হেমন্তের অরণ্যে তিনি পোস্টম্যান

অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল চরিত্রে। কখনও স্বাভাবিক, কখনও অস্বাভাবিক। কখনও সংসারী। কখনও সন্ন্যাসী। যদিও লেখায় কোনওরকম প্রভাব পড়েনি। মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যেতেন। সবুজ প্রকৃতির বুকে। একা হয়ে যেতেন। তখন যেন নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা। আপনমনে বিস্তার করতেন কবিতার মায়াজাল। তাঁর পৌরুষদীপ্ত উচ্চারণ ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল বাংলা কবিতাকে। তাঁকে নিয়ে চর্চা হয় আজও। তিনি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ২৫ নভেম্বর ছিল জন্মদিন। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

কাঁচা বয়সে হাতে এসেছিল ‘দেশ’-এর একটি সংখ্যা। সেই সংখ্যার আলো ছিল শক্তি-সুনীলের কবির লড়াই। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। কিছুই বুঝতাম না তখন। তবু টেনে নিয়েছিলাম সংখ্যাটা। কৌতূহলবশত। চোখ রেখেছিলাম পাতায়। তিনটি নামের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। পরবর্তী সময়ে সান্নিধ্য পেয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। তবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে গেছেন দূর আকাশের তারা হয়ে। তবে তাঁর আলোর ছটায় ভিজেছি। তাঁর কবিতার অলিগলি ঘুরে বিস্মিত হয়েছি। তাঁকে ঘিরে গল্পের অন্ত নেই। এ-ও শোনা যায়, তিনি ছিলেন বেহিসেবি, বোহেমিয়ান, উচ্ছৃঙ্খল। যদিও তাঁর লেখায় সেইসবের কোনও প্রভাব দেখি না। কখনওসখনও চলতে গিয়ে হয়তো টাল খেতেন, কিন্তু তাঁর কবিতা কোনওভাবেই টাল খায়নি। তিনি ছিলেন তালে ঠিক। লিখেছেন নিখুঁত ছন্দে। মনকে নিয়ে গেছেন চিন্তার গভীরে। ছুঁয়েছেন ভাবনার শীর্ষবিন্দু। শব্দ প্রয়োগে দেখিয়েছেন আশ্চর্য মুনশিয়ানা। মায়াজাল বিস্তার করেছেন কবিতায়। সেখানে তিনি নিখুঁত হিসেবি। উচ্ছৃঙ্খল নন, সুশৃঙ্খল।
শক্তির মধ্যে দেখা যায় মধুকবির ছায়া। দু’জনেই তুমুল দামাল। তাঁদের পৌরুষদীপ্ত উচ্চারণ ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল দুই সময়ের বাংলা কবিতাকে। দু’জনেই জনপ্রিয়। সমকালে তো বটেই, আজও।
তীব্র কলরব ছিল শক্তির মধ্যে। সেটা টের পাওয়া যায় বিভিন্ন কবিতায়। মাঝেমধ্যেই ভিড়ের মধ্যে একা হয়ে যেতেন। উচ্ছ্বাসহীন। তখন তিনি যেন নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা। ভূতগ্রস্ত। মায়াচ্ছন্ন। মাথার ভিতরে খেলে বেড়াত নতুন নতুন পঙ্ক্তি। কাগজ-কলম নিয়ে মগ্ন হয়ে যেতেন। আড়ালে। ততক্ষণ পর্যন্ত ডুবে থাকতেন, যতক্ষণ না সমস্ত উজাড় করে দিচ্ছেন।
তাঁর চরিত্রের মধ্যে ছিল অদ্ভুত বৈপরীত্য। কখনও স্বাভাবিক। কখনও অস্বাভাবিক। কখনও সংসারী। কখনও সন্ন্যাসী। প্রেম এবং প্রেমহীনতা হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। চরিত্রের এই বৈপরীত্যের ছবি ধরা পড়েছে কবিপত্নী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় কথায়, ছেলেমেয়েদের পড়তে বসাতেন শক্তি। যেতেন বাজারে। পছন্দের মাছ কিনতেন। সবজি কিনতেন। আবার কোনও কোনও দিন বাজার করতে গিয়ে বাড়ি ফিরতেন না। চলে যেতেন দূরে কোথাও। ফিরতেন কয়েকদিন পর। এমনও হয়েছে, ছেলে-মেয়েকে কোনও বন্ধুর বাড়ি বা অফিসে রেখে একা একাই উধাও হয়ে গেছেন।
ভ্রমণপিপাসু মানুষ ছিলেন। উত্তরবঙ্গের জঙ্গল, পাহাড় ছিল খুব প্রিয়। জলপাইগুড়িতে থাকতেন কবিবন্ধু অমিতাভ দাশগুপ্ত। তাঁর কাছে মাঝেমধ্যেই ছুটে যেতেন। কখনও একা। কখনও সপরিবারে। প্রকৃতি খুব টানত। সবুজের সান্নিধ্য পেলে শিশুর মতো হয়ে যেতেন। তখন তিনি অন্য মানুষ। কিছুটা অচেনা।
আপাদমস্তক কবি। লিখেছেন গদ্যও। লেখালিখির নির্দিষ্ট কোনও সময় ছিল না। আগে রাতের দিকে লিখতেন। পরে বসতেন মূলত সকালের দিকে। অফিস যেতেন বেলায়। সম্পাদকদের তাগাদায় কাগজ-কলম ছুঁতেন। ‘কবি’ সম্বোধনে খুশি হতেন খুব। একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন কবিপত্নী, বিয়ের আগে আমরা একটা পত্রিকা করতাম। কয়েকজন বান্ধবী মিলে। নাম ‘সখী সংবাদ’। কফি হাউসে ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু রুচিরা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘আপনি কি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়?’’ এতে দারুণ খুশি হয়েছিলেন। পরে জানিয়েছেন সেটা। দু’হাতে লিখেছেন। অপছন্দ হলে ছিঁড়ে ফেলেছেন। বহু উৎকৃষ্ট মানের কবিতা ছাপতে দিয়েছেন সাধারণ পত্রিকায়। এই নিয়ে স্ত্রী কিছু বললে মৃদু হেসেছেন। এতটাই উদাসীন ছিলেন। হারিয়ে গেছে তাঁর বহু লেখা।
চার যুবকের মধ্যরাতে কলকাতা শাসন যৌবনের ঘটনা। পরেও বিচিত্র ঘটনা ঘটিয়েছেন। একবার অফিস থেকে মাইনে নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। ফিরলেন দিন পনেরো পর। অনেক সময় মাইনের টাকায় খাইয়েছেন বন্ধুদের। করেছেন দানধ্যানও। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ট্যাক্সি কেনার জন্য মোটা টাকা দিয়েছিলেন। বাঁধা রেখেছিলেন নিজের পলিসি। বন্ধুবৃত্তে কবি, সাহিত্যিক, মন্ত্রী, পুলিশ, আমলারা যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন ট্যাক্সি ড্রাইভার, মাছ বিক্রেতাও। সবার সঙ্গেই সহজে মেলামেশা করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।
কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘তিরিশ বছর ধরে একটা হাইফেনে জুড়ে আছে দুই কবিবন্ধুর নাম, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অবশ্যই অনেক যুক্তি আছে ওই হাইফেন-বন্ধনের।’
এই বন্ধুত্বের মাধ্যম অবশ্যই ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা এবং কফি হাউসের আড্ডা। কবি সুজিত সরকার জানালেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিন্তু ‘কৃত্তিবাস’-এর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই ‘কৃত্তিবাস’ কবিগোষ্ঠীর অন্যতম হয়ে ওঠেননি। বলা যেতে পারে ‘কৃত্তিবাস’কে কেন্দ্র করে গোটা পশ্চিমবঙ্গে যখন বেশ একটা হইচই শুরু হয়ে যায়, তখনই শক্তির নাম এই কবি গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৩ সালে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয়। শক্তির আবির্ভাব ঘটে সপ্তম সঙ্কলনে।
শুরুর কাহিনিটি স্মরণ করা যেতে পারে। গ্রাম থেকে কলকাতা এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে তখন তরুণ কবি ও গল্পকারদের ভিড়। শক্তিকে দেখা যেত গল্পকারদের টেবিলে। ছদ্মনামে সেই সময় কয়েকটি গল্পও লিখেছিলেন। দূর থেকে তাকিয়ে থাকতেন কবিদের টেবিলের দিকে। সেখানে তখন মধ্যমণি কৃত্তিবাস-সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গল্পকারদের মধ্যে মতি নন্দী এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের দুই টেবিলেই ছিল অবাধ যাতায়াত। ওঁদের মাধ্যমেই শক্তির আলাপ হয় সুনীলের সঙ্গে। কবিদের সান্নিধ্যে এসে উত্তেজনা অনুভব করেন শক্তি। লিখে ফেলেন সনেট। সুনীলের কাছে ঠিকানা নিয়ে পাঠিয়ে দেন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়। প্রকাশিত হয় সেই কবিতা। তারপর শক্তি লেখেন আরও দুটি কবিতা। একটি পাঠান ‘কবিতা’ পত্রিকায়, অন্যটি ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায়। এই ভাবেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ‘কৃত্তিবাস’ কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে।
মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় জানান, একটা সময় গভীর বন্ধুত্ব থাকলেও, শেষের দিকে শক্তি-সুনীলের জগৎ অনেকটাই আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। সুনীলও বোহেনিয়ান। তবে শক্তির মতো নন। এঁদের মধ্যে তারাপদ রায় ছিলেন ঘোরতর সংসারী।
‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কবিরা ছিলেন দারুণ আড্ডাপ্রিয়। একটা সময় বিভিন্ন জায়গায় টেবিল ঘিরে বসতেন শক্তি, সুনীল, তারাপদ-সহ অনেকেই। আড্ডায় কেউই পরনিন্দা পরচর্চা করতেন না। এঁদের নিয়ে অনেক কথাই মুখে মুখে প্রচারিত। মিথ হয়ে গেছে গল্পগুলো। সব যে সত্য, তা কিন্তু নয়। জানালেন নাট্যব্যক্তিত্ব সৌমিত্র মিত্র। তিনি দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। পেয়েছেন স্নেহ। তাঁর মতে, এলোমেলো, অথচ একজন দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন শক্তিদা। সেইসঙ্গে দারুণ সংসারী। পড়াতেন ছেলেমেয়েদের। ছড়া লিখতেন। ছোটদের জন্য। কবিতা লিখেছেন। কবিতাকে ভালবেসেছেন। আবার অনেক কবিতা হারিয়েছেন। শুধু নিজে লেখেননি, বহু মানুষকে লিখতে শিখিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, শক্তিদার বহু লেখায় জীবনের অন্বেষণ ছিল। শান্তিনিকেতনে পড়িয়েছেন। সেই পড়ানোর মধ্যেও ছিল একটা নিবিষ্টতা। গাছপালা জল-জঙ্গলের মধ্যে অনেকেই একা থাকতে ভালবাসেন। তবে তিনি একা থাকতে যাননি। গিয়েছেন গোলমাল করতে। হয়েছেন সম্বিতহারা। সম্বিত ফিরলে শহরে ফিরেছেন। আমার এবং আমার পরিবারের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক ছিল ‘আবৃত্তিলোক’-এর সঙ্গেও। আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি’ কাব্যগ্রন্থটি।
দেবকুমার বসু ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’র প্রকাশক। তাঁর পুত্র কবি প্রবালকুমার বসু পেয়েছেন কবির সঙ্গ, প্রশ্রয়। কবিকে দেখা গেছে তাঁর শিক্ষক এবং অভিভাবকের ভূমিকায়। একটা সময় পরস্পরকে নাম বদলে ডাকতেন। লেখালিখির শুরুতে প্রবালকুমার বসু নিয়মিত যেতেন তাঁর ‘শক্তিকাকা’র বাড়ি। দেখাতেন নতুন লেখা। বাকিটা তাঁর বয়ানে— ‘নিজের কিছু লেখা জমে গেলে এক-এক দিন সকালবেলায় পৌঁছে যেতাম ওঁর বাড়িতে। বেশির ভাগ দিনই পেয়ে যেতাম। কবিতা দেখতে গিয়ে কয়েকটা শব্দ হয়তো এদিক-ওদিক করে দিতেন, অথবা মধ্যিখানে বসিয়ে দিতেন একটা শব্দ, যাতে কবিতাটার মধ্যে একটা আলাদা গতি আসে। অথবা কোনও অন্ত্যমিলে লেখা কবিতার শেষ পঙ্ক্তিতে এসে অন্ত্যমিল ভেঙে দিলেন। যে উদাহরণ ওঁর নিজের কবিতাতেই ভূরি ভূরি দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে ভেবে অবাক হয়েছি, কতটা মমতা ও স্নেহ থাকলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন কবি, যখনই গিয়েছি একটুও বিরক্ত না হয়ে আমার সদ্য-লেখা কবিতা পড়ে দেখতে মনোনিবেশ করেছেন।’
কবির সঙ্গে ডুয়ার্সের জঙ্গলেও গেছেন তিনি। জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় কয়েকবার তাঁদের হস্টেলে গেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সহপাঠী বন্ধুরা ঘিরে ধরতেন তাঁকে। আবদার রাখতে একের পর এক কবিতা পড়ে শোনাতেন। একবার হস্টেলে রাত্রিবাসের পর সকালে বললেন, ‘‘চল তোকে ডুয়ার্স চেনাই। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বেশকে ফোন করলে হয়।’’ সর্বেশ মানে সর্বেশ চন্দ, জলপাইগুড়ির সেই সময়ে দাপুটে এসপি। ফোনে তাঁকে প্রায় আদেশের সুরে বললেন, ‘‘একটা গাড়ি চাই। গয়েরকাটা যাব। আর কোনও জঙ্গল-বাংলো ব্যবস্থা করে দাও। রাত্রে থাকব।’’ এই যে বলা, এর মধ্যে কোথায় একটা জোর ছিল, ভালবাসার জোর। এই জোর দিয়েই তিনি প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। আশপাশের মানুষজনও প্রশ্রয় দিতেন এই জোরকে।
বাইরে ছিলেন হুল্লোড়বাজ। অথচ ঘরে আশ্চর্যরকম শান্ত। থাকতেন নিজের নিয়ে। বন্ধুপ্রিয় মানুষটি কোনওদিন বন্ধু হতে পারেননি স্ত্রীর। অনেক কথাই আড়ালে রেখে দিতেন। এই নিয়ে মৃদু অভিমান ছিল মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের। বিয়ের পরে-পরেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, সংসারটা আর পাঁচজনের মতো হবে না। তাঁর চাকরিই সংসার বাঁচিয়ে রেখেছিল। কারণ বিখ্যাত স্বামীর টাকার নিশ্চয়তা ছিল না।
প্রায় তিন দশক হতে চলল চলে গেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তবে আজও তিনি চর্চায়। তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান হয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। পড়া হয় তাঁর কবিতা। বিভিন্ন পত্রিকা তাঁকে নিয়ে সংখ্যা প্রকাশ করে।
সুজিত সরকার বলছিলেন, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে শান্তিনিকেতনে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে থাকাকালীন বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার পুনঃপ্রকাশের কথা ভেবেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। প্রতিবছর বইমেলায় যে ‘কৃত্তিবাস পুরস্কার’ দেওয়া হয়, সেই পুরস্কারটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নামে হওয়ার কথা ছিল। যেহেতু বিনোদন পত্রিকা আগেই শক্তি স্মৃতি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, তাই এই পুরস্কারের পরিবর্তিত নাম হয় ‘কৃত্তিবাস পুরস্কার’।
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবিকে সেইভাবে জানার সুযোগ পেলেন না অন্য ভাষার পাঠকরা। কবি সুবোধ সরকারের আক্ষেপ, ‘‘বাংলা ভাষার বাইরে তাঁকে আমরা পৌঁছে দিতে পারলাম না। ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ বাদই দিলাম, হিন্দিতেও ভাল অনুবাদ নেই। মারাঠি মালয়ালমেও নেই। এত বড় কবিকে তাঁরা জানবেন না— এটা কী করে হয়? যে যেখানে অনুবাদ করেন, সবাইকে আমি অনুরোধ করছি— করুন, একটা করে কবিতা অনুবাদ করুন। ছড়িয়ে দিন এক-একটা ভাষায়— এটাই হবে শক্তিদাকে সবচেয়ে বড় প্রণাম।’’
মাঝে মাঝে মনে হয়, আরেকটু সংযত হলে হয়তো আরও গুছিয়ে লেখালিখি করতে পারতেন। আবার এটাও মনে হয়েছে, ওই রকম বেপরোয়া জীবন যাপন না করলে হয়তো এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পাওয়া যেত না। সংযম তাঁর সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত।
হেমন্ত-জাতক তিনি। ২৫ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। শাক্ত ছিলেন কি না জানা নেই। তবে শক্তি-দেবীর সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত মিল। কখনও প্রচণ্ড। উত্তাল সমুদ্রের মতো। কখনও শান্ত। লাজুক।
বছর বছর হেমন্ত আসে। অরণ্য ডালপালা মেলে। তবে দেখা পাওয়া যায় না সেই পোস্টম্যানের। তিনি হারিয়ে গেছেন। নাম লিখিয়েছেন দূর ঠিকানায়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় রাশি রাশি চিঠি। পদ্যের রূপ নিয়ে। গদ্যের রূপ নিয়ে। ভেসে আসে চেনা গন্ধ। বহুবর্ণ চিঠি থেকে। আমাদের টানে। হাতছানি দেয়। ডাকে। ছুটে যাই। যেতেই হয়। হেমন্তের অরণ্যে সেই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি যে কারও নেই।

Latest article