আজ ১১ ডিসেম্বর, সাহিত্যিক সমরেশ বসুর জন্মদিন। লিখেছেন কালকূট নামেও। কিংবদন্তি এই সাহিত্যিকের ব্যক্তি-জীবন, লেখক-জীবন কেমন ছিল, জানালেন গতকাল নিজের জন্মদিন পালন করা সমরেশ-পুত্র সাহিত্যিক নবকুমার বসু। শুনলেন অংশুমান চক্রবর্তী
কিংবদন্তি সাহিত্যিক সমরেশ বসু আপনার বাবা। ছোটবেলায় তাঁকে কীরকম দেখেছেন?
অনেকের কাছে সাহিত্যিক সমরেশ বসু কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তবে আমার কাছে তিনি শুধুই বাবা। আমার বয়স এবং আমার বাবার সাহিত্যচর্চার বয়স মোটামুটি একই। জন্ম থেকেই দেখেছি তিনি লেখালেখি করেন। মায়ের মুখে শুনতাম ‘তোদের বাবা একজন লেখক’। কিন্তু লেখক বিষয়টা যে কী, তখন ঠিকমতো বুঝতাম না। বাবাদের সম্পর্কে সন্তানদের কাছে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি করে দেন মায়েরাই। যেমন আমার মা করেছেন। সাহিত্যকেই পেশা হিসেবে নেবেন, বাবা যখনই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন মা পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। সেটা রীতিমতো ভেবে-চিন্তেই। তখন আমরা চার ভাইবোন। দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। তার মধ্যেই মুখ গুঁজে লিখে গেছেন বাবা। ধীরে ধীরে মেলে ধরেছেন নিজেকে। একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘আদাব’’-সহ তাঁর বিভিন্ন গল্প। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পটভূমিতে দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের চরিত্র নিয়ে লিখেছেন আদাব। এক অসামান্য গল্প।
আরও পড়ুন-পরশপাথর
চাকরি। কারাবাস। ফিরে এসে লেখালিখি। সাহিত্যের হাত ধরে ওঁর নবজন্ম হয়েছিল বলে মনে হয়?
অবশ্যই। নবজন্ম তো বটেই। জেলে থাকার সময়ই একটি উপন্যাস লিখেছিলেন বাবা। বাকি জীবন সাহিত্যকে অবলম্বন করে বাঁচার সিদ্ধান্তটা সম্ভবত জেলখানায় বসেই নিয়েছিলেন। উনি ছিলেন মাল্টি ট্যালেন্টেড। কেউ কেউ এইরকম বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মান। যে-কোনও দিকেই তাঁরা সাফল্য পেতে পারেন। অসাধারণ বাঁশি বাজাতেন বাবা। থিয়েটার করতেন। ছবি আঁকতেন। জেলে বসে তিনি মায়ের একটি ছবি এঁকেছিলেন। এক কথায় এক্সিলেন্ট।
আরও পড়ুন-বিস্ময় বালিকা
এই সৃজনচর্চা কি শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন?
না। সেটা করেননি। একটা সময় শুধুমাত্র সাহিত্যচর্চাকেই বেছে নিয়েছিলেন। কঠিন ছিল সেই সিদ্ধান্ত। তবে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন এবং সাফল্য পেয়েছেন। বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। তারপর একে একে আমাদের জন্ম হয়। তখন আমরা আতপুরে। পরে উঠে যাই নৈহাটিতে। ততদিনে বাবা পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন। এক কামরার ঘরে আমরা সবাই। তার মধ্যেই বাবা জলচৌকি পেতে লিখতেন। বাবার লেখার সময় মা আমাদের বলতেন, ‘আস্তে কথা বলো। ওঁর যেন কোনও অসুবিধা না হয়।’ লেখালেখির সময় বাইরের কাউকে অ্যালাউ করা হত না।
আরও পড়ুন-কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলার মতো বাংলাদেশেও হতে পারে কলকাতা বইমেলা
কোন সময় লিখতেন?
সকাল থেকে। টানা বারোটা-সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। তারপর স্নানখাওয়া, কিছুটা বিশ্রাম। আবার বসতেন লিখতে। ছটা সাড়ে ছটা পর্যন্ত। প্রতিদিন। একদিনও এর অন্যথা হয়নি। তার মধ্যেই করতেন পড়াশোনা। সোম, বুধ, শুক্র, সপ্তাহে তিন দিন আসতেন কলকাতায়। সাহিত্য মহলে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে যোগাযোগ। কিছু ক্ষেত্রে পেয়েছেন দুর্ব্যবহারও।
সংসারে কতটা সময় দিতেন?
সংসারে ভালই সময় দিতেন বাবা। ওঁর ছিল রুটিন বাঁধা জীবন। লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তার মধ্যেও সময় দিতেন সন্তানদের। হইহুল্লা করা, ঘাড়ে-কাঁধে চড়া, গঙ্গায় সাঁতার কাটা সবকিছুই করেছি বাবার সঙ্গে।
আরও পড়ুন-পেনাল্টি মিস করে ইংল্যান্ডকে ডোবালেন কেন
‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’র জন্মবৃত্তান্ত জানতে চাই…
বাবা চাইতেন নিজের দেশটাকে চিনতে, জানতে। তাই একটা সময় যেতে চাইছিলেন কুম্ভ মেলায়। সেই সময় বাবার আলাপ হয় মনোজ বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মনোজ বসু ওঁকে যুগান্তরে যেতে বলেন। তবে ওই পত্রিকার পক্ষ থেকে উৎসাহ দেখানো হয়নি। পরে বাবা যোগাযোগ করেন আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে। তার আগেই ওই হাউসে লেখা শুরু করেছেন। কানাইলাল সরকার তখন আনন্দবাজারের অনেকগুলো বিভাগ দেখাশোনা করতেন। ছিলেন সাগরময় ঘোষও। বাবা ওঁদের বলেন, ‘আমি কুম্ভ মেলায় যেতে চাই। আপনারা সহযোগিতা করুন।’ বাবাকে হতাশ করা হয়নি। সবুজ সংকেত পেয়ে বাবা বেরিয়ে পড়েন। এইভাবেই শুরু হয়ে যায় ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’। বেরত আনন্দবাজারে। কুম্ভ মেলা থেকে ফিরে আসার পরে বাবার মনে হয়েছিল, লেখাটার আরও কিছু বাকি থেকে গেল। বাবার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে বাকি অংশ দেশ পত্রিকায় লেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে বেরোয় ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’। সেই সময় থেকে ওঁদের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক স্থায়ী হয়। লেখার চাপ বাড়তে থাকায় একটা সময় নৈহাটি ছেড়ে বসবাস শুরু করেন কলকাতায়।
চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন?
আরও পড়ুন-আজ পরীক্ষা দেবেন ৬,৯০,৬৩২, টেট বানচালে চক্রান্ত চলছে, অভিযোগ পর্ষদ সভাপতির
পেয়েছিলেন প্রস্তাব। তবে বাবা রাজি হননি। উনি শুধুমাত্র লিখতে চেয়েছিলেন। দুই পক্ষের মধ্যে মিউচুয়াল রেস্পেক্ট ছিল।
কতটা বাউল মনের অধিকারী ছিলেন উনি?
ওপর ওপর বোঝা না গেলেও ভেতরে ভেতরে বাউল মন ছিল ওঁর। বাবা কোনও দিনই গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি। বেরিয়ে পড়তে চাইতেন। কালকূটের লেখার মধ্যে সেটা আরও স্পষ্ট হয়। সমরেশ বসু এবং কালকূট একই মানুষ। তবে ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন। কালকূটের মধ্যে ছিল প্রকৃতি মুগ্ধতা, মানুষকে দেখার এবং চেনার আগ্রহ। শরীরের বয়স বাড়ালেও, মানসভ্রমণে বেরনোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যেত। হয়তো মানুষটা বসে একটা জায়গায়। অথচ মনে মনে ভ্রমণ করছেন বহু দূরে। জন্ম হচ্ছে লেখার। সেখানে পুরাণ আসছে, ইতিহাস আসছে, রাজনীতি আসছে। সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে কালকূটের রচনায়। এরজন্য গভীরভাবে পড়াশোনা করতে হত।
আরও পড়ুন-জনসংযোগ যাত্রা মন্ত্রী উদয়নের
‘দেখি নাই ফিরে’ ওঁর শেষ লেখা। কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
রামকিঙ্কর বেইজ এবং বাবার মানসিকতার মধ্যে অদ্ভুত মিল ছিল। বলা ভাল, মিলে গিয়েছিল দুজনের বাঁশির সুর। সেটা বাবা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’ লিখতে পেরেছিলেন। দুজনের সম্পর্ক খুবই মধুর ছিল। শান্তিনিকেতনে গিয়ে বাবা রামকিঙ্করের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এটা আট দশ বছরের একটা রিসার্চ ওয়ার্কের মতো ছিল। তবে লেখাটা ধরতে ধরতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। কারণ পেশাদার লেখক হিসেবে অন্যান্য লেখার চাপ। লেখার মাঝে এসেছে বহু বাধা। অসুস্থ হয়েছেন। হাসপাতালে থেকেছেন। সবকিছু সামলে যতটা সম্ভব পেরেছেন লিখেছেন। এই লেখাটার বিষয়ে আমি অনেকটাই জানি। কারণ জীবনসায়াহ্নে এসে বাবা বেশ কিছুদিন আমার কাছে ছিলেন। যাদবপুর বাঘাযতীনে।
আরও পড়ুন-জনসংযোগ যাত্রা মন্ত্রী উদয়নের
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ। আপনার জন্মদিন ১০ ডিসেম্বর, বাবার ১১ ডিসেম্বর। একদিন আগে-পরে। কীভাবে উদযাপিত হত?
জন্মদিন উপলক্ষে তেমন কিছু হত না। যখন অবস্থা ভাল ছিল না তখন তো নয়ই, অবস্থা ফেরার পরেও নয়। বাবা নাম করার পর কেউ কেউ আসতেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। জন্মদিন উপলক্ষে আমি এখন কিছু শুভেচ্ছা পাই। আমরা পরিবারের সবাই মিলিত হতাম দুর্গাপুজোর সময়। নৈহাটির বাড়িতে। সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম এই সময়টার জন্য। দিনগুলিতে বাবাকে অন্য রূপে দেখা যেত। তিনি তখন শুধুমাত্র আমাদের হয়েই থাকতেন।
আপনার ছাত্রজীবন কেমন ছিল?
চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছে বাল্যকাল। আতপুর এবং নৈহাটিতে। নৈহাটি বয়েজ স্কুল ও ভাটপাড়া বয়েজ স্কুলে পড়াশোনা করেছি। ছাত্র হিসেবে মন্দ ছিলাম না। পড়াশোনা ছাড়াও ব্যাডমিন্টন, ভলিবল খেলতাম। গাইতাম গান, বাজাতাম তবলা, খোল, মৃদঙ্গ, মাউথ অরগ্যান। আমার মা ছিলেন সুগায়িকা। তাঁকে দেখেই গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আর একটা শখ ছিল। সেটা রান্নার। এখনও আছে। সময় পেলেই হেঁশেলে ঢুকে যাই। বিভিন্ন রকমের পদ রাঁধি।
আরও পড়ুন-বীরবাহার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দেখান
ডাক্তারি পড়েছেন কোথায়?
ন্যাশানাল মেডিক্যাল থেকে স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্জারিতে স্নাতকোত্তর এবং সিনিয়র হসপিটাল প্র্যাক্টিশনার হিসাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করেছি কলকাতায়। প্রথমবার পড়াশুনার জন্য বিলেতে পা রেখেছিলাম ১৯৭৮-এ। ১৯৯২ সাল থেকে পাকাপোক্ত ভাবে ইংল্যান্ডে প্রবাসী। আমার দুই পুত্রসন্তানও ডাক্তার। বড় ছেলে শমীক ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করে। ছোট ছেলে প্রতীক দারুণ গান গায়।
অনুসরণ করেছেন বাবার পথ। সাহিত্যচর্চার জন্য উনি আপনাকে উৎসাহ দিতেন?
বাবা জানতেন আমি সাহিত্যচর্চা করি। তবে এই বিষয়ে বেশি কিছু বলতেন না। স্কুলে পড়ার সময় আমার লেখালিখির শুরু। স্কুল ম্যাগাজিনে লিখতাম। মাতামাতি করতাম লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনেও অংশ নিয়েছি। একটু বড় হওয়ার পর যখন বড় বড় পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ হয়, কোথাও পিতৃপরিচয় দিইনি। বরং পিতৃপরিচয় গোপন করেছিলাম।
আরও পড়ুন-রাস্তা সারাতেও দিচ্ছে না রেল: টক টু মেয়রে গৌতম
কেন?
নিজের যোগ্যতায় পরিচিতি পেতে চেয়েছিলাম। দেশ পত্রিকায় কীভাবে লেখা শুরু করেছি একটু বলি। একবার একটা গল্প লিখে বন্ধুদের শোনাই। তারা গল্পটা দেশ পত্রিকায় দিতে বলে। তাদের কথা শুনে একদিন চলে যাই দেশ পত্রিকার অফিসে। সাগরময় ঘোষের হাতে লেখাটা দিয়ে আসি। কিছুদিন পর গল্পটা ছাপা হয়ে যায়। সেটা ১৯৭৭ সাল। পরে জানতে পারি, বাবা নাকি আগেই খবর পেয়েছিলেন আমি দেশে গল্প দিতে গিয়েছিলাম। আমার হাতের লেখা, ঠিকানা এবং পদবি দেখে নাকি সাগরময় ঘোষ আমাকে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। বাবা সব শুনে সত্য প্রকাশ করেছিলেন। ঘটনাক্রমে, সেই দিনই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল দেশের বিজ্ঞাপন। আমার নাম ছিল সেই বিজ্ঞাপনে।
আরও পড়ুন-এমপি কাপের জমজমাট শুরু
গল্পটা পড়ে ওঁর প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
বাবা গল্পটা পড়েছিলেন। তবে সেটা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। প্রতিক্রিয়া দেননি। অন্যান্য জায়গায় আমার লেখা বেরলেও পড়তেন। তবে ভালমন্দ তেমন কিছু বলতেন না। মাঝেমধ্যে টুকটাক পরামর্শ দিতেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মন দিয়ে পড়তে বলতেন। আর একটা কথা মনে পড়ছে। একবার আমার একটা লেখা পড়ে কেন জানি না, বাবা মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। মাকে সেটা জানিয়েছিলেন। যদিও আমাকে কিছু বলেননি। তবে মায়ের কাছে শুনে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বয়স বাড়ার পর বাবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কমে আসে। বাবা কলকাতা বসবাস শুরু করেন। আমি ডাক্তারি পড়ার জন্য হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। তবে নৈহাটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি।
সমরেশ বসুর পুত্র। একজন লেখক হিসেবে এই পরিচয় আপনার কাছে কতটা চাপের ছিল?
একটা বিষয় বুঝতে পারতাম, পিছনে চালচিত্রের মতো বিখ্যাত বাবার নাম থাকলে সেইক্ষেত্রে সন্তানদের একটু চাপে পড়তেই হয়। এই চাপ আরও বাড়ে উভয়ে একই কাজের জগতে এলে। আমি খুব কম বয়সেই সেই চাপের বোঝা কাটিয়ে উঠেছিলাম। কারণ আগেই বলেছি, লেখালিখির শুরুতে কোথাও পিতৃপরিচয় দিইনি। যদিও একটা সময় সবাই জেনে গেছেন আমি কার পুত্র। বাবার এবং আমার চেহারার মধ্যে ছিল আশ্চর্য মিল।
আরও পড়ুন-উদ্ধার হল দেহ
বাবার মতো শুধুমাত্র সাহিত্যকে পেশা হিসেবে নিলেন না কেন?
সাহিত্যে উত্তরাধিকার বলে কিছু হয় না। সবাই একক। তবে এটা ঠিক, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র আমিই সাহিত্য চর্চা করি। পাঁচ ভাইবোন বলতে আমার মায়ের গর্ভে আমরা দুই ভাই, দুই বোন। আর এক ভাই বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তান। সে আমাদের থেকে অনেকটাই ছোট। যাই হোক, আমার মধ্যে সাহিত্যের বীজ এসেছে বাবার কাছ থেকেই। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বাবা চাইতেন সন্তানরা যেন স্বনির্ভর হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আমাকে নিজের ইচ্ছেমতো চলতে দিলে আমি হয়তো শুধুমাত্র সাহিত্যকে পেশা হিসেবে নিতাম। পালিয়ে যেতাম বাড়ি থেকে। ইনফ্যাক্ট দু-একবার পালিয়েছি। লেখালিখির ব্যাপারে মা আমাকে দারুণ উৎসাহ দিতেন।
‘চিরসখা’ কেন লিখলেন?
বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে লিখিনি। একটা সময় চতুর্দিকে নানা গরমিল চোখে পড়ছিল। সেগুলো মানতে সমস্যা হচ্ছিল। কারণ আমাদের বেড়ে ওঠার মধ্যে মূল্যবোধের একটা বড় জায়গা ছিল। তাই ওই সময়ের সামাজিক পরিস্থিতি মেনে নিতে না পারা থেকেই ‘চিরসখা’ লেখার তাগিদ অনুভব করি। ১১০০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের মধ্যে এসেছে মা-বাবার কথাও। তবে অন্য নামে। সমরেশ বসু এখানে লেখক বিভাস চৌধুরী। সমরেশ বসুর স্ত্রী, আমার মা গৌরী বসু উপন্যাসে অপর্ণা। বড় অংশ জুড়ে আছেন তিনিই।
আরও পড়ুন-কলকাতায় এক রাতে ৩ দুর্ঘটনা, বাড়ল নজরদারি
ফেরা যাক বাবার কথায়। উনি কতটা বন্ধু ছিলেন?
বাবা অনেকটাই আমাদের বন্ধু ছিলেন। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৭২ সাল। তখন আমি সদ্য সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছি। মাইনে ছিল ২০০ টাকা। আমার স্ত্রী রাখি ছিলেন আমার ক্লাসমেট। তিনিও ডাক্তার। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। একদিন ওকে বাড়ির সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। কিছুদিন পর বিয়ে ঠিক হল। বাবা-মাকে দেখতে দেখতে ছোট থেকেই আমার মধ্যে আত্মসম্মান জন্ম নিয়েছিল। আমি বাবাকে বলেছিলাম, ‘আমার বিয়েতে খুব বেশি খরচ করতে হবে না। কারণ আমার উপার্জন খুব কম।’ তখন বাবা দারুণভাবেই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যমহলে। তবু আমি চাইনি বাবার খরচ হোক। আমার কথা শুনে বাবা বলেছিলেন, ‘হয়ে গেছে তোর বলা? এবার আমার কথা শোন।’ তারপর উনি বলেছিলেন, ‘তোর মা এবং আমি জীবন শুরু করেছিলাম শূন্য থেকে। কিছুই ছিল না। তারপর তোরা হলি। তোদের জীবন দীর্ঘদিন কেটেছে দারিদ্র্যের মধ্যে। সেই দিনগুলো আমি ভুলিনি। তোরা কোনওদিন ছোটবেলায় ভাল পোশাক পরতে পারিসনি, ভাল খাবার পাসনি। বাবা হিসেবে এগুলো আমার বুকের মধ্যে জমা হয়ে আছে। আজ আর আমাদের সেই পরিস্থিতি নেই। অবস্থা ফিরেছে। দোতলা বাড়ি হয়েছে। বাড়ির সামনে সুন্দর বাগান। একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। সবাই আমাদের চেনে-জানে। তুই নিজের যোগ্যতায় ডাক্তার হয়েছিস। তোর বিয়ে উপলক্ষে সবাই মিলে আনন্দ করব, লোকজনকে ডাকব, এটা শুধু তোর জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য। এই নিয়ে তোর ভাবার কিছু নেই। আমি এবং তোর মা যা সিদ্ধান্ত নেব, সেটাই হবে।’
বাবার মুখের কথা শুনে আমি স্তব্ধবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গভীর বন্ধুত্বের জায়গা না থাকলে এটা হয় না। এই ছিলেন আমার বাবা।