জল আর ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটে ওঠে তিথির। অনেক বছর আগে এক সন্ধ্যায়, নিভৃতে, দু’টি অল্পবয়সি ছেলেমেয়ের আলাপচারিতার কথা মনে পড়ে। একটা হারমোনিয়াম কতদিন আগেই তো চেনা মানুষটাকে অচেনা করে দিয়েছিল। আজ আর তিথি হ্যাঁ বলে কী করে।
অঙ্কন : শংকর বসাক